ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের টার্গেট ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন শিশুপার্ক ও ঢাকা ক্লাব

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩১ জুলাই ২০১৬

জঙ্গীদের টার্গেট ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন শিশুপার্ক ও ঢাকা ক্লাব

গাফফার খান চৌধুরী ॥ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও ঢাকায় বড় ধরনের হামলার চক্রান্ত করেছিল গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারি এবং কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গীরা। তাদের টার্গেট ছিল উচ্চ আদালত, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, শিশুপার্ক ও ঢাকা ক্লাবসহ আশপাশের স্থাপনাগুলো। এর মধ্যে হামলার প্রথম টার্গেটের তালিকায় ছিল শিশুপার্ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন। হামলা চালাতে ফেব্রুয়ারিতে ১২ জঙ্গী পুরো এলাকা রেকি করেছিল। রেকির সময় তিন জঙ্গী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। পালিয়ে যায় ৯ জঙ্গী। তাদেরই একজন নিবরাস, যে গুলশান হামলাকারীদের অন্যতম। পলাতক অপরদের মধ্যে অর্ক সম্প্রতি কল্যাণপুরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয় জঙ্গীদের একজন। শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃতরা ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতার চালানোর পরিকল্পনার কথা জানালেও, হামলার টার্গেট সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি। টার্গেট সম্পর্কে তথ্য দিলে হয়ত গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার হামলা ঠেকান সম্ভব হতে পারত। হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় নিবরাসের মৃত্যু এবং কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অর্কের মৃত্যুর ঘটনা, দুইটি ঘটনায় জড়িত জঙ্গীরা যে একই গ্রুপের তা প্রমাণ করে। এ সংক্রান্ত প্রমাণাদিও পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো। পলাতক জঙ্গীদের পরবর্তী টার্গেট সম্পর্কে ধারণা পেতে কল্যাণপুর থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতারকৃত জঙ্গী হাসান এবং চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গীকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। একটি মামলার সূত্র ধরে এমন তথ্য মিলেছে। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগ মডেল থানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পরিদর্শক আবুল বাশার ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় বলা হয়, বড় ধরনের নাশকতা চালাতে জঙ্গীরা শাহবাগ শিশুপার্ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কাছে অবস্থান করছে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে বেলা সোয়া এগারোটার দিকে সাদা পোশাকে সেখানে বিপুল পরিমাণ পুলিশ অভিযান শুরু করে। অভিযান চলে বিকেল সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত। সেই অভিযানে গ্রেফতার হয় রাইয়ান মিনহাজ ওরফে রাইমু ওরফে আরমি (২৪)। পিতা মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা ৩১/১ মধ্যবাসাবো, সবুজবাগ, ঢাকা। রাইয়ান পরিবারের সঙ্গে ঢাকার বড় মগবাজারের ওয়্যারলেসের সেঞ্চুরি মার্কেটের পেছনে সেঞ্চুরি আর্কেডে বসবাস করত। অপরজন আহম্মেদ শাম্মুর রাইহান ওরফে চিলার (২৩)। পিতা মৃত মফিজ উদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রাম। সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার রমনা থানাধীন বড় মগবাজারের ১০৪/১-ক নম্বর অগ্রণী এ্যাপার্টমেন্টের এ-১ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করত। তৃতীয় জন তৌহিদ বিন আহম্মেদ ওরফে রিয়াজ ওরফে কাচ্চি (২৪)। পিতা সহিদুল্লাহ আহমেদ। স্থায়ী ঠিকানা যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানাধীন রামকৃষ্ণপুর গ্রাম। সে ঢাকার বনানীর ডি ব্লকের ১৩ নম্বর সড়কের ৯৯ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত। অভিযানকালে কৌশলে নয়জন পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানায়, তারা বারোজন সেখানে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছিল। হামলার আগে তারা রেকি করছিল। পালিয়ে যাওয়া সদস্যদের কেউ কেউ শিশু পার্কের সামনে, কেউ কেউ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, শিল্পকলা একাডেমি, উচ্চ আদালতসহ আশপাশের ভবনের আশপাশে ও ভেতরে অবস্থান করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা দ্রুত ছদ্মবেশে হেঁটে মানুষের ভিড়ে মিশে যে যার যার মতো চলে যায়। তদন্তকারী সূত্রগুলো গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, গত ৯ ফেব্রুয়ারি রেকি করা ১২ জঙ্গীসহ তাদের আরও সহযোগীদের হামলার টার্গেট ছিল শিশুপার্ক, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট, উচ্চ আদালত, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা ক্লাবসহ আশপাশের স্থাপনা। টার্গেটের দিক থেকে প্রথমেই পছন্দের তালিকায় ছিল শিশুপার্ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট। একসঙ্গে নয়, ধাপে ধাপে তারা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। একটি হামলা সফল হওয়ার পর, দীর্ঘ সময় নিয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আরেকটি হামলা চালাত। এমন পরিকল্পনাই ছিল গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের। গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গীকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে গ্রেফতারকৃতরা ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর তথ্য দেয়। তবে কোথায় কবে সেই নাশকতা চালাবে সে সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তথ্য পেতে বহুভাবেই চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু জঙ্গীরা কোনভাবেই হামলার সুনির্দিষ্ট টার্গেট ও পরিকল্পনা সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। হামলার টার্গেটকৃত জায়গা বা ব্যক্তি সম্পর্কে ন্যূনতম কোন ধারণা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে। তবে রিমান্ডে তিন জঙ্গী পলাতক জঙ্গীদের নাম প্রকাশ করে। পলাতক জঙ্গীরা হচ্ছে, নিবরাস ইসলাম ওরফে শিমু (২৪), সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো (২৪), তৌসিফ (২৪), সাবাব সালাউদ্দিন ওরফে হক ওরফে ইনু (২৫), সালভি আলী ওরফে মালাভি (২৫), রিফাত (২৩), তুরাজ (২৪), ইয়াসিন তালুকদার (২৫) ও গালিব (২৭)। গ্রেফতারকৃতদের এমন তথ্যের ভিত্তিতে পলাতকদের গ্রেফতারে সারাদেশে একের পর এক অভিযান চালানো হয়। কিন্তু তাদের হদিস মিলছিল না। গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ছয় জঙ্গী। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে জঙ্গীদের গ্রেনেড ও গুলিতে নিহত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল হক ও বনানী মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ খান। এরপর জঙ্গীরা ১৭ জন বিদেশীসহ ২০ জনকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে তিন জন নারীও রয়েছে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কমান্ডোদের চালানো অপারেশন ছয় জঙ্গী নিহত হয়। নিহতদের একে একে নিহত ছয় জঙ্গীর পরিচয় প্রকাশ হয়। প্রকাশিত সেই ছয় জঙ্গীরই একজন গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট থেকে পালিয়ে যাওয়া নিবরাস ইসলাম ওরফে শিমু ওরফে মরক্কো। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের ৫৩ নম্বর জাহাজ বিল্ডিংয়ে পুলিশের অভিযানে নয় জঙ্গী নিহত হয়। ইকবাল নামের এক জঙ্গী পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান। নিহত নয় জঙ্গীর মধ্যে আট জনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নিহত নয়জনের মধ্যে একজন শাহবাগ থেকে পালিয়ে যায় সেজাদ রউফ ওরফে অর্ক। তার পিতার নাম তৌহিদ রউফ। পরিবারের সঙ্গে ৬২ পার্ক রোড, বাসা নং-৩০৪, রোড নং-১০, ব্লক-সি, ফ্ল্যাট নং-৯, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, থানা-ভাটারা, ঢাকায় বসবাস করত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। অর্ক বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র শিক্ষার্থী ছিল। র‌্যাব সর্বশেষ ৬৮ জনের নিখোঁজের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেই তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে ছিল অর্কের নাম। অর্ক নিখোঁজের বিষয়ে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে তার পরিবার। নিবরাস ও অর্কের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর গুলশানের হলি আর্টিজানে ২২ জনকে হত্যাকারী ৬ ছয় জঙ্গী এবং কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয় জঙ্গী, পলাতক এক জঙ্গী এবং আহত অবস্থায় গ্রেফতার থাকা হাসান একই গ্রুপের সদস্য বলে শতভাগ নিশ্চিত হয় তদন্তকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্ট একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গী যদি জিজ্ঞাসাবাদে সঠিক তথ্য দিত তাহলে হয়ত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারি এবং শোলাকিয়ার হামলা ঠেকানো সম্ভব হতো। তিন জঙ্গীর অসহযোগিতার কারণে হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার হামলা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গী রিমান্ডে শুধুমাত্র ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর তথ্য দিয়েছিল। তবে কোথায়, কবে, কখন সেই হামলা চালানো হবে, সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি। কল্যাণপুর থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতারকৃত জঙ্গী হাসানকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত তিন জঙ্গীর মুখোমুখি করার প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া নিখোঁজদের সম্পর্কেও সে সময় গভীরভাবে তদন্ত করলে হয়ত অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যেত।
×