ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক বিভাগের হালচাল ২;###;১১টি মূল সেবার বাইরেও রয়েছে অনেক কার্যক্রম

সেবা বেড়েছে অনেক তবে প্রচার কম

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৩১ জুলাই ২০১৬

সেবা বেড়েছে অনেক তবে প্রচার কম

ওয়াজেদ হীরা ॥ ‘সেবাই আদর্শ’ এই সেøাগানে গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশ সর্বত্রই সেবা পৌঁছে দিচ্ছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সময়ের দাবিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই সেবাও বেড়েছে অনেক বেশি। যা যথাযথ প্রচারের অভাবে অনেকটাই অজানা সাধারণ মানুষের কাছেও। যদিও যথাযথ প্রচারের উদ্যোগ নেয় না ডাক বিভাগও। আর সে কারণেই সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সেবা থাকা সত্ত্বেও জানার অভাবে রয়ে যাচ্ছে অন্তরালে। ডাক বিভাগের মূল সেবা রয়েছে ১১টি- এর সঙ্গে এজেন্সি সেবাও রয়েছে অনেক। মূল সেবা হিসেবে সাধারণ চিঠিপত্র, রেজি. চিঠিপত্র, জিইপি, ইএমএস, সাধারণ মানি অর্ডার, ইলেকট্রনিক মানি অর্ডার, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, পার্সেল সার্ভিস, ভিপিপি, ভিপিএল ও ডাক টিকেট বিক্রয়। এছাড়াও এজেন্সি সার্ভিস হিসেবে ডাক জীবন বীমা, সঞ্চয় ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র বিক্রয় ও ভাঙ্গানো, প্রাইজ বন্ড বিক্রয় ও ভাঙ্গানো, সরকারের সকল প্রকার টিকেট মুদ্রণ ও বিতরণসহ অন্যান্য। অসংখ্য সেবা দিয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ডাক বিভাগ। আবার অনেকেই বিভিন্ন সেবা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আবার অনেক সেবার বিষয়ে এখনও কোন ধারণাই নেই সাধারণ মানুষের। অনেকটা প্রচার না থাকার কারণে প্রসার হয়নি এই সংস্থার। এই সংস্থার অন্যতম একটি সেবা ইলেকট্রিক মানি ট্রান্সফার কার্যক্রম। যা সর্বপ্রথম শুরু করে এই ডাক বিভাগ। বেশ সাড়াও পেয়েছিল অথচ বর্তমানে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না এই সরকারী প্রতিষ্ঠানটি। আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধার আদলে সারাদেশের ডাকঘরগুলোতে ‘ক্যাশ কার্ড’ ও ‘ইলেক্ট্রনিক মানি অর্ডার’ নামে দুটি আধুনিক সেবা চালু করা হয়েছে। এ দুই সেবার মাধ্যমে গ্রাহকরা খুব সহজেই যে কোন ডাকঘর থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বল্প খরচে নগদ টাকা আদান-প্রদান করতে পারবেন। এছাড়াও মাত্র ৪৫ টাকার বিনিময়ে পাওয়া ক্যাশ কার্ডে কোন গ্রাহক সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রাখতে পারবেন। জমানো এ টাকা গ্রাহকরা দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে উত্তোলন করতে পারবেন। কিন্তু বেসরকারী সেবা ‘বিকাশ’ কিংবা ‘এম ক্যাশ’র মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কাছে চরমভাবে মার খাচ্ছে ডাক বিভাগ। এছাড়াও ডাকঘর সপ্তাহে বন্ধ থাকার কারণেও এই সেবা থেকে অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে জনগণ। ডাক ভবনে সেবা নিতে আসা একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিকাশে বা এম ক্যাশ যেখানে রাতদিন বা যে কোন সময় টাকা পাওয়া যাচ্ছে অথচ ডাক বিভাগের মাধ্যমে সেবা নিলে কখনও কখনও সরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধও থাকে। তাই আগ্রহ হয় না। জানা গেছে, ২০১০ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলেকট্রনিক মানি সার্ভিস উদ্বোধন করেন। একই বছরে ৫ মে হতে সার্ভিসটির কার্যক্রম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। সারাদেশে ২৭৫০টি বিভিন্ন শ্রেণীর ডাকঘরে এই কার্যক্রম চালু আছে। চলতি বছরের মধ্যেই ইএমটিএস-এর এজেন্ট সংখ্যা ৫০ হাজারের করার পরিকল্পনা আছে ডাক বিভাগের। ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস) অর্ডারের চালু করে ডাক বিভাগ বেশ সাড়া ফেলেছিল। তিন বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মানি অর্ডার করেছে তারা। এ খাতে কমিশন বাদে মুনাফাও অর্জন করেছে ডাক বিভাগ। কিন্তু মাঝখানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কারণে ডাকের ইএমটিএস কমে গেছে। ২০১১-১২ সালে দিনে ১৮ হাজার মানি অর্ডার হতো। এখন সেই মানি অর্ডার দিনে ১০ হাজারে নেমে এসেছে। শুরুতে ডাক বিভাগ এককভাবে ইএমটিএস চালু করে। এরপর বাজারে প্রতিযোগী চলে আসে। তখন গ্রাহক ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে বিকাশসহ অন্যরা যেখানে সারাদিন সার্ভিস দিতে পারছে সেখানে ডাক বিভাগের সার্ভিস প্রতিটি কর্মদিবসে অফিস সময়ের মধ্যে সারতে হয়। ডাটা সেন্টারের দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমরা অন্য সার্ভিসগুলোর মতো দিনের যে কোন সময় টাকা লেনদেন করতে পারি না। এ জন্য পিছিয়ে পড়ছে ডাক বিভাগ। ইএমটিএস আমরা আংশিকভাবে আউটসোর্সিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। এতে আরও বেশি সময় ধরে টাকা লেনদেন করা যাবে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক প্রবাস চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরাই প্রথম এই সেবাটি চালু করেছি। এরপর অন্যান্যরা আমাদের দেখাদেখি চালু করেন। আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, এই সেবাটি সব সময় পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই আমাদের ডাকঘরসহ আমরা বাংলালিংক মোবাইল অপারেটর কোম্পানির মাধ্যমে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছি। তাদের এজেন্ট করে দিচ্ছি। এর ফলে সারাদেশে বিষয়টি আরও প্রসারিত হবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচার চালানো হচ্ছে বলেও জানান মহাপরিচালক। সেবার মান দুর্বল হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মানি অর্ডার নেমে এসেছে অর্ধেকে। অভ্যন্তরীণ মানি অর্ডারের প্রতিযোগিতাতেও টিকতে পারছে না ডাক বিভাগ। ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে অভ্যন্তরীণ মানি অর্ডার ইস্যু হয়েছে ১৫ লাখ সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইস্যু হয়েছে মাত্র তিন লাখ। আন্তর্জাতিক মানি অর্ডারের প্রায় ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংক। বর্তমানে সারাদেশে ৯৮৮৬টি ডাকঘর রয়েছে। আপাতত নতুন করে ডাকঘর খোলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় ইস্যু করা একটি পত্রের মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর্থিক কারণেই মূলত নতুন করে ডাকঘর খোলার পরিকল্পনা নেই সরকারের। তবে পুরনো ডাকঘরগুলো নিয়েও ইতিবাচক ও অবকাঠামো উন্নয়নের চিন্তা করছে সরকার। সেই সঙ্গে আধুনিক সুবিধা প্রণয়ন করতে চাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি এই বিষয়ে সংসদে সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী তারানা হালিম। মন্ত্রী তারানা হালিম জানিয়েছেন যে, সকল খাত থেকে ডাক বিভাগ আয় করে থাকে তা হলো : সাধারণ ডাক টিকেট বিক্রয়, সার্ভিস ডাক টিকেট, নগদ আদায়কৃত ডাক মাশুল, মানি অর্ডার কমিশন, পোস্টাল অর্ডার কমিশন, বৈদেশিক ডাক হতে প্রাপ্ত, অন্যান্য কমিশন ও অন্যান্য প্রাপ্তি। জানা গেছে, নিরাপদে দেশের ভেতরে টাকা এক স্থান হতে অন্য স্থানে পরিবহনের লক্ষ্যে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড নামে একটি সার্ভিস আছে। যা প্রধানমন্ত্রী ২৬ মার্চ ২০১০ সালে উদ্বোধন করেন। এর পরের বছর ১ জুলাই হতে পোস্টাল ক্যাশ কার্ডেও বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। ডাক বিভাগ আইটিসিএল লি. নামক আইটি ফার্মের সঙ্গে যুগ্মভাবে সার্ভিসটি পরিচালনা করছে। এই পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের সুবিধাবঞ্চিত জনগণের মধ্যে সরকারী বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, পুষ্টি ও শিক্ষা ভাতা ইত্যাদি এই কার্ডের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এছাড়াও এই কার্ডের মাধ্যমে টাকা জমা, উত্তোলন, সঞ্চয় ও এক কার্ড হতে অন্য কার্ডে টাকা হস্তান্তর করা যায়। জানা গেছে, বর্তমানে ১৪৪৬টি পোস্ট অফিসে এই সেবা আছে যেখানে কার্ডধারীর সংখ্যা ৭৩ হাজারের ওপর। তবে সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের মধ্যেই ৬৫০০টি পোস্টাল ক্যাশ চালুর পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে ৮টি পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের ৮টি বুথ চালু আছে যা ১৩টি করার পরিকল্পনা আছে এ বছরের মধ্যেই। আর তার বাস্তবায়ন হলে সেবার পরিধি অনেক বেড়ে যাবে বলেই মনে করছেন ডাক বিভাগের কর্মকর্তারাও। মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, বর্তমানে ৯৫টি ডাকঘরে ডাক বিভাগের কার্যপ্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের মধ্যে ১৪৩৮ স্বয়ংক্রিয়করণের পরিকল্পনা আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এটি হলে ডাক বিভাগের বিভিন্ন সার্ভিস একিভূত একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে। এছাড়াও দেশের সকল ডাকঘরগুলোকে ক্রমান্নয়ে একটি একক ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার সম্ভব হবে বলেও মনে করেন মন্ত্রী তারানা হালিম। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর গ্রামীণ ডাকঘর নির্মাণ একটি উন্নয়ন প্রকল্প সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। সে হিসেবে আধুনিক ডাকঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে ডাক বিভাগকে। সর্বশেষ গত পাঁচ বছরে ডাক বিভাগকে লোকসান গুনতে হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তথ্যমতে, ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে বাৎসরিক লোকসানের ধকল বেশি মাত্রায় শুরু হয় ডাক বিভাগে। ওই বছর লোকসান ছিল ৮৭ কোটি ৯ লাখ। ২০০৩-০৪ অর্থবছরই লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে লোকসান ২০১ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ১৭৭ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ২২৯ কোটি টাকা আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ক্ষতি হয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডাক বিভাগের দিকে নজরদারি আরও বৃদ্ধি করতে হবে, তা না হলে সামনে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। এ বিষয়ে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডাক বিভাগ একটি। ডাক বিভাগে খরচের হিসেবের চেয়েও সেবার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। আর লোকসানের একটা কারণ হচ্ছে সরকার জনগণকে ভর্তুকি দিচ্ছে। জনগণকে সেবা দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দিতে হয়। তবুও জনগণের কল্যাণের স্বার্থেই প্রতিষ্ঠান আছে এবং রাখতে হয়। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ডাক বিভাগের এজেন্ট সেবা সঞ্চয় ব্যাংকে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার ট্রানজ্রিক্ট হয় এবং প্রতি মাসে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার ট্রানজ্রিক্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ ডাক ভবনে প্রতিনিয়তই যাতায়াত করেন অসংখ্য সেবাপ্রার্থী নারী ও পুরুষ। ডাক বিভাগের সেবাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেন তারা। তবে প্রতিষ্ঠানের সেবার প্রতি আরও আধুনিকতার কথাও জানান আগতরা। ডাক সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন বড় বড় ডাকঘরে জেলা ও বিভাগের ডাকঘরগুলোকে নিয়ে বর্তমান সরকার যে মহাপরিকল্পনা করেছেন তার বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে আবারও হারানো জৌলুস ফিরে পাবে ডাক বিভাগ। এক্ষেত্রে প্রচারের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তারা।
×