ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লরাদশা জামাল রেজা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৯ জুলাই ২০১৬

লরাদশা জামাল রেজা

বিষ উঠছে নিশি রাইতে। এহন বেলা দুইফর। মাগির বিয়ানের নাম নাই। খালি চিক্কুরের পর চিক্কুর পারে। কথাগুলো বলে বিড়ি টেনে ফুস করে ধোঁয়া ছাড়ে ফইজু কালার মায়ের মুখ বরাবর। বুড়ি তাতে রাগ করে না। বরং বিষয়টা বুঝবার চেষ্টা করে। মাঝারি গোছের একটা নিয়াস কেটে বলে, লতুর বউ কইলাম দুইদিন দুই রাইত কোঁকাইয়া হেসে মরা বাচ্চা জরমো দিছিল। সেই জন্যই কই কি -তুই এক কাম কর। কি কাম? বউরে নিয়া শিবপুর যা। বড় ডাক্তার দেখা। আমি তোর বউয়ের আওবাও ভালা দেখতাছি না। দরকার হইলে নসুন্দি পাটা। কালার মায়ের মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে ফইজু। তামাটে রঙের চোখজোড়া তার তখন যেন আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। নিশ্বাস-প্রশ্বাসে তার চওড়া বুকটা ওঠানামা করে চিনাদী বিলের বড় কাছিমের মতো করে। কিরে ফইজু-কি কইলাম বুঝছচ? কালার মা আবারও প্রশ্ন তোলে। কিন্তু কথার পিঠে কথা কাটে না ফইজু। রাজ্যের চিন্তা যেন তার ওপর ভর করে তখন। ধপ করে বারান্দায় বসে পড়ে সে। খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে। কালার মাও পিঁড়ি টেনে বসে ফাইজুর পাশে। আলতো করে বলে, বেশি চিন্তা করিস না। আল্লায় বেবেস্থা একটা করবোই। ভেজা হাঁসের মতো গা ঝারা দিয়ে ফইজু চোখ মেলে তাকায়। হাতের বিড়িটা ঠোঁটে চেপে ধরে টানের পর টান মারে। ধোঁয়া ছাড়ে নাকে-মুখে সমানে। এরপর বিড়ির মোথাটা ছুড়ে মারে মাঝ উঠানে। খুইব ভাইঙ্গা পড়লি মুনে হয়? প্রশ্নটা কালার মায়ের। অন্যদিকে রা করে না ফইজু। তর কি মুন কয় আমার তদবিরে খালাস পাইবো তর বউ? আবারো প্রশ্ন করে কালার মা। তখনও কথা বলে না ফইজু। চোখ ফিরিয়ে তাকায় শুধু কালার মায়ের দিকে। কি যেন বলতে চায় সে। কি রে কিছু কইবি? না, গেলে আঁডা ধরো। তাইলে ল যাই। ইল্লায় বাল্লা দূর হয়। তয় একটু খারা, আমি একটা পান মুখে দিয়া লই। পান আমগো বাড়িত গিয়া খাইও। খাইল্লা বাইতে রাইখা আইছি হেইরে। কালার মা পান খেতে ঘরে যেতে পারে না। ফইজু চট করে উঠে গিয়ে কালার মায়ের ঘরের দরজা টেনে বেন্দা আটকায়। সঙ্গে সঙ্গেই-হু শব্দ করে ফইজু হাঁটা ধরে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল তখন। বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে কাক ডাকা ভোর থেকেই। ছাড়ার কোন নাম গন্ধ নেই। টিপটিপানি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আইলপথ ধরে হাঁটতে থাকে দু’জন মানুষ। বৃষ্টির সঙ্গে তিরতির ধরনের বাতাস বইছে কিছুক্ষণ ধরে। কালার মায়ের তাতে বুঝি কিছুটা শীতেই পেয়ে বসে। শাড়ির আঁচলটা চাদরের মতো করেই টানটান করে শরীরে চাপটে ধরে বুড়ি। ছইদার ভিটার মোড় ঘুরে দাঁড়ায় ফইজু। কালার মা তার দিকে তাকিয়ে বলে, কলগাছের রহম খারাইয়া পড়লি ক্যান? কিছু কইবি? মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানায় ফইজু। ক তাইলে দাদি একদিন আর এক রাইতের বেদনায়ও কি মরা বাচ্চা পয়দা হইতে পারে? এই জিজ্ঞাসা ক্যান তর মুনে? এমনি। আল্লাহ তাল্লার হিসাব কিতাবের কথা বইলা শেষ করণ যায় না। তার রহমত থাকলে কোন বিপদই বিপদ না। আর বাও বাতাস উল্টা বইলে শত বৈঠা দিয়াও মাঝি কূল-কিনারা খুঁইজা পায় না। তোমার কথার কোন আগা মাথা বুঝলাম না দাদি। এত কিছু বুঝনের কাম নাই হাঁটা ধর। আর মনে মনে আল্লাহরে ডাক। তর বউ বাচ্চা যেন ছহি ছালামতে খালাস পায় সেই দোয়া কর। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে কি যেন বলতে বলতে আবারও হাঁটতে শুরু করে ফইজু। ধর ধর করে পা ফেলে আইলে। মনে হয় শরীরের ভারে আইল বুঝি ভাঙ্গি ফাটা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আইলের কিনারে বসে থাকা একটা কটি ব্যাঙ পিচ শব্দে ফইজুর পায়ে মুতে দিয়ে লাফিয়ে পড়ে রোয়া ক্ষেতে। ফইজু সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, সুযোগ পাইছস তাই না? হাতে সময় থাকলে তরে এহন ধইরা থোকনাইয়া মারতাম। বসন্তের ছন্নছাড়া বাতাসের মতোই এলোপাতাড়ি বাতাস বইতে শুরু করেছে। রোয়া ক্ষেত থেকে ম্যাগো ম্যাগো রবে ডাক তুলেছে ব্যাঙের দল। ফইজু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে আধভেজা কালার মার ঠোঁট নীল হয়ে গেছে। শীতে কি কাবু হয়ে গেল বুড়ি? কুসুমের কাছে পৌঁছানোর আগেই কি বুড়ি শর্দ হয়ে যাবে? অনেক আদরের বউ এই কুসুম। বাসর রাতে বাতি নিভিয়ে চাঁদমুখ দেখেছিল সে চাঁদের আলোতে। চাক ভাঙা মধুর মতোই নির্ভেজাল প্রেম সে দিয়েছিল কুসুমকে। মুচকি হেসে কুসুমও বলেছিল, পাগল হইয়া যে আমারে বিয়া করলেন, কন তো কোন্দিন আপনের চোখে পরথম পরলাম আমি? স্ত্রীকে বাহুডোরে নিয়ে ফইজু বলেছিল, মিয়াগো বাগের ক্ষেতে কাম করতে গিয়া আমবর্তা বানানের লাইগা নুন চাইতে গেছিলাম তোমগো বাইতে, হেই কথা মনে আছে তোমার? তুমি নুনের বাটি আগাইয়া দিয়া গালে হাইসা কইছিলা পুরুষ মানুষ হইয়া এত চুক্কা খান কি কারণে? আমিই তো আম পইল্লা বর্তা বানাই দিছিলাম। কন দেই নাই? হ। কাঁচের চুড়ি ভরা হাতে যখন আমবর্তা মাখাইতাছিলা তখনই আমার ভিতরটাতেও ঝন ঝন কইরা বাইজা উঠছিল তোমার হাতের রেশমি চুড়ি। ফইজু রে... জলদি আগুন দে। কালার মার ডাকে সম্বি^ত ফিরে পায় ফইজু। দেখে বাড়ির উঠানে এসে পড়েছে তারা। পশ্চিমের ঘর থেকে কুসুমের গোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল তখন। দাদি আগে তুমি ঘরে যাও। তোমার লাইগা আইল্লায় কইরা আগুন দিতেছি আমি, দেইখো তোমার শীত এহনই পলাইবো। দরজার ব্যাং খুলে দেয় ফইজু। ঘরের কোণে কুসুমকে গড়াগড়ি করতে দেখেও না দেখার ভান করে দরজা আটকায় সে। মনে মনে তার একটা প্রশ্ন প্রকট আকার ধারণ করে। ‘লতুর বউয়ের মতো কুসুম কি মরা বাচ্চা বিয়াইবো?’ বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে উঠানে নামে ফইজু। আকাশ আরও ঘনকালো হয়ে আসছে ততক্ষণে। শ্রাবণের কুশলী বৃষ্টি নামবে নাকি এখনই কে বলবে! ঘন কালো মেঘের নিচে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ওড়াউড়ি দেখে তো মনে হয় কালবৈশাখীর ঝড়ও বুঝি ছুটবে এখন। চারদিকে নীরব নিস্তব্ধ। পলার বউ ছোট মেয়েটাকে মটকিলা গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে পেটাতে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা পলার বউয়ের খাড়া বুক ফইজুকে লোভাতুর করে তোলে পলকেই। পরস্ত্রীর দিকে কুদৃষ্টি দেয়া যে পাপ কাজ সেটা এখন আর মনে হয় না তার। অথচ মাতবরের পোলা বিজুকে সুযোগ পেলেই এক কোপে দুইভাগ করার পরিকল্পনা জিইয়ে চলেছে বছর দুই ধরে। কুসুমের সঙ্গে নিজ চক্ষে বিজুকে কাতুকুতু খেলতে দেখছে সে। সন্দেহ তার মনে দানা বাঁধলেও কুসুমের প্রেমের কাছে বারবারই হার মেনেছে ফইজু। নাগর ধরা মাইয়া মানুষ সোয়ামীরে এত ভালোবাসে কোনকালে? আদরে যতনে- প্রেমে টইটুম্বুর করেই তো রেখেছে কুসুম ফইজুকে! ফইজুর উঠানে নেমে পড়েছে মেঘদল। হাত দিয়ে যেন ছোঁয়া যায় সে সব, অন্ধকারও বুঝি ঢেকে ফেলেছে তার চারপাশটা। বুবুর মুখটা মনে পড়ছে ফইজুর তখনই। শেষের বাচ্চাটা জন্ম দিতে গিয়ে গত ফাগুনে বুবু মারা গেল। বছর না ঘুরতেই আবার নিজের বউ পড়েছে একই দুর্যোগে। এমন বৃষ্টির দিনে বুবুর হাতের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংসের স্বাদ লেগে আছে তার মুখে। কুসুম কোন কালেও ফইজুর খাওন-লওন নিয়ে ভাবে নাই। কথাও বলে নাই তেমন করে। তবে খইফোটা হাসি হেসে সঙ্গমের তৃপ্তি প্রকাশ করেছে প্রায় সময়ই। সবল সোয়ামী যে নারী জাতির আগাগোড়াই পছন্দ সেই কথাও জেনেছে ফইজু কুসুমের মুখ থেকেই। সন্তানাদি হয় না বলে কুসুমকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ফইজু। কিন্তু কুসুমের অপরিসীম প্রেমই ফইজুকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। এত কিছুর পর যে সন্তান আসলো কুসুমের পেটে, সেই সন্তান নিয়া এতো লরাদশা ক্যান? ঠাস শব্দে দরজা খোলে কালার মা। শব্দ পেয়ে চট করে ঘুরে তাকায় ফইজু। বুড়ি তখন ফিসফিস ধরনের শব্দ তুলে মুখে। ঐ ফইজু তর বউ কইলাম উলডা টান শুরু করছে। খুব বেবাও দেখতেছি আমি। জলদি কইরা শিবপুর হাসপাতালে পাডানের বেবস্থা নে। কেরমে করমেই তর বউ থির হইয়া পরতাছে কইলাম। নিথর মানুষেরে কেমনে নিমু দাদি? আফির ভ্যান ভাড়া কর। আমি অ যামু তর সঙ্গে। জলদি দৌড় লাগা। আরে হারামজাদা থ মাইরা খারাইয়া রইলি ক্যান? পাও চালা। কোরচে বসা গলা ছিলা মুরগীটা কর কর ধরনের শব্দ করে উচড়া থেকে ঘরের দিকে যাচ্ছে। ফইজু যাই বলে পা বাড়ালো সামনে। হিন্দু পাড়ার দিক থেকে ভেসে এলো উলুধ্বনি। জগার বউয়ের কনকইন্না গলাটা ফইজুর কানে যেন বিঁধে যায়। দিক করিছ না, জলদি আইবি কইলাম। বলে কালার মা। দশ মিনিটের মধ্যেই আমি আইসা পরতাছি। এ কথা বলে ধপ ধপ পায়ে উঠান কাটে ফইজু। কালার মা উঠানে নামে। শঙ্খধ্বনি কানে বাজে। পর মুহূর্তেই আজানের ধ্বনিও শুনতে পায় বুড়ি। সইন্ধ্যা নাইমা আইলো তাইলে? মনে মনে ভাবে কালার মা। ঘরে যায়। কুপি বাত্তি জ্বালায়। ফইজুর বউ কোর্চের মুরগির মতোই কু কু শব্দ করে। সেই শব্দটাও ক্লান্ত। এখনই যাবে বুঝি দম। কুপি হাতে বুড়ি এগোয় ফইজুর বউয়ের কাছে। বিড়বিড় করে বলে, ঐ ছেরি পেডেরটার লড়াচড়ার শব্দ কি পাস না তুই? ফইজুর বউ কথা বলে না। পেটে হাত দেয় বুড়ি। বাচ্চার লাফানো টের পায় কালার মা। আনমনেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে বুড়ি। কুপি রেখে কালার বউয়ের মাথাটা কোলে তুলে নেয়। অস্ফূটে বলে, সইন্ধ্যা হইছে। একটু উইঠা ব। আর শোন, এমন ঝিম মাইরা পইড়া থাকিস না, আল্লা বিল্লা কর, পড়তে শুরু কর দোয়া ইনুস। দেখবি-যার গজব সে-ই আছান দিব। কথা বলে না কুসুম। তবে কোঁকানোটা আছে। গতিটা ধীর। কালার মার ভয় বাড়তে থাকে। ফইজুও বাড়িত নাই। কি হইতে কি হয় কে জানে? ফইজুর বউ একটু পানি খাবি, পানি? বলে কালার মা। কথা বলে না কুসুম। এরপর আনমনে নিজেকেই বুঝি বলতে থাকে কালার মা, নিদানে আল্লাই সম্বল। ফইজুরে আফির বাড়িত পাঠাইছি। ভ্যান গাড়িডা পাইলে এখনই তরে নিয়া রওনা দিমু। একবার শিবপুর যাইয়া পৌঁছাইতে পারলে আর চিন্তা নাই। সিজার কইরা হইলেও তরে আছান দিব। পইখ পাল্লা আর গরু বাছুরের বেলায় কোন ঝামেলা নাই। গরু একলা একলাই বিয়ায়, আবার বাছুরও দুই তিনডা তাউরাইন দিয়া উইঠা ছুটে। ফোকলা দাঁতে কালার মা হাসে। পরমুহূর্তেই ভাবে এই কথার পরে হাসাডা কি ঠিক? হুড়মুড় করে কি যেন পড়ার শব্দ হলো বাইরে। কালার মা গলা বাড়াল। ধপাস ধপাস শব্দে দরজা বারি খেলো। চেয়ে দেখে বাইরে ঝড় ছুটেছে। দরজা বন্ধ করার জন্য উঠতে উঠতে কুপি বাতিটাও নিভে যায়। কালার মা অভিশাপ দেবার মতো করে বলে, ‘মরার বাতাস আর সুময় পাইল না। গজব নামচে, গজব।’ অন্যদিকে ফইজু ভ্যানগাড়ি পেলেও-চালক আফিজুদ্দিকে পেল না। নিজেই ভ্যান ঠেলে নিয়ে এলো বাড়ি। বৃষ্টি ততক্ষণে বেড়ে গেছে। আকাশজুড়েও উঠেছে গুম গুম একটা শব্দ। পশ্চিমাকাশটার রংও কেমন জানি আগুন বরণ ধারণ করেছে। ভ্যান উঠানের কোনে ব্রেক ঠেকিয়ে রেখে হুড়মুড় করে ঘরে গেল ফইজু। কলার মা তাকে দেখে আর্তনাদের সুরে বলল, সর্বনাশ হইছেরে ফইজু। তর বউয়ের জবান বন হইয়া গেছে। ফইজু আর কাল বিলম্ব করে না। হাঁঠুগেড়ে বসে স্ত্রীর মুখের কাছে। মাথায় হাত দিয়ে বলে বউ... বউ ... কুসুম, তুই তাকা। আর চিন্তার কিছু নাই। তরে নিয়া শিবপুর যাইতাছি। বড় ডাক্তার দেখামু। প্রয়জুন হইলে অপারেশন করামু। জমি বান্দা থুমু। দরকার হইলে বেচমু। তুই চোখ মেইল্লা তাকা বউ। আমি তোর স্বামী ফইজু। তর লাইগা আমি জীবন দিতে পারি। বউ তুই তাকা...। এরপর হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে ফইজু। কালার মা এসে তার মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলে, কান্দাকাটি বন্ধ কইরা বউরে নিয়া জলদি কইরা ভ্যানে তোল। লইয়া চল শিবপুর। হ দাদি তাই করুম। তুমি কার থেইকা ছাতিডা লও। আর খেতা, বালিশ, পানির জগ গেলাস এসব লইয়া আসো। আমি হেইরে গাড়িতে তুলতেছি। ফইজু কুসুমকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে উঠায় ভ্যান গাড়িতে। গামছা দিয়ে ঢাকে স্ত্রীর মুখ। বৃষ্টির ফোটা পড়া কুসুমের মুখ শিশিরভেজা পদ্মফুলের মতই দেখাচ্ছিল তখন। গাল থেকে গামছার কোনা দিয়ে পানি মুছে দিতে দিতে চুমু খায় ফইজু। বিড়বিড় করে বলে, ডরের কিছু নাই। বউ, তরে আমি সারাইয়া তুলুমই। এরই মধ্যে কালার মা ছাতা নিয়ে এসে উঠে বসে ভ্যান গাড়িতে। টর্চ লাইটটা বুড়ির হাতে দেয় ফইজু। কোমরে কষে বাঁধে গামছা। তার লোমশ বুক থেকে কামারের হাঁপরের মতোই বেরিয়ে আসে একটা ভারি নিশ্বাস। সবটুকু রেশ ছেড়ে সে বলে, দাদি তুমি কইলাম লাইট টিপতে থাইকো, আল্লাহর নাম নিয়া রওনা দিলাম। রওনা যে দিলি, চালাইতে পারসতো ভ্যান? পারি গো দাদি, পারি। আমি বেবাকই পাড়ি। ডরাইও না। আমার বউডারে ধইরা রাইখো তুমি। ভ্যান টেনে স্পিড উঠিয়ে সিটে চড়ে বসে ফইজু। তারপর প্যাডেলে ভর দিতে শুরু করে সে, দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে ভ্যানগাড়ি। কালার মা পড়তে থাকে দোয়া-দরুদ। শিবপুর উপজেলা হাসপাতালে ফইজুরা যখন পৌঁছে তখন রাত সাড়ে নয়টা। তিনজনের শরীরই ভিজে চুপচুপা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। কালার মায়ের ঠোট জোড়া থিরথির করে কাঁপতে শুরু করেছে। এই বুড়িই একমাত্র বিপদের সঙ্গি তার। জবুথবু বুড়ি পোঁটলাপুঁটলি সব নিয়ে চলে যায় হাসপাতালের ভেতরে। নার্সরা ট্রেসার টেনে কুসুমকে তুলে নিমিষেই নিয়ে যায় উত্তর দিকে। ফইজু পা বাড়ালেও তাকে বাধা দেয় এক অল্পবয়সী নার্স। বলে, আপনি আসবেন না। ফাইজুর মার দিকে ইঙ্গিত করে বলে অনাকে ওটি রুমের দিকে পাঠান। কুসুমকে নিয়ে চলে যাবার পর ফইজুর বুকটা হু হু করে উঠল। নিজেকে খুবই একা ঠেকল তখন। সত্যিকার অর্থে প্রতিটা মানুষই তো একা। তবে ফইজুর একাকিত্বটা অন্যের তুলনায় একটু বেশি গাঢ়। বেনু শেখের বাড়িতে বেড়ে ওঠা ছেলে সে। মা মারা গেছে শৈশবেই। আবার বাবার কথাও তার মনে নেই। মা কাজ করতো বেনু শেখের বাড়িতে। বেনু শেখ আর ফইজুর মাকে নিয়ে গ্রামজুড়ে কিছু আজেবাজে কথাও রটে আছে। তবে সত্য হচ্ছে, বেনু শেখের দেয়া দুই কানি জমি আর বাড়ি ভিটাটাই ফইজুর সম্পদ। একাল সেকাল কোন কালেই তার যেন কোন কিছুই নেই। পেছন ফিরে কাউকেই দেখতেও পায় না সে। ছোট কালে জোয়ারের জলে ভেসে গেলে কি ক্ষতি হতো কার? কেন বেহায়ার মতো বেঁচে আছে সে? কুসুম এসেও বিড়ম্বনা করছে কেন জীবনে? হাজারো প্রশ্নের ভিড়ে দিশেহারা ফইজু। হাসপাতালের রেলিং চেপে ধরে বসা ফইজুর মুখ বৃষ্টির ফোটায় ভিজে যায় কাগজের মতো করে। ক্রমেই নেতিয়ে আসে তার চোখ মুখ। জগত সংসারকে লাথি মারতে ইচ্ছে করে তার। শুধু মনে পড়ে মায়ের মুখটা। সেই মুখটা অজলায় তুলে বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা, ওমা ক্যান তুই আমারে জগতে আনলি? আর আনলিই যখন-তখন আবার দোযখের আগুনে ফেলাইয়া চইলা গেলি ক্যান?’ রাত পেরিয়ে ভোর সোয়া পাঁচটায় এক পুত্র সন্তান প্রসব করে কুসুম। সিজারিয়ানের প্রয়োজন হয়নি। ডাক্তার রওশন আরার হাতেই জন্ম নেয় বাচ্চা। তবে সন্তান প্রসবের পর সেই যে রক্ত ভাঙা শুরু হলো তা বন্ধের নাম নেই। কুসুমই ফিস ফিস করে ডাকল স্বামীকে। ফইজু পুত্রের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত হলেও কুসুমের দিকে তাকিয়ে নেতিয়ে পড়ল। কুসুম তাকে হাত ইশারায় পাশে নিয়ে বসালো, কালার মা তখন নবজাতকের যতেœ মশগুল। কুসুম স্বামীর ডান হাতটা খামছে ধরলো কিছুটা শক্ত করে। ফইজু স্ত্রীর মাথায় রাখল বাম হাতটা। অস্ফুটে বলল, বউ আমাগো পোলা হইছে। সঙ্গে সঙ্গেই কুসুম মাথা ঝাঁকিয়ে না বললো। এরপর নড়ে উঠল কুসুমের ঠোঁট জোড়া, ‘আমারে আফনে মাফ কইরা দিয়েন। এই পোলাডা আসলে আপনের না।’ মুহূর্তের মধ্যেই কুসুমের হাত নিথর হয়ে পড়লো। কুসুম নেই। ফইজুর মাথায় যেন ভেঙে পড়ল সাত আসমান। অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। ফইজুকে ঘিরে বেজে উঠল অচেনা এক সুর। সেই সুর ছাপিয়ে নবজাতকের কান্নাও বুঝি বাড়ি খেলো তার কানে। তবে কোনোটাই আর ফাইজুকে ধরে রাখতে পারল না। কিংবা কে বলবে ফইজু কোন ফাঁকে ফসলের মাঠে ভিজছিল বৃষ্টির জলে? ফইজু চোখ খুলল। বৃষ্টি তার চারপাশে। মাঠে আর কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। শুধু বৃষ্টি এবং ফইজু। তার দু’পায়ের পাতাই তলিয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টির টলটলে জলে। এই জলেই মাছ উজান বায়!!
×