ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অনেকের মন্তব্য- তাহলে জঙ্গীদের নিয়ে কমিটি করলেই হয়

এ কী বললেন আশরাফ, জামায়াত-বিএনপি নিয়ে জঙ্গীবিরোধী কমিটি!

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩১ জুলাই ২০১৬

এ কী বললেন আশরাফ, জামায়াত-বিএনপি নিয়ে জঙ্গীবিরোধী কমিটি!

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ এ কী বললেন সৈয়দ আশরাফ! গুলশান-শোলাকিয়াসহ সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলার পর এক অভূতপূর্ব জনঐক্য গড়ে উঠছে বাংলাদেশে। শান্তিপ্রিয় পুরো দেশের প্রতিটি মানুষ এখন এসব মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, একাট্টা। সংঘটিত প্রতিটি হামলার তদন্তে যখন নেপথ্যের কুশিলব হিসেবে জামায়াত-শিবিরসহ বিএনপির কিছু কিছু ব্যক্তির নাম উঠে আসছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রগতি ও মানবতার পক্ষের সব পক্ষের মানুষের অভিযোগের তীরও যখন এই রাজনৈতিক জোটটির দিকে- ঠিক তখনই বিএনপি-জামায়াতসহ সব দলকে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী গঠনে শাসক দলটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিতর্কিত মন্তব্য সারাদেশেই তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। হতভম্ব-হতবাক প্রগতির পক্ষের রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখে মুখে এখন একই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে যে- ‘এ কী বললেন সৈয়দ আশরাফ? জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠন করে কী অর্জন করতে চান তিনি? যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, অস্ত্র-অর্থ ও মদদ দিচ্ছে- তাদেরই কমিটিতে রেখে কীভাবে জঙ্গী দমন করতে চান সৈয়দ আশরাফ? শুধু রাজনৈতিক নেতাকর্মী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষই নন, খোদ মাঠ পর্যায়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্ণধার বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকরাও এ নিয়ে পড়েছেন ধূম্রজালে। এখন তাঁরা কার নির্দেশনা নিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠনে কাজ করবেন? এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে লিখিত চিঠি দিয়ে মাঠের নেতাদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে স্পষ্টত তৃণমূল নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনভাবেই এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসের মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক জামায়াত-বিএনপির কেউ অনুপ্রেবেশ করতে না পারে। দলীয় এমন সিদ্ধান্ত আর খোদ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে ১৪ দলীয় জোটের সকল নেতাদের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে সব দলকে নিয়ে জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশ খোদ সরকারদলীয় জোটের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। গত বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সন্ত্রাস ও নাশকতাবিরোধী যেসব কমিটি হবে, সেখানে সব দলের জনপ্রতিনিধি থাকবেন। সম্মেলনে তাঁর এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে পরে সাংবাদিকরা সৈয়দ আশরাফকে প্রশ্ন করেন যে, সন্ত্রাসবিরোধী কমিটিতে নির্বাচিত বিএনপি-জামায়াতের জনপ্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না? জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অবকোর্স করা হবে’। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত সামান্য সুর বদলিয়ে বলেন, কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটা নির্দেশনা আছে- সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এসব কমিটি করছে। প্রশাসনের ব্যাপারে যখন সিদ্ধান্ত হবে, উদ্যোগ নেয়া হবে, তখন প্রশাসনিক আওতার ভেতরে কমিটিগুলো ভবিষ্যতে করা হবে। সৈয়দ আশরাফের এমন মন্তব্যে গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরই রাজনৈতিকসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মাঝে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এটা সৈয়দ আশরাফের ব্যক্তিগত মতামত, সরকার বা দলের নয়- শাসক দলের নেতারা এমন কথা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের অনেক নবীন-প্রবীণ কেন্দ্রীয় নেতাই এ বিষয়ে তাঁদের তীব্র অসন্তোষের কথা চেপে রাখতে পারেননি। ক্ষুব্ধ এসব নেতার মতে, দেশের বড় বড় ঘটনার পরও রাজনৈতিক কর্মকা-ে সত্যিই যেন ‘ডুমুরের ফুল’ হচ্ছেন সৈয়দ আশরাফ। গুলশান-শোলাকিয়ার ঘটনার পর যখন ১৪ দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ রাজপথে সোচ্চার, সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে মানবতার এসব শত্রুদের প্রতি ঘৃণা-ধিক্কার জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানের পর সারাদেশেই যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে নিয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি- ঠিক তখন জামায়াতকেও কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি করতে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে সবাই হতবাক ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। দলের সাংগঠনিক কোন কর্মকা-ে অংশ না নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ করে কিছু বেফাঁস মন্তব্য করে সৈয়দ আশরাফ শুধু দলেরই না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মহাঐক্যে গঠনের প্রক্রিয়াতে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করবেই বলেই তাঁরা মনে করছেন। কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিম শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের ঐক্য বা কাছে টানার সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনই ঐক্য হবে না। বরং জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলার মদদদাতা, অর্থদাতা ও ইন্ধনদাতা হিসেবে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। বাংলার মাটিতে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসী ও মদদদাতাদের ঠাঁই হবে না। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে সরকারী দল আওয়ামী লীগের কমপক্ষে এক ডজন নেতাকে ফোন করেও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেই শুধু তাঁরা এটুকু বলেন- দলের সাধারণ সম্পাদক এমন কথা বললে আমরা যাব কোথায়? তাঁর এমন মন্তব্য শুধু বিভ্রান্তই ছড়াবে। দেশব্যাপী যে জনঐক্যে গড়ে উঠেছে, সেই প্রক্রিয়াতেও বাধা সৃষ্টি হবে। দলের কোন কর্মকা-ে অংশ না নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু বিভ্রান্তকর করে সব কাজেই উনি (সৈয়দ আশরাফ) বাধার সৃষ্টি করছে। তাঁর বক্তব্যে অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠনের চেয়ে এসব হামলার সঙ্গে জড়িতদের নিয়েই কমিটি গঠন করা ভাল! তবে কেউ-ই মন্তব্য প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, জামায়াতকে নিয়ে জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠন হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই না। কারণ জামায়াতের বিরুদ্ধেই তো আমাদের লড়াই-সংগ্রাম। এরাই সব জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলার হোতা। এদের নিয়ে নয় বরং জামায়াতসহ জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকার, বিরোধী দল, বামপন্থী, ডানপন্থীসহ সব প্রগতিশীল শক্তিকে একজোট করে রাজপথে নামা উচিত। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরীক ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট এনামুল হক প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, সৈয়দ আশরাফের এমন মন্তব্য সব মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। জামায়াত-শিবিরই যত নষ্টের মূল তা কে না জানে। এদের সঙ্গে কোনভাবেই কোন ঐক্য বা কমিটি হতে পারে না। উনি (সৈয়দ আশরাফ) একটা কথা বলেই নিশ্চুপ হয়ে যান। এতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কেন এমন কথা বললেন তা আগামী ১৪ দলের বৈঠকে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলেও জানান তিনি। সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব) আ স ম হান্নান শাহ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নাম ব্যবহার করে। রাজনৈতিক কার্ড হিসেবে খেলে। বাস্তবে জামায়াতের সঙ্গে আগেও আওয়ামী লীগের বন্ধুত্ব ছিল। তাই জামায়াতকে নিয়ে কমিটি করার কথা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সে জন্য আরেকটি অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আগে দেখি নেই যে তারা কী করে, তারপর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। গুলশান-শোলাকিয়াসহ সম্প্রতি কয়েকটি বড় ধরনের জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই নানা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে আওয়ামী লীগ বলছে, দেশে সম্প্রতি জঙ্গীবাদের উত্থান এবং হামলার পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোটের মদদ রয়েছে। সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যেই বিএনপি জঙ্গীদের ব্যবহার করছে বলে ক্ষমতাসীনদের অভিযোগ। গুলশান হামলার পরদিনই জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গ্রামে-গঞ্জসহ দেশের সর্বত্র জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানের পরই সারাদেশে ১৪ দলের উদ্যোগে জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেশের সব তৃণমূল নেতাদের কাছে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে কীভাবে এসব কমিটি গঠন করা হবে, কারা কারা কমিটিতে থাকবেন, কে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব হবেন তারও একটি নির্দেশনা দেয়া হয় ওই চিঠিতে। ওই চিঠিতে স্ব স্ব এলাকার একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে আহ্বায়ক করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল ও শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। সেখানে সতর্ক করে দেয়া হয়, এসব কমিটিতে কোনভাবেই বিএনপি-জামায়াতের কেউ স্থান না পায় কিংবা গোপনে প্রবেশ করতে না পারে। ওই চিঠির ভিত্তিতে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও মহানগরে যখন একযোগে এসব জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠিত হচ্ছে, তখন বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিদের এসব কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি করার সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে সর্বত্রই একটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু আওয়ামী লীগ, ১৪ দল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শ্রেণী-পেশার মানুষই নয়, এই জঙ্গী হামলার পর খোদ বিএনপিতেও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার সোচ্চার দাবি উঠেছে। বিএনপির অনেক বুদ্ধিজীবীই আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদবিরোধী দেশের বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য দলটির প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। যখন বিএনপিও মনে করছে জামায়াত-শিবিরের মদদ, অংশগ্রহণ ও অর্থায়নেই এসব হামলার ঘটনা ঘটছে, তখন আওয়ামী লীদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে থাকা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এমন ইঙ্গিত সব মহলে ধূম্রজালেই সৃষ্টি করবে। নাম প্রকাশ করার শর্তে অনেকেই বলাবলি করছেন- জাসদ নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেয়ার পর এখন জামায়াত নিয়ে মন্তব্য করে আরেকটি নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করলেন সৈয়দ আশরাফ। সময় থাকতে তাঁকে থামাতে না পারলে জঙ্গীবাদবিরোধী দেশব্যাপী যে জাতীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে তা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গেলে আবারও হোঁচট খেতে হতে পারে।
×