ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘লাশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, যমুনায় ভাসাইয়া দেন’

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩১ জুলাই ২০১৬

‘লাশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, যমুনায় ভাসাইয়া দেন’

ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ অভিযানে নিহত জঙ্গী আব্দুল হাকিম ওরফে নাইমের লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তার স্বজনরা। প্রাথমিকভাবে জঙ্গী হাকিমকে কুয়াকাটার বাসিন্দা বলে ধারণা করা হলেও পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে তিনি টাঙ্গাইলের বাসিন্দা। পরিচয় প্রকাশের পর থেকেই হাকিমের গ্রামেরবাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরের গোলাবাড়ি গ্রামের বাড়িতে ভিড় করছে উৎসুক জনতা। বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার কর্তব্যরত কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যাচ্ছেন। আক্ষেপ, ঘৃণা-লজ্জা ঢাকতে হাকিমের স্বজনরা বলছেন, ‘লাশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, এমন খারাপ লোকের লাশ যমুনায় ভাসাইয়া দেন।’ এদিকে নিহত জঙ্গী হাকিমের দুই আত্মীয়কে আটক করেছে পুলিশ। গোপালপুর থানা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা যায়, ঝাওয়াইল ইউনিয়নের গোলাবাড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক নুরুল ইসলামের ঘরে জন্ম হাকিমের। সঠিক জন্মতারিখ জানা না থাকলেও আনুমানিক বয়স ৩৭-৩৮ বছর। জন্মের কিছুকাল পর বাবার মৃত্যুর পর জীবনের মোড় ঘুরে যায় হাকিমের। স্থাবর সম্পত্তি না থাকায় তার মা তাকে নিয়ে নানারবাড়ি জামালপুরের ঘোড়াধাপ গ্রামে গিয়ে ওঠেন। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা এবং আরবি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করা। এ সময় এলাকার মানুষের কাছে হাকিম মৌলভী নামে পরিচিতিও লাভ করে। বিগত ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে মধুপুরের চাপাইত গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদ মাস্টারের মেয়ে সখিনা বেগমকে বিয়ে করে। রাজিয়া (১০), তাসলিমা (৭) ও সাইফুল্লাহ (৪) নামে তিন সন্তান রয়েছে তার। নানারবাড়ি চলে যাওয়ার পর হাকিমের সঙ্গে বাবার বাড়ির লোকজনের তেমন যোগাযোগ ছিল না। তবে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে তাদের গ্রামেরবাড়ির খবর আসত। সেই সূত্র থেকেই প্রতিবেশীরা নিশ্চিত করেন ছাত্রজীবনে হাকিম ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে এ অঞ্চলের শিবিরের একজন নেতা হয়ে ওঠে। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে জামালপুরের অধিবাসী জেএমবি প্রধান শায়খ আব্দুর রহমানের সঙ্গে সখ্য থেকে সেই বিশ্বাসের অনুসারী হয়ে যান। পরে ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান ও ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হলে গা ঢাকা দেয় হাকিম। দীর্ঘদিন তার আর কোন খবরও জানত না প্রতিবেশীরা। আব্দুল হাকিমের চাচি রাবেয়া বেগম বলেন, ২০০৯-১০ সালে হঠাৎ একদিন গ্রামেরবাড়িতে বৌ-বাচ্চা নিয়ে হাজির হয় হাকিম। লিবিয়া যাবে বলে বৌ-বাচ্চা এখানে রেখে যাবে। তার নিজের কোন জায়গা না থাকায় আমাদের অংশেই জোর করে ১৩-১৪ হাতের দুই চালা একটি টিনের ঘর তুলে ছয় মাসের মতো অবস্থান করে লিবিয়া চলে যায়। এক-দেড় বছর পর আবার দেশে ফিরে আসে। তিনি আরও বলেন, এ সময়ে তার স্ত্রী সখিনা ও মেয়েরা কিছু সময়ের জন্য এই বাড়িতে অবস্থান করলেও তারা কারও সঙ্গে মিশত না। প্রচ- রক্ষণশীল হওয়ায় তার মুখটি পর্যন্ত দেখতে পারেননি কেউ। দুই চালা এ ঘরের ভেতর হাঁড়িপাতিল ও একটি স্টিলের ট্রাঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নেই। এতদিন ওই ঘর তালাবদ্ধ ছিল। পুলিশ এসে ওই ঘর থেকে একটি ডায়েরি ও কিছু কাগজপত্রসহ আমার স্বামীকে থানায় নিয়ে গেছে। হাকিমের দূর সর্ম্পকের চাচা আব্দুর রহমান বলেন, ২০১১-১২ সালের দিকে লিবিয়া থেকে গ্রামে ফিরে আসে হাকিম। তখন জানায়, সে গ্রামেই স্থায়ী হবে। আমাদের এ পাড়ায় ধর্মীয় শিক্ষিত কোন লোক না থাকায় তার স্থায়ী হওয়ার কথাতে অনেকেই খুশিই হয়েছিল। পরে গ্রামে ফিরে এসেই গ্রামের মানুষকে একত্রিত করে টিনের ছাপড়ার একটি মক্তব খোলে। সেখানে যমুনার চরে বাড়ি শাখারিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রকে দিয়ে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা দিত। পাশাপাশি ওই মক্তবে গ্রামের মানুষদের ধর্মীয় বয়ান দিত। ধর্ম বিষয়ে একনাগাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারত। কোন ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করাকে অপছন্দ করত। তবে বিভিন্ন মসজিদে খুতবা পাঠসহ এলাকার একাধিক মাদ্রাসায় সারারাত ধরে বয়ান দিয়ে মানুষকে ধর্মের কথা বলত। তার অধিকাংশ কথাই উগ্র ধর্মীয় মতবাদের ছিল। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক সকল কিছুতেই ফতোয়া দিতে শুরু করে সে। একটা সময় তার কার্যক্রম আমাদের সন্দেহ হলে তাকে ২০১৩ সালের শেষদিকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। সে উগ্র ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী ছিলÑ এমনটাই নিশ্চিত করেছেন নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীরা। বর্তমানে ওই মক্তবটি বন্ধ রয়েছে। বাড়ির মালিক চাকলাদার তাতে গরুর গোয়ালঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। জঙ্গী হাকিম ঢাকার কল্যাণপুরে নিহত হওয়ার পর তার প্রাথমিক পরিচয়ে কুয়াকাটার বাসিন্দা বলে জানা যায়। পরে তার আসল পরিচয় নিশ্চিত হলে বেরিয়ে আসে গোপন জীবনের কথা। বিগত ২০০৬ সালে শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে অনেকের সঙ্গে সেও গা ঢাকা দেয়। একপর্যায়ে স্থায়ী হয় কুয়াকাটায়। সেখানে ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে সাগরনীড় হাউজিং নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ নেয়। সে সময় কুয়াকাটার ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটারও হয় সে। পরিচয়পত্রে লেখা আছেÑ নাম: আবু হাকিম নাইম, পিতা: নুরুল ইসলাম, মাতা: মোসাঃ হালিমা, গ্রাম: কুয়াকাটা। বিগত ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটি বাড়িতে ভাড়া থাকত, পরে সাগরনীড় হাউজিং প্রকল্পের অফিসে থাকত। পরে ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে কুয়াকাটা থেকে চলে আসে টাঙ্গাইলের মধুপুরের শ্বশুরবাড়িতে। তারপর কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করার পর গ্রামেরবাড়ি গোপালপুরে ছয় মাস অবস্থান করে স্ত্রী-সন্তান রেখে চলে যায় লিবিয়ায়। পরবর্তীতে গত ২০১৩ সালের দিকে নিজগ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সে একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। এদিকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় মধুপুরের পিরোজপুর চাপাইত এলাকার মানুষ তাদের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না। জঙ্গী হাকিমের প্রতিবেশী, ফুফু হনুফা ও ভাগ্নি রোজিনা বলেন, ‘হাকিম মৌলভী যখন দূরে ছিল, তখন তারে নিয়া আমরা গর্ব করছি। আমাদের বংশের সেই একমাত্র ধর্মীয় বিদ্যান লোক ছিল। কিন্তু দেড়-দুই বছর গ্রামে থাকার সময়ে গ্রামের মানুষ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। কোরবানি, পর্দা, নামাজ, মিসকিন খাওয়ানো, মৃত ব্যক্তি নিয়ে এমন সব কথা বলত, যা আমরা তো দূরের কথা মসজিদের হুজুরও অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। হাকিমের এমনিতে সবই ভাল ছিল।’ তারা আরও বলেন, ‘শুধু ধর্মের ব্যাপারে এত বেশি বাড়াবাড়ি করছে যে, ফকির মিসকিন মরলেও মানুষে কান্দে, কিন্তু হাকিমের মৃত্যুর জন্য কেউ চোখের এক ফোটা পানিও ফালায় নাই। লাশ গ্রহণ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এমন খারাপ লোকের লাশ যমুনায় ভাসাইয়া দেন। যাতে অন্যরা দেখে শিক্ষা পায়।’ গোপালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জলিল জানান, হাকিম ওরফে নাইমের থাকার ঘরের একটি ট্রাঙ্ক থেকে একটি পুরাতন এ্যালবাম উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে হাকিম ও তার স্ত্রী সখিনা খাতুনের একটি ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। এছাড়া লিবিয়া থেকে তার স্ত্রীর নামে হাকিমের টাকা পাঠানোর একটি রশিদও পাওয়া গেছে। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নাইমের চাচা সুরুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া তার এলাকায় থাকাকালীন কার্যক্রম ও স্থানীয় সঙ্গীদের ব্যাপারে নজরদারি ও খোঁজখবর চলছে। মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম বলেন, মধুপুরের চাপাইত থেকে জঙ্গী হাকিমের স্ত্রীর বড়ভাই আব্দুর রহমানকে আটক করা হয়েছে। তাকে নিহত জঙ্গী হাকিমের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×