ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফায়দা হাসিল করতে চাইছে একটি মহল

জঙ্গী নিয়েও রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৯ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী নিয়েও রাজনীতি

ওবায়দুল কবির ॥ জঙ্গী নিয়েও থেমে নেই রাজনীতি। রাষ্ট্র, সমাজ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষের বর্তমানে প্রধান সঙ্কট এই ইস্যুতেও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় মত্ত একটি মহল। জঙ্গী দমনে প্রতিটি পদক্ষেপ বিতর্কিত করে এরা ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। বর্তমান সময়ের এই সামাজিক ক্যান্সারকে এরা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ক্ষমতার মসনদ ছাড়া এদের কাছে যেন জগতের সবকিছুই তুচ্ছ। এমন রাজনীতি জঙ্গী তৎপরতার মতোই সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে দেশের বিবেকবান মানুষ মনে করে। গুলশান ও শোলাকিয়ার জঙ্গী হামলার ঘটনার পর রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক শোনা যায়। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন এক সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গী তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি এর ভয়াবহ ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন। জঙ্গী দমনে তিনি জাতীয় ঐক্য গড়ারও আহ্বান জানান। বিএনপি নেত্রীর এই আহ্বান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়। ক্ষমতাসীন দল এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান না করে এর সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ঐক্যের আহ্বানের পরদিন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেশ স্পষ্ট করে বলেন, জঙ্গীবাদের পেছনে জামায়াতে ইসলামী রয়েছে বলে দেশের মানুষ মনে করে। এরা সঙ্গে থাকলে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য সম্ভব নয়। বক্তৃতা, বিবৃতি এবং প্রচার মাধ্যমের আলোচনায় আওয়ামী লীগ নেতা, দেশের বুদ্ধিজীবী ও সিনিয়র সাংবাদিকরাও একই মন্তব্য করেন। বিএনপি সমর্থিত অনেক বুদ্ধিজীবী প্রকাশ্যেই জামায়াত ছেড়ে ঐক্য করার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রতি আহ্বান জানান। খালেদা জিয়ার অন্যতম উপদেষ্টা ও ঢাবির সাবেক ভিসি এমাজউদ্দিন আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, আপাত হলেও জামায়াতকে সাইডে রেখে বিএনপির ঐক্য করা উচিত। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বুদ্ধিজীবীরা তার সামনে বসেই জামায়াত ছাড়ার অনুরোধ জানান। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাও নাম-পরিচয় গোপন রেখে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষে তাদের মত প্রকাশ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার জন্য তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দলীয় নেতাদের মনোভাব, সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা, বিবৃতি এবং সামাজিক প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক চাপাচাপি সত্ত্বেও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে খালেদা জিয়া একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। উপরন্তু তিনি বিশ দলীয় জোট নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে সকলকে জানিয়ে দিলেন, আর যাই হোক জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, লন্ডন থেকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারপার্সন তারেক রহমানও নাকি জামায়াত না ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। বিএনপির এমন মনোভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জঙ্গী তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিএনপি বা বিশ দলের প্রয়োজন নেই। দেশের প্রতিটি মানুষই এখন এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। দলের নেতারা ঘোষণা দেন, বিএনপি ছাড়াই দেশের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় তারা সক্ষম। জঙ্গী ইস্যুতে বিএনপি প্রধানের জাতীয় ঐক্যের ডাক আরও অর্থহীন হয়ে পড়ে তারই পরবর্তী বক্তব্যে। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেন। জঙ্গী দমনে ব্যর্থতায় বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবি করে তিনি নতুন নির্বাচনের দাবি তোলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সরকার পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিলেই এসব জঙ্গী হামলা বন্ধ হবে। খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের পর সারাদেশেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের নেতারাও পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যেই সুস্পষ্ট প্রমাণ করে যে, বর্তমানে যেসব জঙ্গী-সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে বিএনপির একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের সমাপনী বক্তব্যেও এ বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, বিএনপি নেত্রী শর্ত দিয়েছেন, সরকার নির্বাচন দিলেই এসব জঙ্গী হামলা বন্ধ হবে। তার মানে এসব ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। জঙ্গী হামলা নিয়ে রাজনীতির এখানেই শেষ নয়। গুলশান-শোলাকিয়ার নারকীয় ঘটনার ২৬ দিনের মাথায় ঘটে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গীবিরোধী অভিযান। এতে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নিহত হয় ৯ জঙ্গী। এই ঘটনার পর আরও স্পষ্ট হতে থাকে বিএনপির অবস্থান। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতারা সন্দেহ প্রকাশ করেন, নিহত ৯ আদৌ জঙ্গী কিনা। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ (অব) এক অনুষ্ঠানে বলেন, শত শত পুলিশ মিলে ৯ জনকে হত্যা করেছে। তাদের গ্রেফতারও করা যেত। গ্রেফতার করা গেলে তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়া যেত। তাদের গ্রেফতার না করে হত্যা করার কারণে প্রশ্ন ওঠে, এরা আদৌ জঙ্গী কিনা। বিএনপি নেতাদের এই বক্তব্যের স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানায় ক্ষমতাসীন দল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা নিহত ৯ জন জঙ্গী কিনা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা কল্যাণপুরের ঘটনার সঙ্গে গুলশানের ঘটনারও তুলনা করেছেন। কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এ দুটি ঘটনার তুলনা করা সম্ভব নয়। গুলশানে হামলা চালিয়ে ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। অভিযান চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। সারা দুনিয়ায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে তাই হচ্ছে। কল্যাণপুরে যেসব জঙ্গী নিহত হয়েছে তাদের কাছে একই ধরনের পোশাক, আলখেল্লা, পাগড়ি ও ব্যাগ ছিল। এর পরও বিএনপির নেতাদের সন্দেহ কেন? তাহলে কি এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসীর সঙ্গে বিএনপির গোপন সম্পৃক্ততা রয়েছে? যেখানেই যারা ধরা পড়ছে তদন্তের পর দেখা যাচ্ছে সবার গোড়া এক জায়গায়। এসব সন্ত্রাসী ঘটনার তদন্তে আগামীতে আরও অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে।’ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, জঙ্গী নিয়ে বিএনপির সন্দেহ প্রমাণ করে তারা দেশের জঙ্গী দমন চায় না। জঙ্গী দমনে খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের ডাক ছিল একটি প্রহসন মাত্র। শুরুটা হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম দিয়ে। এই প্রচার মাধ্যমটিতে কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গী হত্যা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এর সূত্র ধরে ফেসবুক-টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মহল নানা প্রশ্ন উত্থাপন শুরু করে। এর মধ্যে ছিল পরিচয় না জেনে জঙ্গী বলা হচ্ছে কিভাবে, সবাই জঙ্গী কিনা, জঙ্গীদের মেরে ফেলা হয়েছে কেন, রাতে জঙ্গীরা কালো পাঞ্জাবি-জিন্স ও কেডস জুতা পরে ঘুমায় কিনা ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের জবাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেয়া হয়েছে। ফেসবুকে একজন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, গুলশানে জঙ্গী হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তারা বলেছিলেন, এত বড় একটা ঘটনার কোন আগাম সংবাদই গোয়েন্দারা পেল না কেন? কল্যাণপুরে গোয়েন্দাদের আগাম তথ্যে অভিযানের পর তারাই আবার প্রশ্ন করছেন, অভিযানে নিহতরা সত্যিই জঙ্গী কিনা। কেন এভাবে তাদের হত্যা করা হলো। গোয়েন্দাদের বাহবা দেয়া দূরের কথা এই অভিযানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি বেশ হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাহলে কি করবে। কিছুটা অভিমানের সুরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স-ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম তার স্ট্যাটাসে লেখেন, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড নিক্ষেপে পুলিশের ৪ কর্মকর্তার মৃত্যু, আহত ৪২ কর্মকর্তা, তিন জঙ্গী গ্রেফতার হলেও বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। দুঃখিত, বন্ধু, এ রকম একটা খবর যদি আপনি আশা করে থাকেন তাহলে আমরা আপনার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি! প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় আপনি যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমরা সত্যিই দুঃখিত! ‘নাম-ঠিকানা না জেনে জঙ্গী বলছেন কিভাবে’? ‘জঙ্গীরা এ রকম পাঞ্জাবি, কেডস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল কেন’? ‘চারটি পিস্তল দিয়ে কিভাবে সারারাত মুহুর্মুহু গুলি চালানো সম্ভব’? ‘কেন তাদের জীবিত ধরা গেল না’? এ রকম অনেক যৌক্তিক প্রশ্ন কারও মনে আসতেই পারে। আমি যদি বলি, আপনি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। এই বক্তব্য আপনি খ-াবেন কি করে? গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে যে প্রতিবশীরা বলছে, ওই বাসার লোকেরা সারারাতই কথিত জিহাদের স্বপক্ষে সেøগান দিয়েছে। তাদের রুমে কথিত আইএসের পতাকা পাওয়া গেছে। প্রচুর উগ্রবাদী বইপুস্তক পাওযা গেছে। তারপরও এরা জঙ্গী কিনা তা বোঝার জন্য কি রিসার্চের প্রয়োজন আছে? আনুমানিক রাত একটার কাছাকাছি পুলিশের প্রথম দলটি বাসাটিতে নক করে এবং প্রথম দফা সংঘর্ষের পরে প্রায় সারারাত বিল্ডিংটা কর্ডন করে রাখা হয়। চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয় ভোর পাঁচটা ৫০ মিনিটের দিকে। এত দীর্ঘ সময় তারা ঘুমিয়েছিল কিনা, এই পোশাক পরার সময় পেয়েছিল কিনা তা বোঝার জন্য বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা; দয়া করে ভেবে দেখবেন কি? সারারাত মুহুর্মুহু গোলাগুলি হয়েছে এ রকম কোন তথ্য আমার জানা নেই। আমি যতটুকু জানিÑ যখনই পুলিশ বাসাটিতে ঢোকার চেষ্টা করেছে তখনই গুলি চালানো হয়েছে। চূড়ান্ত অভিযান হয়েছে এক ঘণ্টার কাছাকাছি। ওই সময়ই মূলত চূড়ান্ত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আমার বিশ্বাস, এ তথ্য আপনার অজানা নয়। তাহলে কেন এ রকম প্রশ্ন তুলছেন? পুলিশের সাফল্য মানতে পারছেন না, তাই তো! আপনি তো সবজান্তা; অথচ আপনি এই ধরনের অপারেশনের ইতিহাস জানেন না। দেশ এবং দেশের বাইরে কোথায় এ ধরনের অপারেশনে কতজন জীবিত গ্রেফতার হয়েছে জানালে বাধিত হবো। আসলে, পুলিশের কেউ মারা যায়নি কিংবা কেউ গুরুতর আহত হয়নি-এতেই তো আপনার যত আপত্তি, তাই না, বন্ধু!
×