ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বীরেন মুখার্জী

প্রেমিক ও বিপ্লবী

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৯ জুলাই ২০১৬

প্রেমিক ও বিপ্লবী

ষাটের সময়পর্বের অন্যতম কাব্যযোদ্ধার নাম কবি মহাদেব সাহা। অনেকটা অন্তর্মুখী ও নিম্নকণ্ঠের এই কবির কবিতার মূল স্বর মূলত প্রেম, প্রকৃতি, নারী ও বিপ্লবনির্ভর। আর দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে আসে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও তার অভিঘাতে সৃষ্ট সমাজ বাস্তবতা। মিতভাষী এই কবি নিম্নস্বরে অবিরত লিখে যাচ্ছেন পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতা। তার কবিতায় নগর বাস্তবতা যেমন হাতছানি দেয় তেমনিভাবে বিপ্লবী চেতনা জাগিয়ে তোলে। ‘প্রেম’ বিষয়টি তার কবিতায় জোরালো হলেও ব্যঞ্জনাটি বহুমাত্রিক। তার প্রেম কখনো প্রেয়সীর প্রতি, কখনো নিজ জীবনের প্রতি, আবার কখনো বা জাতির প্রতি। কবিতায় যেমন তিনি সৃষ্টি করেছেন পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্ব, তেমনি নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়েও বার বার হয়েছেন দ্বিধান্বিত। ব্যক্তিক উক্তি যেমন করেছেন, তেমনি করেছেন মনোজাগতিক বিশ্লেষণ। আবার বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদদের মতোই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দেশের, বিশ্বের, আপামর জনতার শঙ্কিত অবস্থা নিয়ে। তাই মহাদেব সাহার কবিতাকে কোন একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ সমীচীন নয়। মহাদেব সাহা যুগের অসুখকে ধারণ করেও এক যুগোত্তরের স্বপ্ন দেখেন। তিনি কবিতায় মূর্ত করেছেন মানুষের চিরায়ত জীবনকে। রোমান্টিক আবহে নিজেরই সৃষ্ট ভুবনে নিজেকে আবিষ্কার করে বিভোর কবি রচনা করে চলেছেন প্রেম, জীবন, সমাজ আর নিজস্ব দর্শন। মানবের চিরায়ত প্রেমের পাশাপাশি তিনি রক্তে ধারণ করেন বিপ্লবের আকাক্সক্ষাÑ ‘তার চেয়ে আমাদের ফিরে দাও রাজবংশ, রাজকীয় অলীক বিশ্বাস রাজকুমার তোমার রক্তে জন্ম নিক জান্তব যৌবন, যুদ্ধ করে মরি।’ (ফিরে দাও রাজবংশ) কিংবা, ‘তাই এই কবিতার অক্ষরগুলো লাল, সঙ্গত কারণেই লাল আর কোন রঙ তার হতেই পারে নাÑ অন্য কোন বিষয়ও নয় তাই আর কতবার বলব জুঁইফুলের চেয়ে সাদা ভাতই অধিক সুন্দর!’ (জুঁইফুলের চেয়ে সাদা ভাতই অধিক সুন্দর) ‘ফিরে দাও রাজবংশ’ কবিতায় তিনি যুদ্ধ করে বাঁচার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। ‘জুঁইফুলের চেয়ে সাদা ভাতই অধিক সুন্দর’ কবিতার ‘লাল’ হচ্ছে বিপ্লবের প্রতীক। মহাদেব সাহার কবিতার স্বর উচ্চগ্রামে বাঁধা না হলেও পাঠক বুঝতে পারে এই কবিতার চেতনাপ্রবাহে খেলা করে শোষিতের আর্তনাদ। ‘সাদা ভাত’ রূপকটি সুকান্তের ‘ঝলসানো রুটি’র মতোই উজ্জ্বল ও হৃদয়গ্রাহী। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি রাজনৈতিক অনুষঙ্গ ষাটের সময়পর্বকে অনেক বেশি যন্ত্রণাবিদ্ধ করে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে সাহিত্যাঙ্গনে। ষাটের অন্যতম এই কবির কবিতায়ও বিধ্বস্ত ও অস্থির যুগবৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি হৃদচেতনার সূক্ষ্ম অনুভূতি স্পর্শ। তিনি রোমান্টিকতার প্রচলিত ধারা ও চল্লিশীয় ধারাকে নস্যাৎ করে তৈরি করেন অন্য এক রোমান্টিক দর্শন। দর্শনচর্চার সঙ্গে কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকেও আনেন প্রভূত পরিবর্তন। এই নিরীক্ষার ফলাফল বহুমাত্রিক, কবিতায় গদ্য ও লিরিক সমাদৃত হয়, দীর্ঘ কবিতার যেমন জন্ম হয়, তেমনি চার লাইনেও কবিতা শেষ হতে দেখা যায়। কবিতায় ব্যবহৃত প্রতীক ও চিত্রকল্পগুলোতে তৈরি হয় মূর্ত-বিমূর্তের সন্নিবেশ। রোমান্টিকতার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্যÑ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও কল্পনাপ্রতিভা। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মূল হচ্ছে অহম বা আত্মবোধ। এটি এমন একটি বোধ যাতে ব্যক্তিই হবে আলোচ্য। যেন ব্যক্তি সূর্য আর বাকি সবকিছু গ্রহ-উপগ্রহের মতো তার চারপাশে আবর্তিত। আর তাই রোমান্টিক কবিদের বোধের রঙে পান্না হয় সবুজ আর চুনি হয়ে ওঠে লাল। মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী সমাজের কবিতায় সমাজের প্রতি মানুষের নতিস্বীকার লক্ষণীয়। কিন্তু আধুনিক রোমান্টিকতায় মানুষই বড়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে দেয় স্বাধীনতা। তাই রোমান্টিক কবি বাহ্য জগতে আশ্রয় না খুঁজে, যুক্তি-শৃঙ্খলার আশ্রয় না নিয়ে শরণ খোঁজেন নিজেরেই মনোবিশ্ব ও কল্পনা প্রতিভার মধ্যে। অস্থিরতা তার নিত্যসঙ্গী, এক অদৃশ্য আগুন তাকে সর্বদা দগ্ধ করে। রোমান্টিকতার অপর বৈশিষ্ট্য কল্পনাপ্রতিভা। রোমান্টিক কবিরা বড়বেশি কাল্পিক হয়ে থাকেন। এই কল্পনাপ্রতিভা দিয়ে তারা সৃষ্টি করেন তাদের আপন বিশ্বলোক। যার ভিত্তি অহমিকা, যেখানে থাকে কেবল ব্যক্তি-অহমের আবেগ অনুভূতিবোধ। ষাটের সময়পর্বের অন্যতম কবি মহাদেব সাহার কবিতায় ব্যক্তি-অহম, আবেগ অনুভূতিবোধের পারম্পর্য লক্ষ্য করা যায়। মানবচিত্তে নৈঃসঙ্গ্যচেতনা সৃষ্টির পশ্চাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ। আধুনিক সভ্য সমাজের তীক্ষè ও দ্রুত সংক্রমণে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব, বৈপরীত্য, সংঘর্ষ সবকিছু একই কক্ষপথে আবর্তনরত মানুষগুলোকে সমচুম্বকীয় টানের মতো পরস্পর থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দেয়। দৃশ্য কিন্তু অস্পৃশ্য এই মানুষগুলো তখন সৃষ্টি করে বেদনা ও মিলনের আকাক্সক্ষা। ফলে তখন সেই বেদনা দূরীভূত না হলে এবং মিলন সফল না হলে মানুষ ভোগে হতাশায়, আক্রমণ করে একাকিত্ব, নৈঃসঙ্গ। আর তখনই দেখা দেয় লুকিয়ে যাওয়ার, পাশ এড়ানোর প্রবণতা। রোমান্টিক চেতনার অন্যতম প্রতিভাস এই নিঃসঙ্গতা, যা থেকে জন্মায় পলায়নপর মনোভাব। কবি পালিয়ে যান নিজ থেকে, সমাজ থেকে। জীবন সংগ্রামে ব্যর্থতা, প্রণয়ে ব্যর্থতা, মানুষ হিসেবে ব্যর্থতা এই সব কিছু একটা সময় কবিচিত্তকে দুর্বল করে দেয় আর তা থেকেই কবি পালিয়ে বেড়ান। ‘শোকের শহরে আমি যার কাছে চাই ফুল, কিছু মনোরম শোভা,/যেসবের বিস্তৃত বর্ণনা আমি আপনাকে লিখতে পারি, সে আমার হাতে শুধু তুলে দেয় দুঃখের বিভিন্ন টিকিট।/...বুকে কাশি, অবিরাম জ্বর-আমার রুক্ষ চুলে বিলি কাটে/দুঃস্বপ্নের হাত,/এসব খবর কি দৈনন্দিন লেখা যায়। কি করে লিখব বলুন,/ঘরে একা দুঃসংবাদে কাঁদবে জননী। আজীবন লিখেছি,/তাই একই চিঠি, সেই মিথ্যে মর্মহীন একই চিঠি।’ কবি নিত্যদিনের ‘দুঃখের বিভিন্ন টিকেট’ হাতে নিয়েও মাকে লিখে যান মিথ্যে ভাল থাকার বৃত্তান্ত। পুুঁজিবাদী সমাজে অবক্ষয়ের সার্বিক কর্কটরোগে মানুষের পারিবারিক বন্ধন বিনষ্ট হয়েছে, ছিন্ন হয়ে গেছে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর, এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের সম্পর্কের সনাতন সেতুবন্ধ। সমস্যাসংকুল পারিবারিক জীবন ব্যক্তির কাছে হয়ে ওঠে দুঃসহ এবং এ অবস্থায় সে ভালবাসে একলা সময় কাটাতে; যে সমাজ তাকে শিখিয়েছে ‘অর্থ হলো প্রথম ঈশ্বর’। তারপর মানুষ একেবারে নিরস্ত্র হয় না, তাই কবি কামনা করেন নারীকে, নারীর ভাল লাগাকে, ভালবাসাকে, ‘মায়ের মতো ভাল’ নারীর আশীর্বাদকে এই কামনাতে তিনি লুকিয়ে রাখেন হৃদয়ক্ষত। ইচ্ছাকৃত নির্জন বিষাদ রচনা রোমান্টিক কবি মহাদেব সাহার চিরায়ত প্রবৃত্তি। তার কণ্ঠ নির্জন, অনেক বেশি অন্তর্মুখীÑ ‘আমি যাই, একা চলে যাই, শূন্য হাতে আনন্দ বিষাদে বর্ষারাতে ধূসর জ্যোৎস্নায় সব দুঃখ কখনো যায় না বলা, কখনো যায় না বলা’ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিতে খুঁজেছেন জীবন-নির্যাস, সত্যের সহজ সুন্দর প্রকাশ, আদি জন্মের সুর। জীবনানন্দ খুঁজেছেন প্রকৃতির আঁধারে জীবনের প্রতীতি, কখনো বা প্রতীক। আর মহাদেব সাহা খুঁজলেন ‘এক নিরিবিলি বকুল’ কে। কবির সাধনা প্রকৃতির মাঝে জীবন-প্রেমকে খোঁজা, কোন রূপক বা প্রতীক নয়, সরাসরি খোঁজা। তাই মহাদেব সাহা দেখেন শহরের বৃষ্টিতে আজ প্রিয়া নেই। এই নঞর্থক জীবনবোধই হলো প্রকৃতির হাসির আদলে অন্যকিছুÑ ‘এ শহরে বৃষ্টি এলে আমি ভেসে যাই কান্নার করুণ ভেলায় হাতে নিয়ে তোমার একদা দেয়া উপহারের গোপন গোলাপ’ মহাদেব সাহা নিসর্গ দিয়ে প্রকাশ করেছেন প্রিয়ার আলিঙ্গন-স্বাদ, কখনো জীবনের ব্যর্থতার হতাশ্বাস, আবার কখনো অতিলোকের কোন কথা। এই নিসর্গের স্বর্গানুভূতি হয়েছে কবির পলায়নপর মানসিকতার অন্যতম অবলম্বন। যেখানে নেই প্রিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, নেই কোন ঘাত-প্রতিঘাত। হতাশা, ব্যর্থতা, অপূর্ণতা কবি অকুণ্ঠচিত্তে প্রকাশ করেছেন নিসর্গের বর্ণনায়। ‘কবিতার জন্য আমি একযুগ কেঁদে ভাসিয়েছি, একযুগ কাটিয়েছি স্বেচ্ছানির্বাসনে আরো একযুগ বনবাসে; এই কবিতার জন্য আমি সব দুঃখ মাথা পেতে নিজেই নিয়েছি।’ (কবিতার জন্য আমি) পরিশেষে বলা যায়, মহাদেব সাহা যুগপৎ ‘প্রেমিক ও সন্ন্যাসী, প্রেমিক ও বিপ্লবী’। তিনি যাপিত জীবনের নান্দনিক আবেগ অনুভূতির মাননিক উপস্থাপনা করেছেন কবিতায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছে তার প্রেমিক ও বিপ্লবীসত্তা। যার উৎসস্থল কবিসত্তা, প্রকৃতি ও মানুষ।
×