ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খোলা আকাশের নিচে বানভাসিরা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৩০ জুলাই ২০১৬

খোলা আকাশের নিচে বানভাসিরা

রাজু মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলায় বুধবার সন্ধ্যা ‘দুযোর্গপূর্ণ জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবদুল্লা আল মামুন। তিনি উপজেলার সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছেন। উপজেলার সকল কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি দুর্যোগ কমিটি গঠন করেছেন। ৬টি ইউনিয়নের বন্যার্ত মানুষদের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা এবং খোঁজখবর নেয়ার জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করে তা ২৪ ঘণ্টা খোলা রেখে সকল কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে ডিউটির ব্যবস্থা করেছেন। ৬টি ইউনিয়নে ১০ সদস্যবিশিষ্ট ৬টি রিলিফ এবং রেসকিউ টিম গঠন করা হয়েছে। উপজেলার ৫৪টি ওয়ার্ডে ৫৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ সব আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যার্ত মানুষদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় হাজার হাজার বানভাসি মানুষ ডিসি রোড, বাঘমারা সড়ক, বাটকামারী সড়কের খোলা আকাশের নিচে শুধুমাত্র পলিথিন টাঙ্গিয়ে গরু, ছাগল, হাঁস মুরগি নিয়ে টানা ৪ দিন থেকে রাত কাটাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমামুন জানান বুধবার ভোরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে রৌমারীর সদর ইউনিয়নে বাঘমারা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় রৌমার উপজেলা ক্যাম্পাস চত্বর, শহীদ মিনার চত্বর এবং বাজারসহ পুরো শহরে এখন এক হাঁটু পানি। রৌমারীতে ৪৩হাজার পরিবারের মধ্যে ৩০হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৮১টি মৌজা এখন পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। এখানকার বিশাল জনগোষ্ঠী দিন মজুরির ওপর নির্ভরশীল। টানা ১০দিন থেকে কাজ না পেয়ে এক প্রকার বেকার জীবন কাটাচ্ছে তারা। তাদের কাছে কোন মজুদ খাবার নেই। এখানে রান্না করে খাবার মতো কোন পরিবেশ নেই। বন্যাকবলিত মানুষরা শুকনো খাবার চায়। রৌমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম সালু জানান, তিনি নিজে এবং ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারসহ প্রতিরাতে ডিসি রোড, বাঘমারা বাঁধের রাস্তা, কলেজ রোড পাহাড়া দিচ্ছেন। যাতে জনগণের কোন যানমালের ক্ষতি না হয়। তিনি আরও জানান তার ৬টি ইউনিয়ন এখন পানিতে ভাসছে প্রথম দফায় মাত্র ৪শ’ ৫০ জনকে এবং দ্বিতীয় দফায় ৬শ’ জনকে দেয়ার জন্য মাত্র মেঃ টঃ চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। সরকারের নির্দেশনা ১০ কেজি করে বিতরণের নিয়ম থাকলেও তিনি ৫ কেজি করে বিতরণ করেছেন ২ হাজার পরিবারকে। বৃহস্পতিবার ব্রহ্মপুত্র নদের পানি আরও বেড়েছে। এতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। দুটি উপজেলায় বিভিন্ন গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত। ঘরের চালে অথবা মাচার ওপর আশ্রয় নেয়া অনেক পরিবার বসে ছিল ত্রাণ সামগ্রীর আশায়। খুব সীমিত আকারে কেউ কেউ কিছু ত্রাণসামগ্রী পেলেও অধিকাংশ পানিবন্দী মানুষ কোন ত্রাণ পায়নি। বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নৌকায় করে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে আনছে অনেক পরিবার। পথ ঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ায় নি¤œ আয়ের শ্রমজীবী এবং চাকরিজীবী অনেক মানুষ কর্মস্থলে যেতে পারছে না। রাজীবপুরের বিভিন্ন দুর্গম গ্রামে নৌকার অভাবে অনেক পানিবন্দী পরিবারও সরে আসতে পারছে না এরা খোলা আকাশের নিচে ঘরের চালায় রাত কাটাচ্ছে। কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী-রাজীবপুর) আসনের সংসদ সদস্য মোঃ রুহুল আমিন জানান রৌমারী রাজীবপুর এলাকায় বন্যার ভয়াবহ অবস্থা চলছে। চরম খাদ্য সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছে বন্যাকবলিত মানুষ। ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে যাদুরচরে সোনাপুর এলাকায় বাঁধ ভেঙে গেছে। দুদিনে রাজীবপুরে নাওঠেলা ও মোহনগঞ্জ আশ্রয়ণকেন্দ্রে ৪শ’ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এ সব মানুষ চরম খাদ্য কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তিনি রৌমারী ও রাজীবপুর এলাকায় দ্রুত আরও ব্যাপকভাবে ত্রাণ পাঠানোর দাবি জানান। ত্রাণ চাই না ॥ হামরা বাঁধ চাই তাহমিন হক ববী, তিস্তার চরখড়িবাড়ি থেকে ফিরে ॥ তিস্তাপাড়ের চরখড়িবাড়ি ও পূর্বখড়িবাড়ি মৌজার ১২টি গ্রামের ২২শ’ পরিবার ত্রাণ চায় না। তারা চায় বাঁধ। এই বাঁধ হলে তারা ফিরে পাবে গ্রামের অস্তিত্ব। চরম বন্যা ও ভাঙনে সব হারিয়েও এই এলাকার মানুষজন তাদের মনোবল হারায়নি। ত্রাণ নয় বাঁধ চাই দাবিতে এলাকার সকলের মুখে মুখে ফিরছে। টানা ১৮দিন ধরে নদীর গতি পথ পাল্টে যাওয়ায় তিস্তার ঢলের পানি এখনও ওই সব গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আট বিঘা আবাদী জমি ও বসতভিটা হারিয়ে তিস্তা নদীর ডানতীরের চেয়ারম্যানপাড়া গ্রোয়েন বাঁধে পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিস্তাপাড়ের ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ির পূর্বখড়িবাড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মিয়ার উদ্দিন (৬৮)। তিনি ওই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। শুক্রবার দুপুরে তার সঙ্গে কথা হয় তিস্তার বাঁধে। তিনি জানান হঠাৎ করে তিস্তা নদীর গাতিপথ পাল্টে গিয়ে সবকিছু সর্বনাশ করে দিল। চড়খড়িবাড়ি- পূর্বখড়িবাড়ি-পূর্ব টাপুর চর-জিঞ্জিরপাড়া-পশ্চিম টাপুর চর-মেহেরটারী-বাংলাপাড়া-ডাঙ্গাপাড়া-বাবুপাড়া-একতারবাজার গ্রাম-মুন্সীপাড়া ও হায়দার পাড়াসহ ১২টি গ্রাম নিমিষেই তিস্তা ল-ভ- করে দিয়েছে। তিস্তা বন্যা ও ভাঙনে ওই সব এলাকার এগারোশ’ পরিবার নিঃস্ব। এখনও বানের হাঁটুপানির ভেতর বসবাস করছে গ্রামে আরও এগারো শ’ পরিবার। তিস্তাপাড়ের ডান তীর বাঁধের ৬টি স্থানে ১১শ’ পরিবারের সাড়ে ৫ হাজার সদস্য আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রেরিত প্যাকেজ ত্রাণ বিতরণ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম ও টেপাখড়িবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন। প্যাকেজ ত্রাণের মধ্যে ছিল ৫ কেজি করে চাল, এক কেজি করে চিনি, লবণ, ডাল, মুড়ি চিড়া, মোমবাতি, দিয়াশলাই ও এক লিটার করে সয়াবিন তেল। এছাড়া জেলা প্রশাসনের খয়রাতি চাল ১০ কেজি করে এবং নগদ ৫০০ টাকা। শুধু বাঁধে আশ্রিত নয় এখনও যারা পানিবন্দী পরিবার রয়েছে তাদের কাছে নৌকাযোগে সেই ত্রাণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। তিস্তা বাঁধে বিশুদ্ধ পানির জন্য ১৩টি নলকূপ ও ৩০টি স্যানিটেশন ল্যাট্রিনও স্থাপন করে দিয়েছে প্রশাসন। এ ছাড়া সার্বক্ষণিকভাবে মেডিকেল টিম ও প্রাণি সম্পদ টিম কাজ করছে। এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন এই মুহূর্তে করার কিছু নেই। তবে বন্যা থেমে গেলে সেখানে কিভাবে একটি বাঁধ নির্মাণ করা যায় সেটি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
×