ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মায়াবিনী জাদুকাটার হাতছানি...

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৯ জুলাই ২০১৬

মায়াবিনী জাদুকাটার হাতছানি...

নদী কি নারী নাকি পুরুষ? আর যদি নদীর নাম হয় জাদুকাটা, তাহলে? নিঃসন্দেহে নারী। কেননা নারীর মতো জাদু আর কার আছে, আর কে বা পারে অমন মায়ার বাঁধনে বাঁধতে? নদীর মায়া কতটা সেটা নদীর কাছে গেলেই কেবল বোঝা যায়। সেই মায়াবিনীর খোঁজে আমরা বের হয়েছিলাম। আমাদের অফিসের সহকর্মী মুসা ভাই অনেক দিন ধরে বলছিলেন জাদুকাটা নদীর কথা সময় এর অভাবে যাওয়া হচ্ছিল না। আর আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে প্ল্যান করে কোথায় যেতে পারি না। অফিসের কাজে কথা হচ্ছিল মুসা ভাইয়ের সঙ্গে। মুসা ভাই বললেন যাবেন নাকি জাদুকাটাতে প্রথমে না বলে দিয়েছিলাম এই ভেবে নদী তা আবার দেখার কি আছে পরে ভাবলাম গত দুই সপ্তাহ ধরে কাজের খুব চাপ গিয়েছে তাই ঘুরেই আসি। মুসা ভাই বললেন যত আগে রওনা দেয়া যাবে ততই ভাল তাই রাতের বেলাতেই ঘড়ি তে এ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। ভোর পাঁচটা হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায় ভেন্টিলেটর দিয়ে প্রবাহিত ঠাণ্ডা হাওয়ায় গরম কাপড় আরেকটু টেনে নিলাম তাও যবুথবু অবস্থা কাটছে না। সূর্যটাকেও বুঝি খুব আলসেমিতে পেয়েছে আজ। সেই কখন থেকে আড়মোড়া ভাঙছে তো ভাঙছে। তেজ নেই লালচে ভাব নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ ঘড়ি ঘোষণা দিল আর শুয়ে থাকার সময় নেই মায়াবিনী জাদুকাটাকে দেখতে হলে এখনই শয্যা ত্যাগ করতে হবে। সকাল সাতটা আমরা গন্তব্য পানে যাত্রা শুরু করলাম সঙ্গে মুসা ভাই। সিলেট শহর থেকে লামাকাজী, গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়া বাজার, পাগলা বাজার ধরে আমাদের চার চাকার গাড়ি চলছে যেতে যেতে মনে হলো পৃথিবীর সবুজ রং ছাড়া আর কোন রং নেই। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল গাছের পাতাই তার সাক্ষী। আমরা চলছি শান্তিগঞ্জ বাজার পেরিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জ শহরে এসে কিছু সময়ের বিরতিতে গেলাম মুসা ভাইয়ের বাসায়। দেখা হয়ে গেল মুসা ভাইয়ের আব্বা সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়য়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক এএফ মসয়ূদুল হাসানের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ওনার সঙ্গে সুনামগঞ্জের ইতিহাস নিয়ে কথা। কথা চলছে এর মাঝে খালা আমাদের জন্য নিয়ে এলেন হরেক রকমের নাস্তা এর মাঝে দেখা মিলল মুখরোচক বসনিয়ান পরোটা। দিবা তখন দ্বিতীয় প্রহর কিভাবে যে এত সময় চলে গেল টেরই পেলাম না। মুসা ভাই বললেন পরে আবার কোন দিন এসে আব্বার সঙ্গে গল্প কইরেন এবার চলেন জাদুকাটার দিকে ধাবিত হই। সত্যি বলতে গল্পের আসর ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে করছিল না এমন গুণী মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অগত্যা আমরা রওনা দিলাম জাদুকাটার দিকে। জাদুকাটা যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে যেতে হবে ভাড়া করা বাহনে অথবা নিজের মোটরবাইকে বললেন মুসা ভাই। কিছুদিন আগে উদ্বোধন হওয়া এম এ খান ব্রিজের পাশে এসে দেখা মিলল বিরল দৃশ্যের শুধু মোটরবাইক আর মোটরবাইক । মুসা ভাই বললেন সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র সুবিধাজনক পরিবহন হলো মোটরবাইক আর বর্ষার সময় নৌকা ছাড়া গতি নেই। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে জাদুকাটার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। আমরা লালপুর ব্রিজ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি যত সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কৃষকের মাঠের সোনা রাঙ্গা ধানের বিরল দৃশ্য মনকে ভরিয়ে দেয়। পলাশ বাজার, ধরপুর বাজার পেছনে ফেলে, চিনাকান্দি বাজার ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ ডান দিকে চোখ পড়তেই দেখা মিলল পাহাড়ের আমাদের পাইলট দেলোয়ার হোসেন বললেন এই সেই মেঘালয়। এরই মধ্যে আমরা মায়াবিনী জাদুকাটার পরশ পাওয়া শুরু করলাম। আমাদের পাইলট সামনে এগিয়ে চলছেন আর আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। এরপর বিজিবি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে মোটরবাইক নিয়ে আমাদের পাইলট নেমে গেলেন জাদুকাটার বালুচরে। তপ্ত রোদের মাঝে ও শান্তির পরশ। ধু ধু বালু চরে আমরা একের পর এক ছবি তুলতে থাকলাম। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে নদী। যেমন অদ্ভুত তার সৌন্দর্য তেমন অদ্ভুত তার নাম। বিমুগ্ধ করার মতো যথেষ্ট। জাদুকাটা নদীর গভীরতা কম। আর তার জল এতটাই স্বচ্ছ যে নিচের বালুকণা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর, অন্য পাশে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি। নদীর পারে দুরন্ত বালকদের ছোটাছুটি, মাছ ধরা মনকে ভরিয়ে দেয়। পায়ের নিচে জাদুকাটার ঠা-া জলের পরশ আর মাথার ওপরে পাহাড়। সেই পাহাড়ের পিঠ বেয়ে যেন বের হয়ে বাংলাদেশে এসেছে জাদুকাটা নদী। দেখে মনে হবে, নদীর উৎসমুখে দুই পাশ থেকে পাহাড় ঝুলে আছে। পেছনে আরও একটি পাহাড়ের দেখা মিলবে সেখানে। আমরা নদী পার হয়ে ওপরে উঠে জাদুকাটার মমতার ছোঁয়ায় হেঁটে চললাম ঘুরে বেরালাম বড়ঘোপ এলাকার আনাচে কানাচে। বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে দেখা মিলল ১২০৩ নম্বর পিলারের। নদীর পাড়ের মানুষের জীবন, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিচরণ আপনাকে মুগ্ধ করবে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো জাদুকাটা নদীর মুগ্ধ করা রং। আমাদের পাইলট বললেন আরও একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে শাহ আরেফিনের (রহ) আস্তানা ও লাউড়েরগড় গ্রাম। সেই গ্রামের দক্ষিণ কোণের নদীতীরে রয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর চৈত্র মাসে প্রায় একই সময়ে শাহ আরেফিনের আস্তানায় উরস ও জাদুকাটা নদীতীরে পুণ্যস্নান হয়। দুই উৎসব ঘিরে সে সময় নদীতীরে বসে দুই ধর্মের মানুষের মিলনমেলা। হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে নদীর গা ঘেঁষে। এক সময় এই জাদুকাটা নদীর তীরেই ছিল প্রাচীন রাজ্য লাউড়ের রাজধানী। সময়ের পরিক্রমায় সেখানে এখন রাজ্য নেই, নেই রাজধানীও। প্রাচীন সেই রাজ্যের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এখনও গ্রামটির নাম ‘লাউড়েরগড়’। আমরা সময় নষ্ট না করে এগিয়ে চললাম শাহ আরেফিনের (রহ) আস্তানার দিকে। কিছুক্ষণ মাঝে আমরা পৌঁছে গেলাম শাহ আরেফিনের (রহ) আস্তানায়। শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশ সঙ্গে বিশাল এলাকা নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সারি। শাহ আরেফিনের (রহ) আস্তানার শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখা মিলল বাংলাদেশ-ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। তবে সামনে এগিয়ে না যাওয়াই ভাল। দেখতে দেখতে বেলা শেষ হয়ে এলো এবার আবার ঘরে ফেরার পালা। মায়াবিনী জাদুকাটাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না, কিন্তু কিছু করার নেই বাস্তবিক জীবনে সবাইকে ফিরে যেতে হয় শুধু স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায় জাদুকাটার মায়াবী পরশ । পথের ঠিকানা- জাদুকাটা নদী সুনামগঞ্জ জেলার হাওড় অঞ্চলে অবস্থিত। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার সরাসরি বাস রয়েছে। এনা, হানিফ, শ্যামলী, ইউনিকসহ অনেক বাস এই পথে চলে। তবে অবশ্যই অগ্রিম টিকেট কেটে রাখুন। তাহলে ঝামেলা পোহাতে হবে না। সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি চলে যেতে পারেন জাদুকাটা নদীর তীরে। সুনামগঞ্জ শহরে এসে এমএ খান সেতু থেকে পাবেন মোটরবাইক। একবারের ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। সারা দিনের জন্য নিলে ভাড়া পড়বে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। সুনামগঞ্জ থাকার ব্যবস্থা আছে ভালই। দলবেঁধে ঘুরতে গেলেই বেশি আনন্দ করতে পারবেন।
×