ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ফেরাও বিপথগামী সন্তানকে

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৯ জুলাই ২০১৬

ফেরাও বিপথগামী সন্তানকে

তারা কখনও গাইত না রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।’ বরং তারা হয়ে উঠেছে নরখাদক। তারুণ্যের দোলাচল তাদের মানুষ হওয়ার পথে নয়, নিয়ে যাচ্ছে নরক গুলজার করা বর্বরতার পথে। যে পথ নয় মুক্ত মানুষের, মুক্তির আলোকিত সময়ের, সেই পথ ধরে অন্ধকার গহ্বরের দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে। কে তাকে ফেরাবে, কে শেখাবে ওই পথ তার নয়, সে পথ মানব জাতির কল্যাণমঙ্গল আর বিকাশের পথ নয়। এদের মানসিক বিকাশের স্তর এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রক্ত আর লাশ ছাড়া অন্য কোন দৃশ্য বুঝি মনঃপূত নয়। শিক্ষা-দীক্ষা তাদের সুপথে পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারেনি। তাদের মনোজগতে এক অন্ধকার এমনভাবে গ্রথিত হয়েছে যে, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে অসুস্থ অস্বাভাবিক জীবন হাতছানি দিয়ে টেনে নিচ্ছে। হ্যামিলনের বংশীবাদকের ঘটনা মনে আসে। তার বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে শহরের সব কিশোর-তরুণ পালে পালে ছুটে গিয়েছিল। তারা আর ফেরেনি। তাদের হদিসও মেলেনি। কিন্তু এই সময়ের তারুণ্যের ভেতরে বসবাস করেও একটি অংশ কোন বাঁশির টানে ছুটে যাচ্ছে, তার হদিস হয়ত মিলবে। কিন্তু কোন অঙ্ক বা সমীকরণেও মেলানো যাচ্ছে না, কেন তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে, বেছে নিচ্ছে মানুষ হত্যার নির্মম পথ, সেই সঙ্গে আত্মঘাতীও। কিসের মোহে তাদের এই নারকীয় পথ বেছে নেয়া, বিশেষত উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠে আলোকিত যারা, তারা বিনিময়ে কী পায়, পাচ্ছে? নিরীহ, নিরপরাধ মানুষ হত্যার মধ্যে বীরত্বের কিছু নেই, আছে পাশবিকতার প্রকাশ। এডভেঞ্চার তারুণ্যকে টানতেই পারে। কিন্তু তা যদি হয় রক্তপিপাসুর, তবে বিপজ্জনক বৈকি। ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ারের চলচ্চিত্র বা কাহিনী তাদের আকৃষ্ট করতে পারে, কিন্তু তা হয়ে ওঠা নৈব নৈব চ। জীবনানন্দের ভাষায় বলা যায়, আসলে পৃথিবীর এখন গভীর গভীরতর অসুখ। আর সে অসুখের কারণে দেশে দেশে-মহাদেশে তরুণরা হয়ে উঠছে জঙ্গী-সন্ত্রাসী। পড়াশোনার মান ভাল বলে স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ঘর ছেড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গুপ্তহত্যা, টার্গেট কিলিং, আত্মঘাতী হামলার মতো ঘৃণ্য কাজে নেমে পড়ছে কোন মতাদর্শের প্রণোদনায়, তার হদিস অবশ্যই মিলবে। এদের মধ্যে দেশপ্রেম বলে কোন্ বোধ কাজ করছে, তা নয়। এই যে তাদের মধ্যে উগ্রতা, জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটেছে তা বিচ্ছিন্ন বা স্বতঃস্ফূর্ত কোন ঘটনা নয়। বরং এর নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সুপরিকল্পিত দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতা। এর শেকড় প্রোথিত অনেক গভীরে। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। তবে এই পথ ও পদ্ধতি যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের এই পথ বেছে নেয়ার পেছনে যুক্তি দেখানো হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এরা বিপথগামী হয়। কিন্তু বিত্তশালীর পরিবারের সন্তানরা তাতে যখন জড়াচ্ছে, তখন আতঙ্ক আর আশঙ্কার পরিধি বাড়তে থাকে। আবার দেখা যাচ্ছে জঙ্গী বাহিনীতে হতদরিদ্র, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের এক ধরনের সংমিশ্রণ ঘটছে। বিভিন্ন আর্থিক শ্রেণীর এই তরুণরা একত্রিত হয়ে নারকীয় হত্যাকা- চালাচ্ছে। এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। অশিক্ষিত, অক্ষরজ্ঞানহীন নয় । এদের সঙ্গে শিক্ষকদের নামও এসেছে জঙ্গী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে। ইবতেদায়ি ও কওমী মাদ্রাসার তালেব ইলেম, ইংরেজী মাধ্যমের ছাত্র, সরকারী-বেসকারী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে জঙ্গী সৃষ্টি পুরো দেশ, সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের যুবকরা একত্রিত হওয়ার এবং এক সঙ্গে মানুষ হত্যা করার মতো মানসিকতাকে তৈরি করতে পারার পেছনে যে ‘মাজেজা’ কাজ করছে, তার পোস্টমর্টেম করার কাজটি নিশ্চয় সংশ্লিষ্টরা করবেন। জঙ্গীবাদ হচ্ছে এক ধরনের পৈশাচিকতা। বর্তমানে উগ্রবাদী চরমপন্থী কিছু গোপন সংগঠনের প্রভাবে কিছু তরুণ সেই পৈশাচিকতাকেই ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করেছে। ‘মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী’ মার্কা কল্পনাশ্রয়ী ধারণাকে মর্মমূলে এমনভাবেই গেঁথে নিয়েছে যে, অভিভাবকদের আদর-স্নেহ-ভালবাসা এমনকি সমাজও তাদের কাছে তুচ্ছ। এদের মন-মানসিকতা স্বাভাবিকতার বাইরে কী ভাবে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে, তার হদিসও হয়ত মিলবে। দেশী-বিদেশী অস্ত্র হাতে তারা মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে যে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করছে কিংবা উপভোগ করছে, তার অন্তর্নিহিত গভীরে রয়েছে উন্মাদনা। এমনভাবে তাদের জঙ্গী তৈরি করা হচ্ছে যে, যা কিছু স্বাভাবিক, তার বিপরীতে অস্বাভাবিকতাকে ধারণ করে নিচ্ছে এরা। অথচ এদের শৈশব-কৈশোরের বেড়ে ওঠার পথে পথে ছড়ানো ছিল পুষ্পমঞ্জরি। পুষ্পিত ইমেজের মাঝে মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার স্বপ্ন তাদের তাড়িত করেছে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠে এসে যে তরুণ জীবনের মোহ, আর ভুবনজোড়া আসনখানি মেলে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা, সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠার কথা, সেই তরুণের হাতে রক্তের দাগ কেন- তার বৃত্তান্ত স্পষ্ট নয়। পিতা-মাতার অতি আদরের ধন তার সন্তান, অসীম স্নেহ, পরম মমতা আর আদর-ভালবাসায় তাদের লালন পালন করে মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার পথটি তারাই তৈরি করে দেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকের ঔদাসীন্য থাকতেই পারে। তার ফাঁক গলে সন্তান বখে যায় বলে একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে। কিন্তু তা হয়ত ঘটে গুটিকয়েকের ক্ষেত্রে। আসলে পরিবারের বাইরে পারিপার্শি¦কতার প্রভাবও পড়ে এই তরুণদের মধ্যে। সমাজ বিদ্যমান বৈষম্যের শিকার হলে অনেকক্ষেত্রে তরুণরা দ্রোহী হয়ে ওঠে। কিন্তু জঙ্গীবাদ কোন দ্রোহ নয়। নয় কোন প্রতিবাদ। বরং পারিবারিক বন্ধনকে ছিন্ন করে বন্য মানুষে পরিণত করে জঙ্গীবাদ। তাই দেখা যাচ্ছে তিন চার মাস আগে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া তরুণটি জঙ্গী হামলা চালাতে গিয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে। পরিবার জানে না তার সন্তানটি, আদরের প্রিয় সন্তানটি কখন স্বাভাবিক পথ ও পন্থা ছেড়ে জাহান্নামের পথে চলে গেছে। অথচ পরিবার স্বপ্ন দেখে আসছে তাদের সন্তানটি একদিন বড় হবে, দেশ ও জাতির প্রতি নিবেদিত হবে, সমাজে মুখ উজ্জ্বল করবে। সন্তানের গর্বিত মুখ পিতা-মাতাকে স্বর্গীয় আনন্দ এনে দেবে। কিন্তু সেই সন্তানটি যখন ইহলৌকিকতার বিপরীতে কথিত পারলৌকিকতার দিকে এগিয়ে যায়, তখন তার বোধে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কাজ করে না। বরং স্বর্গের সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সে নারকীয়তায় এমনভাবে অংশ নেয় যে, নরকের সব দরজা তার জন্য খুলে যায়। নিজেও পরিণত হয় নরকের কীটে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তরাঁর হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর মনে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্ররা মিলে জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে যে আত্মঘাতী হামলা চালায়, তা টনক নড়িয়ে দিয়েছে সর্বস্তরের মানুষের। গুপ্তহত্যা-টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার থাকলেও এই একটি ঘটনা ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এ দেশে বসবাসরত দেশী-বিদেশী জনদের। কারও ভাবনা বা ধারণায় আসেনি যে, আঠারো থেকে চব্বিশ বছর বয়সী ছাত্ররা খুনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মানুষ হত্যায় নেমে পড়বে। চাপাতি, বন্দুক ও বোমা তাদের অস্ত্র। আর তা ব্যবহারের জন্য তারা প্রশিক্ষণও পায়। গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকা-ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখনও সবাইকে ভাবাচ্ছে। এসব নিয়ে চলছে নানা বিচার-বিশ্লেষণ। অনেকের ধারণা, শিক্ষার্থীদের এই বিপথগামিতার মূল কারণ নিহিত আছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায়, যদিও এই স্তরের কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে ওই ধরনের বড় অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ার কোন অবকাশ নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নানা অপরাধকর্মে জড়িত হওয়ার নেপথ্যে এই শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম সংক্রান্ত দৈন্যদশাকেই দায়ী করা হচ্ছে। এমনিতে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ২৩ শতাংশেই গাওয়া হয় না জাতীয় সঙ্গীত। সেই সঙ্গে জাতীয় পতাকাত্তোলন করা হয় না নয় শতাংশ বিদ্যালয়ে। জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকার প্রতি এই অবহেলা প্রদর্শনের কারণে সেইসব শিশুর মধ্যে আসলে দেশপ্রেম জাগছে না। দেশের প্রতি মমত্ববোধ না জাগাতে পারলে, ভূঁইফোড় হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দেশপ্রেমহীন এই শিক্ষায় একদিন বড় হয়ে দেশের যে কোন ক্ষতিসাধন করলে তাতে অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না। এমনিতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নানাভাবেই ব্যাহত হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৮ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন গ্রন্থাগার নেই। ৪৫ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন দূরে থাক, এমন প্রতিযোগিতার নামই শোনেনি। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় না ৪১ ভাগ প্রতিষ্ঠানে। স্কাউটিংয়ের মতো মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির নাম-গন্ধ নেই ৭০ শতাংশ বিদ্যালয়ে। চিত্রাঙ্কন এবং সঙ্গীতচর্চার বিষয়টি নেই প্রায় সব বিদ্যালয়ে। অথচ এসব কার্যক্রমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। শিশু-কিশোরের মানসিক গঠনে এসবের প্রভাব তীব্র। এসব ছাড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষা যেমন হয় না আনন্দময়, তেমনি তাদের বেড়ে ওঠা হয় না সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধন। কিন্তু তা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল পুঁথিগত বিদ্যা ও পরীক্ষার চাপ এবং বোঝার প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে পড়েছে। কোচিংনির্ভর শিক্ষার ভারে নুয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর এসবকেই অভিভাবকরা সন্তানের ভবিষ্যৎ উন্নতি, অগ্রগতি বলে মনে করছেন। নিয়মিত শরীরচর্চা ও খেলাধুলার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যে একটি জগত রয়েছে, সেই সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের তেমন কোন ধারণাই দেয়া হচ্ছে না। টেলিভিশন হচ্ছে তাদের বিনোদনের সামান্য জগত। যা আবার দেখার সময় হয় না, পড়াশোনার চাপে। ফলে সামান্য অবসাদ ও হতাশায় তারা হারিয়ে ফেলছে আত্মবিশ্বাস কিংবা সঙ্গদোষে হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত এবং একই সঙ্গে বিপথগামী। এই পরিস্থিতি দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য আদতেই বিপজ্জনক। মূলত গোড়ায় যে গলদ রয়েছে, তাতে জলসিঞ্চন করে গলদ আরও বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এই গলদ দূর করার কেউ নেই কোথাও। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কাজটি করা হয় না। তারা জানে না দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। নির্মল সাংস্কৃতিক চর্চার কোন সুযোগ নেই তাদের। তাদের নৈতিক এবং প্রকৃত ও মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানও করা হয় না। খেলাধুলা ও সুকুমারবৃত্তির চর্চা তাদের মধ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে না। বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১১ কোটির বেশি তরুণ। যাদের বয়স অনূর্ধ্ব ৩৫ বছর। মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বেশি এ সংখ্যা। এদের মধ্যে পাঁচ কোটি হচ্ছে শিক্ষার্থী। এরা কী শিখছে সেসব নিয়ে কোন আলোচনা নেই। এইসব শিক্ষার্থীর একটা অংশ পরগাছা হিসেবে বেড়ে উঠছে। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা না থাকায় বহুমুখী শিক্ষার বহুমুখী প্রবণতা নেতিবাচক দিককেই সামনে নিয়ে এসেছে। যে শিশুরা আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে, তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলার কাজটি আর হচ্ছে না। শিশু যদি স্নেহ-মমতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধি হয়ে গড়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যতে দেশে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিনোদনের কোন বিকল্প না থাকায় ভাবী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হতে বাধ্য। আর তাই জঙ্গীপনায় আকৃষ্ট হওয়া তাদের জন্য সহজসাধ্য বৈকি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে না। জ্ঞানার্জনের জন্য মূলত সব ধরনের শিক্ষারই প্রয়োজন রয়েছে। বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক মনে করেন, বই পড়লে মানুষ জগত সম্পর্কে জানতে পারে। তবে বইয়ের জগত এবং বাস্তবিক জগতকে মিলাতে হয়। যেটা করার জন্য বইয়ে নির্দিষ্ট করে বলা আছে তা-ই অপাঠ্য। ক্লাসে যা পড়ানো হয় তা অপাঠ্য এবং ক্লাসের বাইরে যা কিছু আছে তা পাঠ্য। আসলে অপাঠ্য কোন কিছুই না। সবই পাঠ্য। জ্ঞানার্জনের জন্য বই পাঠের বিকল্প নেই। তার মতে, মানুষ আজ এক ভার্চুয়াল জগতে চলে এসেছে। যা আছে আবার নাইও। তৈরি করা তেঁতুল আর খাঁটি তেঁতুলের টক যেমন এক রকম হয় না; তেমনি মানুষ এবং মানুষের মতো বিষয়টি এক নয়। তাই শিক্ষার্থীদের মানুষের মতো না হয়ে মানুষ হতে হবে। মানুষ যদি মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায়; তবে সে মানুষ হওয়া থেকে দূরে যায়। গুলশানের ঘটনায় জানান দেয়, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মানুষ হত্যায় জড়িত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি ভাবতেও পারেন না যা, তাই হয়েছে। বলেছেনও শেখ হাসিনা, ‘যাদের কোন অভাব নেই, ভাল খায়, ভাল পড়ে, তারাই এখন জঙ্গীবাদে জড়াচ্ছে। যেখানে তাদের জন্য কোন কিছুই অপূরণীয় থাকে না, সেখানে কেন তারা এটা করছে, এর যৌক্তিকতা কী? তারা এখন বেহেশতের হুরপরী পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর কী যৌক্তিকতা? কারা তাদের পেছন থেকে উসকাচ্ছে? এসব করলে নাকি বেহেশতের দরজা খুলে যাবে। কিন্তু মানুষ হত্যা করলে বেহেশতের দরজা খোলে না। ’ গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হক জানালেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করলে বেহেশতে যাওয়া যাবেÑ ধর্মের এমন অপব্যাখ্যা দিয়ে মেধাবী তরুণদের মগজধোলাই করে জঙ্গী বানানো হচ্ছে। তার মতে, যেসব তরুণ কুমন্ত্রে ও বিশেষ মহলের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়ে জঙ্গী কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে, তারা ভুল স্বীকার করে সুপথে-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে। পুলিশ তাদের কোন রকম হয়রানি করবে না। গুলশানের রেস্তোরাঁয় নিহত পাঁচ জঙ্গীর মৃতদেহ এখনও পুলিশের কাছে পড়ে রয়েছে। তাদের জন্মদাতা মা-বাবাও মৃতদেহ নিতে আসছে না। শোলাকিয়ায় নিহত এক জঙ্গীর জানাজায় কোন মুসলমানও অংশ নেয়নি। একজন ইমামই শুধু অংশ নেন। তা-ও জানাজা পড়ানোর জন্য। জঙ্গীদের নিজেদের মা-বাবা ও সাধারণ মানুষ যে কী পরিমাণ ঘৃণা এবং প্রত্যাখ্যান করেছে এসব তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গীরা দেশের নামী ও অভিজাত স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। যে কারণেই উদ্বেগ ও আতঙ্কের মাত্রা বেড়েছে মানুষের মধ্যে। টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও। পড়াশোনার মান ভাল বলে স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন কোন শিক্ষক ধর্মীয় উগ্রপন্থী মতবাদে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছে। ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান পড়তে পাঠিয়ে যদি সেই সন্তান সাম্প্রদায়িক ও উগ্রপন্থী হয়ে ওঠে এবং মানুষ হত্যায় দ্বিধা করে না, তাহলে দেশের আর যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে, এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অভিভাবকসহ সাধারণের মনেও। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে নিজের ঔরসজাত সন্তান চোখের সামনে জঙ্গী হয়ে যাচ্ছে সেটা ধরতে না পারার আতঙ্ক। এভাবে কেন বদলে যাচ্ছে আদরে লালিত সন্তানরাÑ সে প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন অভিভাবকরাও। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাল রেজাল্টের চাপে যেমন মনের বিকাশ ঘটাতে পারে না, তেমনি পরিবারের ভেতরও তাদের স্বাভাবিক বিকাশের পরিবেশ অনেক সময় নিশ্চিত হয় না। কেননা হীনম্মন্যতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরাই পারে মাদক বা বিশেষ কোন মতবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এদের বিকাশের পথে আত্মবিশ্বাসের অভাবই তাদের এই জঙ্গীপনার দিকে ধাবিত করেছে। এর জন্য ক্যারিয়ার সর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও দায়ী। পরীক্ষাকেন্দ্রিক বা জীবিকাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করা যায়নি। একটি গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ও সুস্থ নীতিবোধ সমৃদ্ধ পারিবারিক পরিবেশ তাদের দেয়া হয়নি। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে শিক্ষার্থীদের চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষা ও পড়ার চাপে তাদের আনন্দের সব জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। খেলার জানালা বন্ধ করা হয়েছে। শুধু বাসায় বসে ইন্টারনেটে ‘উইন্ডো’ খোলা রাখা হয়েছে। কেবল পরীক্ষা দিয়ে আর ভার্চুয়াল জগতে ঘুরে শিশুদের মানসিক বিকাশ সম্ভব হয় না। পরিবার নৈতিক শিক্ষা দিতে পারে না। শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা মানবিক হলে এবং অভিভাবকরা সন্তানদের জন্য সৎ, সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে ফলাফল সবই শূন্য। এর কোন বিকল্প নেই। জঙ্গী কর্মকা-ে শিক্ষিতরা জড়িয়ে পড়া ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। গলদটা পরিবার, শিক্ষা, পরিবেশ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে। আমাদের তরুণরা বিপথে হারিয়ে যাবে, খুঁজে নেবে অন্ধকারের পথ, এমনটা ভাবনা কষ্টদায়ক। পীড়িত হতে হয়, যখন বই তথা পড়াশোনা ছেড়ে খুনী হতে প্রশিক্ষিত হওয়ার জন্য ঘরবাড়ি ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যায়। হতাশা তখন গভীর, দুশ্চিন্তা তখনই স্থায়ী হয়। অভিভাবক বা সমাজপতিরা কেন যেন মনে করেন তরুণরা ভুল পথে যেতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তরুণরা নিরাশার জগতকে সমৃদ্ধ মনে করে তাতে ঝাঁপ দিচ্ছে। যেসব জঙ্গী খুন হয়েছে বা ধরা পড়েছে তাদের সাকিন, মৌজা, ঠিকুজি প্রমাণ করে যে এরা বিত্তবান পরিবারের সন্তান। সেই সঙ্গে সচ্ছল ও অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরাও মিলিত হয়েছে। কিন্তু তারা এই পথে পাড়ি দিচ্ছে, তার কোন সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে তাদের যোগাযোগ বিশ্বজুড়ে। এর মাধ্যমে তারা জঙ্গী নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পড়ছে। পরকালে স্বর্গপ্রাপ্তির লালসায় এরা আত্মঘাতী হচ্ছে। অথচ পুরো বিষয়টি যে প্রাপ্তির বেড়াজালে আবদ্ধ সে কথা তাদের কেউ বোঝায় না। পরিবার থেকে এদের মানসিক নৈতিক গঠনের কাজটি যথাযথভাবে হয়েছে বলা যাবে না। এই তরুণদের অধঃপতন বড় বেদনার মতো বাজে। আর সেই বিষয়টি কবিতায় ধরা দিয়েছে আমার কাছে। ‘জঙ্গীর প্রতি’ কবিতায় ধরেছি এভাবে। “কে চিনিয়েছে তোকে অলিগলি অন্ধকারে অন্ধকার / চিনিয়েছে কে তোকে হত্যার রাজনীতি সুড়ঙ্গ গভীর /কাপুরুষ জীবনে কে তোকে গড়েছে জঙ্গী শিবির /অন্যায়ের সঙ্গে সন্ধি, মিথ্যের সঙ্গে সহবাস ভয়ঙ্কর।/ তবু এই পথ বেছে নেয়া জানি ইচ্ছের বিপরীতে/ ক্রমে ক্রমে বিষের নীল দংশন বোধহীন নিষ্ঠুরতায়/ খেয়েছে তোকে যন্ত্রচালিত মন্ত্রের রূঢ় অভিঘাতে/ নির্বিবাদ জ্বালাও পোড়াও আর গুম হত্যার দৃঢ়তায়।/ কিভাবে এমন হয়ে গেলি তুই ঘাতকের সঙ্গে মিশে/ নিজের দেশ, জাতি, সমাজ, ভাষা ও মুক্তির গান/ টুঁটি চেপে ধরে আবার মধ্যযুগের নৃশংস বর্বর উল্লাসে/ অতর্কিতে চালিয়ে হামলা করতে চাস সব খান-খান।/ কে তোকে বলেছে এই পথ বেহেস্তের, আসলে জাহান্নাম/ কী যে ভুল তোর পথ, নরকের রথে চড়ে নারকীয়তায়/ খুলেছিস স্বদেশী ঘাতকের সঙ্গে আজ দোজখের ধাম/ এ পথ স্বর্গের হলে, মানুষই যেত দ্যখ নির্দ্বিধায়।/ তোর ফেরার সব পথ আজ রুদ্ধ- তুই জাতির দুশমন/ তোর জন্য অভিশাপ- তোর জন্য রাখি তাই মৃত্যুপণ।/ কিন্তু ফেরার পথ রুদ্ধ হোক, তা চায় না কেউ। বরং সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক নিজের পরিবার, দেশ জাতির পক্ষে। আমাদের তারুণ্য আমাদের ভবিষ্যৎ। তার পচন কারো কাম্য হতে পারে না। যে পথ তাদের নয়, সে পথে কেন হেঁটে যায় তারা মারণাস্ত্র হাতে সে প্রশ্নের জবাব মিলবেই। অভিভাবকরা কী চাইবেন কখনও, তাদের সন্তান বখে যাক? সাধারণত তা চায় না। কিন্তু সন্তান তো চলে যায়, জগত সংসারকে পেছনে ফেলে। সেই সন্তানদের ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার কাজটি প্রথমে অভিভাবক ও পরে শিক্ষকের ওপর বর্তায়। কেন সন্তান আত্মঘাতী হয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, তার উত্তর নিশ্চয় স্বজনদের জানা নাও থাকতে পারে। কিংবা জানার কোন মাধ্যমও অবলম্বন করা হয়নি। নিজের সন্তানকে স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনাটা আজ গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গী ও সন্ত্রাসময় জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রগুলো সম্প্রসারিত করা জরুরী। জঙ্গী সন্তানরা ফিরে আসুক মর্মে অভিভাবকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছি। কবিতার ভাষায় আজ ‘ফেরাও জঙ্গী সন্তানকে’ শিরোনামে। কবিতাটা এরকমÑ “তোমার সন্তান খুনিদের অনুগত হয়ে আজ নেমেছে রক্তপানে/ নির্মম অমানবিকতার ছাপ তার চোখে মুখে নিষ্ঠুর খুন শুধু টানে/ ধর্মের নামে বর্ণের নামে তার দুই হাতে উদ্যত রক্তাক্ত সঙ্গিন/ মানুষ বলি দিতে জল্লাদের মতো নির্বিকার ঘাতক অস্ত্র উড্ডীন/ তোমার সন্তান সত্য ও ন্যায়ের নামে মিথ্যাবাদের ঘৃণ্য পাহাড়ে/ অন্যায়ের শিবির তৈরি করে ভাবছে পুণ্য জমছে খুনেরই ভাঁড়ে/ আর পাপের বোঝা ক্রমশ বাড়ায় ধর্মের আচরণের আবডালে/ নিষ্ঠুরতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গেছে পশুত্বেরই পাংশুটে আদলে/ কেন তুমি ফেরাও না আজও প্রাণের আত্মজ বংশধর/ কেন তার হাত রক্তরঞ্জিত কেন সে আজ হলো জল্লাদ পশু বর্বর/ তবে তাকে কে ফেরাবে বলো, রক্তক্ষয়ী জীবনের ধারা থেকে/ ধ্বংসযজ্ঞের উন্মাদনায় বিকৃত মানসিকতায় রেখে/ তোমার সন্তান আজ যুদ্ধাপরাধী রক্ষায় দেখ জঙ্গী অবস্থানে/ হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞে নেমে জানোয়ারই গিয়েছে দেখি বনে।”
×