ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নব্বইয়ের কবিতা ॥ মাতাল মধুগুঞ্জন সৌম্য সালেক

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৯ জুলাই ২০১৬

নব্বইয়ের কবিতা ॥ মাতাল মধুগুঞ্জন সৌম্য সালেক

এক. চিন্তা, কল্পনা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ যাবতীয় হৃদয়বৃত্তির সুনিপুণ বাক্মালাকে কবিতা বলা যায়। আবার শিল্পের এই উন্নত (ভড়ৎস) ধারাটি সম্পর্কে এর প্রধান অনুগামীদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত ও মন্তব্য। রোমান্টিক কাব্য প্রকরণের অন্যতম সারথী ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন- ‘কবিতা হলো সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ^াস আর সূক্ষ্ম আত্মা।’ এ্যারিস্টটলের মতেÑ ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ এস টি কোলরিজের মত হচ্ছেÑ ‘উৎকৃষ্ট শব্দের উৎকৃষ্ট পদবিন্যাসের নাম কবিতা।’ শিল্প ও দর্শন যাঁদের দৃষ্টি এবং উচ্চারণকে শাণিত করেছে আমরা তাঁদের প্রতিটি বার্তাকেই মহার্ঘ বলি এবং যে পর্যন্ত না নিজের অন্তরীণ-বোধ স্পষ্ট ভাষা পাচ্ছে ততক্ষণ নিশ্চুপ বনে যাব। কিন্তু লোকে যখন বলে, সে মতে আমাদেরও বলতে হয় তাই কিছুমাত্র বোধদয় থেকেই দুকথা বলে যাওয়া। কবিতা সময়ের প্রচ্ছন্ন বাক্মালা এবং কবি সময়ের প্রধান প্রতিনিধি। সময়ের সচলতার মধ্যেই সমকালের এবং চিরকালের অনুষঙ্গসমূহ এক নিবিড় সমবেশ নিয়ে প্রকাশ হতে লাগে, এখানে কাল কেবলমাত্র উপলক্ষ হিসেবে স্থান করে সর্বকালীন বা সার্বভৌম এক অভিনিবেশ তৈরি করে। দুই. উপযোগিতা বা উপলক্ষকে সামনে নিয়ে নয় বরং সৌন্দর্যকে সঙ্গে করে শিল্পই ঘটনা ও উপযোগিতাকে সম্পূর্ণতা দিয়ে যায় এবং এটাই সার্থক শিল্পের প্রধান গুণ। বাংলা কবিতা হাজার বছরেরও বেশি সময়ের বিপুলসংখ্যক কবির হৃদয়ানুভূতির সমৃদ্ধ ফসল। এই দীর্ঘ কালের ঐতিহ্যের ধারাকে অক্ষুণœ রেখেই এগিয়ে চলছে বাংলা কবিতার অভিযাত্রা। বিশ শতকের শেষ দশকে যেসব কবি বলিষ্ঠ কাব্য-প্রত্যয় নিয়ে চর্চা আরম্ভ করলেনÑ তাঁদের অনেকের হাতেখড়ি আশির দশকের শেষ দিকে। তবে নব্বইয়ের কবিতা পূর্বতন দশক থেকে ভিন্ন; ভাষা, শৈলী, প্রতীক, ছন্দ ও প্রচলিত চিত্রকল্পের প্রতি এই সময়ের কবিদের অনাস্থা ছাড়াও যে শব্দটি নব্বইয়ের কবিতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সহজেই চলে আসে তা হচ্ছে উত্তরাধুনিকতা। বাংলা সাহিত্যে ১৯৮০- এর দশকে উত্তরাধুনিকতাবাদের আমদানি ঘটলেও এ নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক পরীক্ষা, নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে নব্বইয়ের দশকে। একটি প্রভাবশালী শিল্প- প্রবণতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী বর্তমানে এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। নব্বইয়ের কবিতার আলোচনার সঙ্গে গভীর যুক্তিশীল বোধ করে বক্ষমান প্রবন্ধের এ পর্যায়ে উত্তরাধুনিকতাবাদ সম্পর্কে দুকথা বলতে চাই। আধুনিকতাবাদ জাতীয়তাবাদী মানসিকতার সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আড়ষ্ট, বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ভাষার লেখকদের এরূপ সমালোচনার কারণে এবং সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, বস্তুবাদ ও বিশ্বায়নের ধারায় চালিত বিশ্বব্যবস্থায় আধুনিকতা উত্তীর্ণ হয়েছে উত্তরাধুনিকতায়। এটা হচ্ছে নিজের সামনে নিজকে উন্মোচনের কিংবা প্রদর্শনের একটি প্রবণতা যেখানে নিজেই সম্পন্ন এবং নিজেই নিজের প্রচারক। এরা পুঁজিবাদী নয়, ভাববাদীও নয়। এরা কোন কিছুই বিশ্বাস করে না, এমনকি নিজকেও না। এটা এক ধরনের আত্মনৈরাশ্যবাদিতা। এরা সন্দেহ ও সমালোচনার পাল্লায় তুলে মাপজোক করে সবকিছু, তাই উত্তরাধুনিকতাবাদ আত্মবিধ্বংসীও বটে। পুরো কাঠামো ভেঙ্গে নির্মিত জিনিসকে বিনির্মাণ করাই উত্তরাধুনিকতাবাদের উদ্দেশ্য। তাই দেখা যায় বহুধা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন সব আন্দোলনÑ নারী আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, ছেলের পোশাকে মেয়ের অধিকার, বাঘ ও হাতির অধিকার কিংবা উলঙ্গভাবে ক্যাম্পাসে চলার অধিকার আদায়ের আন্দোলন। উত্তরাধুনিকতাবাদীরা মহাবয়ানের সামষ্টিক নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে মূলত এর বিক্ষিপ্ত এবং বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলো নিয়ে এক অস্থিত মুক্ত-ক্রীড়ার মেতে উঠেছে। ষাটের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে এক ধরনের সংশয়বাদী পা-িতের আগমন ঘটে ফ্রান্সে এরাই উত্তরাধুনিকতা যাদের গুরু এদের মধ্যেÑ জাঁক লাকা, মিশেল ফুঁকো ও জ্যাক দেরিদার নাম উল্লেখযোগ্য। তবে উত্তরাধুনিকতাবাদের বিখ-ায়ন, বিচ্ছিন্নতা এবং পুঁজিবাদের সঙ্গে এর সখ্য মার্ক্সবাদীদের চক্ষুশূল হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ‘উত্তরাধুনিকতাবাদ’ কোন গুণগত উন্নয়ন আদৌ আনতে পারবে কিনা তা মীমাংসিত নয়। তবু তত্ত্বের গুণ বৈদেশিক ভাবুকদের কল্যাণে যাই থাকুক না কেন এর ইতিবাচক অন্তঃসারটুকু যদি আমাদের সার্বিক কল্যাণ চিন্তায় ব্যবহার করা যায় সেটাই হবে কাজের কাজ। পাশ্চাত্য তত্ত্বের সমরূপ দাসত্ব ছেড়ে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিশীলভাবে তত্ত্বের দেশীয়করণ প্রয়োজন। যা হতে পারে দেশীয় প্রেক্ষাপটে তত্ত্বের বিনির্মাণ। ‘নব্বইয়ের কবিতা আত্মোপলব্ধির কবিতা’Ñ বলেছেন মাহবুব কবির। আমরা আত্ম-অভিঘাতে বিক্ষত হতে হতে নিবিড় পাঠ করে যাই এই কবিদের আক্রান্ত বাক্মালা। নিজস্ব মৃত্তিকা, জল ও আবহাওয়া, ধর্ম-দর্শন-ভূগোল, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মরমিবাদ, শিকড় সন্ধান, মহানাগরিক বৈশ্বিক চেতনাসহ বিষয়ের বিপুল সমাবেশ ওঠে এসেছে নব্বইয়ের কবিতায়। ৭১ পরবর্তীকালে নব্বই দশক হলো কবিতার অতিপ্রজননের সময়কাল। এ দশকের কবিরা হলেনÑ রহমান হেনরী, শিবলী মোকতাদির, হেনরী স্বপন, মুজিব ইরম, সমর চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, মুজিব মেহেদী, পরিতোষ হালদার, বীরেন মুখার্জী, কচি রেজা, মজনু শাহ, কুমার চক্রবর্তী, তপন বাগচী, চঞ্চল আশরাফ, মামুন মুস্তাফা, মন্দাক্রান্তা সেন, জুনান নাশিত, হাসানআল আব্দুল্লাহ, শাহেদ কায়েস, রিষিণ পরিমল, ভাগ্যধন বড়–য়া, শামীম রেজা, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, ওবায়েদ আকাশ, কামরুজ্জামান ক্যামু, সরকার আমিন, আলফ্রেড খোকন, অনিকেত শামীম, রাসেল আশেকী, মাহবুব আজিজ, দীপ্র আজাদ কাজল, শামীম কবীর, মাহবুব কবির, আয়শা ঝর্ণা, শোয়াইব জিবরান, কবির হুমায়ুন, টোকন ঠাকুর, শাহেদ শাফায়াত, জ্যাকি ইসলাম, তুষার গায়েন, রায়হান রাইন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মোস্তাক আহমদ দীন, আদিত্য কবির, জাকির আবু জাফর, ব্রাত্য রাইসু, শামসুল আরেফীন, দাউদ আল হাফিজ, মারজুক রাসেল, মনসুর আজিজ, তাপস গায়েন, খলিল মজিদ, শিবলি সাদিক, মিহির মুসাকী, জেনিস মাহমুদ, রোকসান আফরীন, সৌমিত্র দেব, পাবলো শাহী, সৈকত হাবীব, ফাহিম ফিরোজ, রওশন ঝুনু, সিদ্ধার্থ হক, আবু সাইদ ওবায়দুল্লাহ, আহমেদ নকীব, জাফর আহমদ রাশেদ, মাসুদুল হক, অলকানন্দিতা, এজাজ ইউসুফী এবং আরও অনেকে। তিন. কেউ কেউ কবিতাকে কেবল ভাব ও অন্তরীণ চেতনার আদলে মূল্যায়ন করে থাকেন আবার কেউবা বিষয় ও বস্তুনিষ্ঠতার নিরিখে মন্তব্য সাজায়। প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি সার্থক কবিতায় ভাব ও বস্তু গভীর প্রচ্ছন্নতায় যুক্ত থাকে সেক্ষেত্রে একমাত্রিক পর্যবেক্ষণ কবিতার শিল্পসত্তাকে কেবল সংকীর্ণই করে তোলে। আসলে কবিতা যতটা না আলোচনার তার অনেক বেশি অনুভবের। ব্যক্তি বিশেষ অনুভূতির যেমন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া রয়েছে তেমনি একটি কবিতাই একেকজন পাঠের ক্ষেত্রে একেক মর্মে স্বর তোলে। শিল্পী, বোদ্ধা ও সৃষ্টিশীলদের কাছে ‘শিল্প’ বোধের বিষয় হলেও সাধারণের চোখে সেটা বিনোদন কিংবা আনন্দের বিষয়। সেজন্য দেখা যায় ত্রুটি ও স্থ’ূলতা থাকা সত্ত্বেও কেউ জননন্দিত আবার খুব নান্দনিক ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ আলোচনার বাইরে, তবে শক্তিশালী ভাষা ও অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশভঙ্গির বলে বড় লেখকগণ তাদের অবস্থান সর্বদাই বজায় রাখতে সক্ষম হন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বের যে রূপগত পরিবর্তন দেখা যায় তার সঙ্গে মানুষের রুচি ও বিবেচনা-বোধ পাল্টে যায় তাই শিল্প মূল্যায়নের কোন স্থির কষ্টিপাথর নেই, এখানে আমাদের বক্তব্য ভঙ্গুর ও আপেক্ষিক। সময়ের দ্বন্দ্ব ও বোধের অভিঘাতকে মাথায় রেখে একজন আলোচক তার মন্তব্য বা ভাষ্য উপস্থাপন করলেই তা চূড়ান্ত হয়ে যায় না বরং দীর্ঘ সময়ের সঙ্গে সঙ্গতির ধারায় ওই শিল্পের অবস্থানই তার শিল্পসামর্থ্যকে তুলে ধরে এবং শিল্পের ক্ষণকাল ও চিরকালের প্রশ্নটা এখানেই তৈরি হয়। ‘তোমাকে লিখতে গেলে হৃদয়ের প্রসঙ্গ এসে যায়’Ñ এই হৃদয়বৃত্তির এপিঠ-ওপিঠ, সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, পথ ও নানা প্রকারণ বাঁকহীন ব্যঞ্জনায় আলফ্রেড খোকনের কবিতায় বার বার দেখা মিলে। জীবনের জটিলতা ও কুটিলতা রূঢ়তার সঙ্গে আসেনি তার কবিতায় বরং এক সরল সম্মোহন সঙ্গীতের দ্যোতনায় ভাষা পেয়েছে এখানে তবে একে ঠিক রোমান্টিকও বলা যায় না। কেননা রোমান্টিকদের মতো অস্বাভাবিক উচ্ছ্বাস খুব চোখে পড়বে না তার কবিতায়। ‘প্রেম শব্দটা খাতায় লিখে রাখছি সেই কবে দু’হাজার পাঁচে অথচ চৌদ্দ যেয়ে পনেরো আসলো সে এখনো বসেই আছে ফলে ভাষার গতর এই শব্দ ভাঙতে পারল না নিজেকে তার ব্যর্থতার কারণে আমরা এখনো কতিপয় মুখ নিচু তার অবোধ্যতার কারণে আমরা এখনো কতিপয়, তার পিছু যেমন ধরো নদী লিখলেই কি নদী হয়ে যায়, যায় না নদীতে নামতে হয়, বুক বিছিয়ে ভাসতে হয়, জানতে হয় সাঁতার।’ বাইরের নানামাত্রিক করণ ও কোলাহল কিংবা সময়ের অভিঘাত আলফ্রেড খোকনের কবিতাকে আক্রান্ত করতে পারে না- এ যেন কেবলি অন্তরীণ অভিব্যক্তির ব্যঞ্জনা আর নিজকে খুঁজে পাবার অধিরতা । ‘বিজেত্রীর ঘরে আমি যাইনি সেদিন, লোকে তবু আমাকেই বেরুতে দেখেছে অথচ সেই সন্ধ্যায় গোলাপ ও আফিমের কোনো তৃতীয় উদয়-পথে হেঁটে গেছি এক স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো’ বিনাশের উন্মত্ত ভাঙনের পিঠে কাজী নজরুল ইসলাম দেখিয়ে ছিলেন ‘প্রলয় সুন্দর’Ñ ‘হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে’, এটি আমাদের সাহিত্যের এক নবত্ব তেমনি মজনু শাহার ‘লীলচূর্ণ’ এবং ‘মধু ও মশলার বনে’ পাঠ শেষে আমরা যেন আরেক নবত্বে আরোহণ করলাম। তবে এই নবত্ব যেমন ভৌতিক তেমনি অর্থহীন ভেলকির মতো। কিছু ফুল আছে অনাদর জলাঞ্চলে তবু এক দৃষ্টে যেন তাকে ঠিক বোধ করা যায় না, স্বপ্নেও তার কিছুটা রেষ থেকে যায়। এই ফুল আশ্চর্য ও অর্থহীন। বোদলেয়ার এই অনাদর, অপরিচ্ছন্ন কুসুমের ঘ্রাণ নিতে চেয়েছিলেন আর মালার্মে সর্বস্ব বোধ করেছিলেন এই ঝলকানিকেই । অর্থ এবং উদ্দেশ্যের দিকে যেমন সবাই ছুটে না, কেউ কেউ আছেন কোন অন্ধ আতঙ্ক কিংবা আরাধ্য অর্থহীনতার দিকে প্রাণ ফেলে, খেয়ালের মদিরতা ছাড়া যার কোন গন্তব্য নেই, মজনু শাহা সে পথের অনুগামী; সৌন্দর্য ও আসক্তি ছাড়া যার কোন ব্যাখ্যা নেই। চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহে মজনু শাহার শব্দ বার বার বিদ্যুতের মতো কেবলি ঝলকে উঠতে চায়Ñ ‘হোলি গ্রেইল থেকে রক্ত মুছে গিয়ে শুধু বীজ খোসা আর তিক্ত-মধুর প্রবচনে ভরে। সঙ্গে নাও মর্মর-পেটিকা, ঢালুকে দাঁড়ানো শিউলি, তোমাকে রচনা করে হেম যেন, শুরু হয় রাতের মৃগয়া...’। নব্বইয়ের কবিদের মধ্যে শব্দকে মহার্ঘ করে তোলার প্রবণতা যাদের কবিতায় প্রবল তাদের অন্যতম রহমান হেনরী। শব্দ বিন্যাসের এই নিপুণতা তার কবিতাকে স্বতন্ত্র করেছে যেখানে অর্থের সম্পূর্ণতার জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয় এবং বিরত থেকে শব্দের শৈলী ও সৌন্দর্য ধাবণ শেষে ভাবতে হয় কি দেখলামÑ ‘লক্ষ করো সেই মৎস্য মানবীকে যে তার লেজভার বইতে পারছে না বালি ও রৌদ্রের যৌথ চিকিৎসায় এসো, তার লেজের বিভাজন থেকে সৃষ্টি করি এক জোড়া পায়ের মহিমা।’ এখানে অনুধাবন শেষেই কেবল উৎপন্ন হয় ‘পায়ের মহিমা’, নচেৎ এর কোন পৃথক প্রতিরূপ নেই। উদ্দাম ছুটে চলা পরিব্রাজক মনের সঙ্গে গতির যে সম্পর্ক তার সঙ্গে কবিতার পরিচয় বেশ আগেই। তবে এই গতির যান্ত্রিক ও আত্মিক সচলতার যে দুটি দিক আছে তার মধ্যে আত্মিক অভিলক্ষ্যই বোধ করি শাহেদ কায়েসের কবিতার অভিপ্সা; যেখানে হ্রেষাধ্বনি, খুরের আওয়াজ, গতি ও দিগভ্রান্তি সব যেন অশ্ববেগে ছুটেÑ ‘গভীরে খুরের আওয়াজ, হ্রেষধ্বনি, তারপর শুধু গতি আর গতি দিগভ্রান্ত পথ, পায়ে পায়ে হাওয়ার রাজ্য যেভাবে একটি জীবন নিভৃতে শাসিত, কুঠারে সবুজেরা বৃক্ষ বেজে ওঠে যার আঘাতে আঘাতে, সে কী প্রতিধ্বনি ...এক ঝলক হাওয়া অজন্তা-ইলোরা আহা, নক্ষত্র-জোনাকপোকা- শস্য ঢেউ, ফাল্গুনের মাতোয়ারা চাঁদ।’ এই গতি আমাদের নিয়ে যায় দুই হাজার বছর আগে, বেদুইন কবি ইমরুল কায়েসের কবিতার মত্ত জলসায়Ñ ‘যখন আমি ঝড়ো গতির অহঙ্কারী অশ্বের পালনে বসতাম লাগাম ধরে, নিঃসংকোচে আর বিপরীত যোদ্ধার আক্রমনে জর্জরিত হলেও সে কখনো ছিটকে যেত না আবার ঝাঁপিয়ে পড়ত শত্রুদের বিক্রম পালের সম্মুখে ।’ পরিতোষ হালদার নব্বইয়ের প্রাচীন পরিব্রাজকÑ যে পথ হারিয়ে গেছে, যে ধ্যান উবে গেছে, যা আমাদের জীবন থেকে বহুদূর পুরাতন, সেই শব্দ, সুর ও ব্যঞ্জনা-খচিত তার কবিতা, আমরা মোহাবিষ্ট হইÑ ‘আজ রাতে উজ্জয়িনী ছেড়ে যাবে অসংখ্য রমণী আজ রাত ফেটে যাবে গুচ্ছগুচ্ছ অলকায়।’ স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার মধ্যদিয়ে চিরকাল মানুষের যাতায়াত যা আমাদের জেগে থাকার প্রধান অবলম্বন কিন্তু আশ্চর্য প্রতিঘাত এসে প্রতিদিন আমাদের দগ্ধ করে, আমরা মুসড়ে পড়ি এবং আবারও স্বপ্নের কাছেই ফিরি। স্বপ্নের সঙ্গে পারিপার্শ্বের কিংবা বাস্তবতার এই দ্বন্দ্ব আমাদের কালের প্রধান চরিত্র যা বিবিধ ভাবমর্মে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে বীরেন মুখার্জীর কবিতায়। সময়ের স্রোত মাহাকালে হারিয়ে যায়, ঘটনা এবং উপলক্ষগুলিও সেই সঙ্গে নিপতিত হয় কেবল প্রত্যক্ষণের নিবিড় নির্যাসটুকু বেঁচে থাকে। এই নিবিড় নির্যাস থেকেই আমরা কালের পাঠ নেই; বীরেন মুখার্জীর কবিতায় স্বপ্ন ও বিসম্বাদ এক সঙ্গে দোলে, এই দোল যেন দিবা ও রাত্রির পালাক্রম, এই চক্র সময়ের Ñ ‘রাতের আলস্য ভেঙে জপ করি ভবিষ্যত স্বপ্নমাখা দৃশ্যে উড়ে যায় শব্দের কফিন জাগরণ ছাড়া কী থাকে তখন, এত কাছে মধুর সন্তাপ ছাড়া, কী থাকে কাছাকাছি।’ ‘ফেরা মানে আরম্ভের কাছে যাওয়া’Ñ এই ‘আরম্ভ সন্ধান’ যেমন দার্শনিকের অভিলক্ষ্য, তেমনি আরম্ভানুগ অনুভূতি ও সৌন্দর্যকে ধারণ করাই কবির কামনা। এই অগম অভিমুখে ছুটতে লেগে কবি ভেছে নেন তার শব্দসামন্ত, যা তাকে বিভীষিকা পথে পরাস্থ না হতে বীর্যবান করে তোলে। কুমার চক্রবর্তী সেই শব্দ-সামন্তের সারথি হয়ে আরম্ভের কাছে যেতে চান, নিজেকে নিজের সামনে মেলতে চান যেখানে নতুন ও পুরাতনের এক বিরল সংশ্লেষ, বোধের এই ক্রান্তি ও সঙ্কটই উত্তরাধুনিক প্রবণতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা তার কবিতাকে মহার্ঘ করেছেÑ ‘তুমি তার প্রবৃত্তির গিরিপথে ছোটালে যে অশ্বখুরধ্বনি সমুদ্রও জানত, তোমাকে ডাকছে তার শব্দান্ধতা যা তাকে করেছে- এই স্পর্শসঞ্চালক আর তুমি প্রতিভাকৌশলে জলকে করলে অন্তর্বাহী জীবনের অনুকূলে, অনাবশ্যকতায়।’ মিথের চমৎকার প্রয়োগ, প্রাচীন শাস্ত্র, বোধ ও বিধানের সমন্বিত সমাগমে কুমার চক্রবর্তী কবিতা যেন বিরল চৈতন্যের বাক্মালা । ‘জেনো দিয়োনিসুস, জীবন অস্পষ্ট এক স্মৃতিশাস্ত্র রাত শেষ হলে তার নিঃশব্দ করোটি, একা অন্তর্মুখে গেয়ে ওঠে হননের গান।’ (কুমার চক্রবর্তী) আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতার পাঠ শেষে এক পুরাতন চিন্তাচক্রে ডুবে যাচ্ছি- ‘আমার কোন অবলম্বন ছিল না’ এই অবলম্বন ও অস্তিত্বহীনতা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সুপ্রাচীন বেদযুগে, ঋগে¦দের সামান্য অনুবাদ শুনা যাকÑ ‘সেকালে যা নেই তা ছিল না, যা আছে তাও ছিল না তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল যে একমাত্র বস্তু বায়ুহীনভাবে আত্মামাত্র অবলম্বনে শ্বাস-প্রশ্বাস যুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন, তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।’ ‘সৃষ্টি’ মহাবিশ্বের সব থেকে বড় লীলা। লীলার এই রহস্য উদ্ঘাটন, অস্তিহীনতা থেকে অস্তিত্বের দিকে অধিগমনের প্রক্রিয়া আজও প্রায় আবৃতই রয়ে গেছে। এই যে কতক দেখা এবং কতক না-দেখার বা না-বুঝার গ্লানি ও আকাক্সক্ষার মাঝ থেকেই শিল্পের যাত্রা, এই যাত্রায় কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদের কাছে যে প্রশ্ন এগিয়ে আসে তারই স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি তার প্রতিটি শব্দবন্ধে ধ্বনিতÑ ‘না আঙুল ও প্রেম, না যৌনতা না রাত্রি ও দিন, না বিনাশ না জিঘাংসা ও ক্ষয়, না ইতিহাস আমি ভাসতে ভাসতে ছিলামÑ ভাসতেই ছিলাম ভাসতেই আছি। আমার কোন স্বপ্ন ও অবলম্বন নাই।’ চার. সকল সময়ের কবিতারই একটা নিজস্ব শিল্পরীতি থাকে এবং সেটা থাকতে হয়। কারণ ভাষার সচলতা সময়ের মতোই গতিশীল। সেই ভাষাভঙ্গি ও শিল্পরীতি সৃষ্টিতে নব্বইয়ের কবিরা কতটা সচেষ্ট হয়েছেন সে মন্তব্যের জন্য আমাদের আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে আশির দশকে কবিতায় যে উত্তরাধুনিক প্রবণতার প্রবেশ ঘটেছে তার বিস্তৃত এবং যথার্থ প্রয়োগ আমরা নব্বইয়ের কবিতায় খুঁজে পাই। চিন্তায় ব্যাষ্টিকতা পরিহার করে বৈশ্বিক আবহে ও উদারতায় কবিতাকে ঢেলে সাজিয়েছেন এ সময়ের কবিরা। সংকীর্ণ জাতীয়তাকে পরিহার করে, ক্ষুদ্র কেন্দ্রিকতাকে ভেঙে এক বৈশ্বিক বোধে উৎসারিত এই প্রবণতা আসলে সময়ের। তাই দেখা যায় সার্বিকভাবে একটি অভিলক্ষ্য চেতনাই যেন নব্বইয়ের কবিতার বক্তব্যকে ঘিরে আছে কিন্তু সেখান থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র বা ব্যতিক্রম কোন কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। যান্ত্রিকতা, দ্রুত পরিবর্তনশীলতা, জটিল জীবনযাত্রা, সক্ষম জাতিগোষ্ঠীর অন্যায় হস্তক্ষেপ, নগর সংস্কৃতির স্খলন এবং ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতাই একটি বৈশ্বিক প্রবণতার দিকে আমাদের টেনে নিচ্ছে, যা ব্যক্তির চিন্তা ও কামনার স্থিরতাকে ভেঙে দিচ্ছে নিরত। এই অভিঘাত ও ভাঙনের মুখে হয়ত আমরা একক শিল্পীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ খোরাক বেছে নিতে পারি না। কিন্তু সময়ের চৈতন্য ও প্রবাহ থেকে তাবৎ অন্তরীণ নির্যাসটুকু বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন নব্বইয়ের কবিরা। আমরা আত্মোপলব্ধিতে বিক্ষত হতে হতে পাঠ করে যাই এসব শব্দ-ব্যঞ্জন। নানামাত্রিক দ্যোতনা ও সুরসিক্ততায় নব্বইয়ের কবিতা যেনÑ মাতাল মধুগুঞ্জন।
×