ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বের সবচেয়ে দামী মাছ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৯ জুলাই ২০১৬

বিশ্বের সবচেয়ে দামী মাছ

বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বা দামী এ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ হলো এশিয়ার এরোয়ানা। এটি আসলে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মিঠেপানির মাছ। স্বাভাবিক মুক্ত জীবনে এই মাছ তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে! অতি হিংস্র শিকারি এই মাছটি সেই ডাইনোসরের যুগ থেকে আছে। এর রয়েছে বড় বড় বেশ শক্ত আঁশ যা ধাতুর সঙ্গে তুলনীয়। কিংবা বলা যেতে পারে পয়সার মতো। চিবুক থেকে বেরিয়ে এসেছে গোঁফের মতো লম্বা জিনিস। চীনা নববর্ষের কুচকাওয়াজে কাগজের তৈরি ড্রাগন যেভাবে তরঙ্গায়িত হয় এগুলোও সেভাবেই তরঙ্গায়িত হয়ে চলে। এই সাদৃশ্য থেকে এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে এরোয়ানা সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে। আর সে কারণেই মাছটির এত অত্যাধিক কদর। সে কারণেই এ্যাকোয়ারিয়ামে এই মাছটি রাখতে সবাই এত ব্যগ্র। বলাবাহুল্য মুক্ত জলাশয়ে এই মাছটি অতি বিরল। মাছ গুটি কয়েক এশিয়ান এরোয়ানা বোর্নিও’র অরণ্যের গভীরে নদ-নদীতে টিকে আছে। তারপরও দেশে-বিদেশের এ্যাকোয়ারিয়ামে এই মাছটি দেখতে পাওয়া যায়। কারণ এই মাছ মৎস্য খামারগুলোতে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। শুনতে হেয়ালি বলে মনে হয়। কারণ যে মাছ অতি বিরল, মুক্ত অবস্থায় যে মাছ বহুলাংশে নিঃশেষ হয়ে গেছে সেটি এখন হাজারে হাজারে লাখে লাখে প্রজনন করা হচ্ছে খামারে। প্রাণী সংরক্ষণের আধুনিক ইতিহাসে এমন নজির দ্বিতীয়টি নেই। এমিলি ভয়েগট নামে এক মহিলা এশিয়ান এরোয়ানার তথ্যানুসন্ধানে ১৫ দেশ ঘুরে বেরিয়ে ‘দি ড্রাগন রিহাইন্ড দ্য গ্লাস; ‘এ ট্রু স্টোরি অব পাওয়ার, অবসেশন এ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ডস মোস্ট কভেটেড ফিশ’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তাতে তিনি এই মাছটির উপর বেশ চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশন করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। এক আন্তর্জাতিক মৎস্য প্রতিযোগিতায় গিয়ে তিনি দেখতে পান যে, ১০টি বিরল এলবিনো এরোয়ানাকে পুলিশের মোটার শোভাযাত্রায় আনা হয়েছিল। সশস্ত্র প্রহরীরা এই মাছগুলোর নিরাপত্তায় ছিল। এমন একটি মাছের সর্বোচ্চ দাম ৩ লাখ ডলার পর্যায় উঠেছিল বলে তিনি জানতে পারেন। ঐ দামে মাছটি নাকি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা কিনেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার এক প্রেসিডেন্ট কিনেছিলেন ২০ হাজার ডলারে আরও জানতে পারেন যে যুক্তরষ্ট্রে এরোয়ানা আমদানি নিষিদ্ধ হলেও সাম্প্রতিককালে প্রায় ২০ লাখ এরোয়ানা গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেদেশে পাঠানো হয়েছে। এগুলো উৎপাদিত হয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের খামারে। খামারগুলো উঁচুমাত্রার নিরাপত্তা সংবলিত কারাগারের মতো সেখানে রয়েছে উঁচু কংক্রিটের ওয়াল, ওয়াচটাওয়ার, কাঁটাতারের বেড়া ও প্রহরী কুকুর। এ সবই শুধু একটা মাছের জন্য। ১৯৭০ এর দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিপন্ন প্রজাতিগুলোকে রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগী হয়ে উঠে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ জাতীয় প্রজাতির কেনাবেচা, আমদানি রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। সে সময় এশিয়ার এরোয়ানা ছিল একটা সাধারণ মাছ। জলাভূমি এলাকায় লোকে একটি খেত বটে তবে তেমন একটা সুস্বাদু মাছ ছিল না বরং কাঁটাসর্বস্ব। কিন্তু এটা ছিল হিংস্র শিকারি মাছ এবং প্রজনন ছিল মন্থর। কাজেই শেষ পর্যন্ত এর ঠাঁই হয় সংরক্ষিত প্রজাতির তালিকায়। এর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। সেই নিষেধাজ্ঞাই বুমেরাং হয়ে ওঠে। এই বিরল মাছটির চাহিদা বহুলাংশে বেড়ে যায়। এ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ হিসেবে এর নতুন বাজার সৃষ্টি হয়। মাছটি দামী পণ্যে পরিণত হয়। এরোয়ানা চাষের জগতে যিনি মধ্যমণি হয়ে আছেন তিনি কেনি ইয়াপ। এশিয়ার অন্যতম সর্ববৃহৎ শৌখিন মৎস্য খামারের মালিক তিনি। এ জাতীয় মাছের ব্যবসার একটা অন্ধকার দিকও আছে। যেমন মৎস্য ডাকাতি। ডাকাতদল রীতিমতো হামলা চালিয়ে মাছ লুটে নেয়। অবশ্য কেনি ইয়াপের মৎস্য খামারের নিরাপত্তা এতই অটুট যে ডাকাতি দূরের কথা, অলঙ্কারের মতো একটা মাছ কোনভাবে চুরি করে নেয়াও সম্ভব নয়। এরোয়ানা মাছের জীবতাত্ত্বিক নাম ওস্টিও গ্লোসিড। এটা আদিম যুগের মাছ। সেই টারসিয়ারি যুগের শেষভাগ থেকে এই মাছের অস্তিত্বের ফসিল রেকর্ড আছে। কিছু কিছু প্রজাতির সন্ধান মিলেছে দক্ষিণ আমেরিকায়, আফ্রিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়। তবে এশিয়াতেই সর্বাধিক প্রজাতিকে দেখতে পাওয়া গেছে। এরোয়ানা শিকারি মাছ। এরা লাফ দিতে অসাধারণ পারদর্শী। দক্ষিণ আমেরিকায় নদীর বুকের কাছে নেমে আসা গাছের ডালপালা থেকে কীটপতঙ্গ এমনকি পাখি ধরার জন্য তারা জলপৃষ্ঠ থেকে ছ’ফুট উঁচু লাফিয়ে উঠতে পারে। এজন্য সেখানে এই মাছকে ‘জলবাঁদর’ বলেও থাকে অনেকে। শিকারি মাছ হলেও বেশ কিছু প্রজাতির এরোয়ানা যথেষ্ট সন্তানবাৎসল। তারা নদ-নদীর সুবিধাজনক জায়গায় বাসা বাঁধে এবং বাচ্চা ফোটার পর সেগুলোর নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত থাকে। এরা বাবা-মা নির্বিশেষে মুখে ডিম ধারণ করে রাখে। কখনও কখনও এমন মাছের মুখে শত শত ডিম থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা হবার পর বেশ কিছুদিন ছানারা বাবা-মায়ের মুখেই থেকে যায়। মাঝে মাঝে ছানারা বাবা-মার মুখ থেকে বের হয়ে আশপাশের তল্লাট রেকি করে আসে। এভাবে এক সময় তারা পাকাপাকিভাবেই বেরিয়ে আসে। বিলুপ্তপ্রায় হলেও বর্তমানে দশ প্রজাতির এরোয়ানা এ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ হিসেবে রাখা হয়। তার মধ্যে এশিয়ার প্রজাতির সংখ্যাই বেশি। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×