ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী তৈরির কারখানা রেটিনা, ফোকাস বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে জনতা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৮ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী তৈরির কারখানা রেটিনা, ফোকাস বন্ধের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে জনতা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘এসো নবীন দলে দলে, ছাত্রশিবিরের পতাকা তলে’ কিংবা ‘দাবার চালে ভুল করিলে রাজা খতম, সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তির জন্য সঠিক কোচিং না চিনিলে আপনি খতম’Ñ এমন আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নিজস্ব কোচিং সেন্টারে জঙ্গী তৎপরতা নিয়ে আবার আলোচনায় জামায়াত-শিবির। রাজধানীতে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় আটক জঙ্গী হাসান শিবিরের মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং রেটিনার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য বেরিয়ে আসার পর জনরোষের মুখে জঙ্গী তৈরির কারখানা হিসেবে খ্যাত শিবিরের কোচিং। জানা গেছে, সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তির অন্তত ১২টি কোচিং থেকে শিবির বছরে আয় করছে শত কোটি টাকারও বেশি, যা দিয়েই চলছে শিবিরের উগ্রবাদী কর্মকা-। এ অর্থ যাচ্ছে জামায়াতের মদদে সক্রিয় অন্যান্য উগ্রবাদী সংগঠনের কাছেও। এদিকে বগুড়ার জঙ্গী হাসান আটকের পর তার পরিবারও স্বীকার করেছে, সে রেটিনায় কোচিং করার কথা বলে এক বছর আগে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। তথ্য বেরিয়ে আসার পর দাবি উঠেছে শিবিরের কোচিং সেন্টার বন্ধের। বগুড়া শহরের সূত্রাপুর রিয়াজ কাজী লেন ও আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ছাত্রশিবির পরিচালিত রেটিনা-ফোকাস কোচিং সেন্টারে মঙ্গলবার রাতে ভাংচুর চালিয়ে আগুন দিয়েছে জনতা। এতে কোচিং সেন্টারের ভেতরে রক্ষিত চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে গেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের একটি ইউনিট দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে শহরের পৃথক এলাকায় অবস্থিত দুটি কোচিং সেন্টারেও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, রাত ৯টার দিকে প্রথমে শহরের সূত্রাপুর রিয়াজ কাজী লেনে অবস্থিত ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা-ফোকাস কোচিং সেন্টারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এর মাত্র আধঘণ্টা পর দুর্বৃত্তরা একই কায়দায় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত রেটিনা-ফোকাস কোচিং সেন্টারে আগুন দেয়। এ সময় দরজা ভেঙ্গে কোচিং সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করে ভাংচুর চালানো হয়। জানা গেছে, এ বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল ও অস্তিত্ব রক্ষায় সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে ধর্মীয় জিকির তুলে সঙ্কট সৃষ্টি করা, অন্যদিকে যে কোন কর্মসূচীতে কোচিং সেন্টারকে সক্রিয় রাখতে জামায়াতের শীর্ষপর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। নির্দেশ দেয়া হয়েছিল জামায়াতের যে কোন কর্মসূচীতে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিবির নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে হবে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিবিরের দেশব্যাপী শক্তিশালী সংগঠন হয়ে ওঠার পেছনে মূলশক্তি হচ্ছে কোচিং সেন্টারের বিপুল অর্থ। দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী লিফলেট বিলি ও নাশকতা সৃষ্টির সঙ্গে শিবিরের কোচিং সেন্টারের ছাত্র নামধারী শিবির ক্যাডারদের সক্রিয় থাকতে দেখা যায় সব সময়। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল, অবরোধের সময়েও দেখা গেছে শিবিরের কোচিং সেন্টারের অপতৎপরতা। এমনকি জামায়াতের হরতালে কল্যাণপুরের যে বাড়িতে জঙ্গীরা ছিল সেখান থেকে মিছিল করতে বের হতো বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন এলাকাবাসী। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে অন্তত ১২টি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যেও পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে ছাত্রশিবির। এসব কোচিং সেন্টারের আয়ের টাকা জমা হচ্ছে শিবিরের ফান্ডে। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে শিবির কর্মীদের দেয়া হচ্ছে সাংগঠনিক তালিম। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য রয়েছে শিবির পরিচালিত ভর্তি কোচিং সেন্টার। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য ফোকাস, মেডিক্যাল ভর্তির জন্য রেটিনা, ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তির জন্য কনক্রিট-কনসেপ্ট কোচিং সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ও বিস্তৃত। এগুলো চলছে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের নামে। পরিচালিত হচ্ছে শিবিরের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের সক্রিয় নির্দেশনায়। এসব কোচিং সেন্টারের রয়েছে অন্তত ৫০টি শাখা। প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ছাত্রছাত্রী এখানে ভর্তি হচ্ছে। তবে ভর্তির আগেই দেশব্যাপী চলে শিবিরের প্রচারাভিযান। উগ্রবাদী আদর্শে টেনে আনতে দেশব্যাপী চলে নানা অফার দিয়ে কাছে টানার কার্যক্রম। সারাদেশের কলেজের শিবির নেতাকর্র্মীরা তো বটেই, তারা প্রত্যেকেই আবার নিয়ে আসেন তাদের মতাদর্শের ছাত্রদের। শিবির পরিচালিত এসব কোচিং সেন্টারে সাধারণ শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয় না। শিবিরের কোন না কোন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে শিবির ক্যাডারদের পুনর্বাসিত করা হয়। শিবিরের নেতৃস্থানীয় নেতাদের সুপারিশপত্র দেখাতে হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর জামায়াতপন্থী শিক্ষক এসব কোচিং সেন্টারের উপদেষ্টা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে থাকেন তারা। এখানে ভর্তির জন্য বইয়ের পাশাপাশি শিবির প্রকাশিত ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কিত বই, শিবিরের গঠনতন্ত্র, মওদুদী ও গোলাম আযম, নিজামী, সাঈদীর বই পড়ানো ও সরবরাহ করা হয়। ঢাকায় কোচিং সেন্টারগুলোতে সরেজমিন দেখা গেছে, শিবিরের বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ক্লাস রুমে ঝুলানো। এছাড়া রয়েছে এসব কোচিং সেন্টারের ভর্তি ফরম ও লিফলেট। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের রাজনীতির ওপর কড়াকড়ি থাকায় কোচিং সেন্টারগুলোতে নির্দ্বিধায় চলে শিবিরের কার্যক্রম। বিশেষ করে রাতে, প্রতি শুক্রবার এবং যে সময় কলেজে ক্লাস থাকে না সে সময় কোচিং সেন্টারে সাংগঠনিক কাজ করা হয়ে থাকে। কোচিং সেন্টারগুলোতে রাতে শিবির ক্যাডারদের উগ্রবাদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে ভর্তি করে শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়। পরে এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই তাদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ায় শিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। রেটিনা হচ্ছে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে শিবির মালিকানার ভর্তি কোচিং সেন্টার। দেশে মেডিক্যাল পর্যায়ে সবচেয়ে বড় কোচিং সেন্টার হচ্ছে শিবির পরিচালিত রেটিনা। ১৯৮০ সালে শিবিরের তত্ত্বাবধানে রেটিনা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম পরিচালক সোহরাব হোসেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিবিরের সাবেক সভাপতি। বিভিন্ন হিসাব থেকে দেখা গেছে, শিবিরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে আয়ের একটা বড় অংশ শিবিরের সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করা হয়। পাশাপাশি শিবির নেতাকর্মীদের অর্থনৈতিক কর্মকা-েও সহযোগিতা করা হয়। কেবল ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও চিটাগাং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট রিচার্স ফাউন্ডেশন পরিচালিত ইনডেক্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল মালেক ফাউন্ডেশন পরিচালিত ফোকাস, রেটিনা ফাউন্ডেশনের মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল এ্যাডমিশন কোচিং রেটিনা, কনক্রিট ফাউন্ডেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড আর্কিটেকচার ভর্তি কোচিং কনক্রিট ও প্রবাহসহ মোট ৫টি কোচিং সেন্টার শিবির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের নামে পরিচালিত হলেও মূলত তা সরকারের নজর এড়ানোর বিশেষ কৌশল বলে জানা গেছে। শিবিরের কোচিং সেন্টার দেখভাল করেন এমন এক শিবির নেতা জানান, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবির সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ নাঈম ও সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ শিহাব উল্লাহ যথাক্রমে ইনডেক্সের প্রধান পরিচালক ও পরিচালক ছিলেন। চবি শিবির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকার বলে ইনডেক্সের প্রধান পরিচালক ও পরিচালক হয়ে থাকেন। চট্টগ্রামে প্রবাহ কোচিং সেন্টার পরিচালিত হয় মহানগর শিবিরের অধীনে। প্রধান হন মহানগর শিবির সভাপতি। ছাত্রশিবির পরিচালিত দেশের সবচেয়ে বড় কোচিং সেন্টার ‘ফোকাস’। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিহত ছাত্রশিবিরের সাথী আবদুল মালেকের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘শহীদ আবদুল মালেক ফাউন্ডেশন’ এটি পরিচালনা করছে। উভয় প্রতিষ্ঠানেরই কর্তাব্যক্তিরা জামায়াত ও শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সুপরিচিত নেতা ও ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় তিনি বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। ফাউন্ডেশনের অন্য ১৩ সদস্য শিবিরের সাবেক বা বর্তমান নেতা, বিশ^বিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষক এবং ইসলামী ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা। ফোকাস কোচিংয়ের মহাপরিচালক ও মালেক ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মীর্জা গালিব ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিবিরের শীর্ষনেতা এবং ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগের ছাত্র। ফোকাসের পরিচালনা পর্ষদের অন্য সবাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিবির নেতা। ঢাকায় চারটিসহ সারাদেশে ফোকাসের মোট ৩০টি শাখা আছে। ফার্মগেটে প্রধান শাখা। এখানে রেটিনারও প্রধান শাখা। এদিকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভর্তি মৌসুমের আগে কোচিং সেন্টারের আশপাশে শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী মেস চালু করা হয়। কোচিংয়ের কয়েকজন সাবেক ছাত্র জানান, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ইসলামী বইপত্র, শিবিরের বিভিন্ন গানের ক্যাসেট বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। সরবরাহ করা ভর্তি গাইডের প্রতি পৃষ্ঠার নিচে কোরান ও হাদিসের বাণী মুদ্রিত আছে। জানা গেল, সিলেটে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ‘রেডিয়াম’ এবং মেডিক্যালে ভর্তির জন্য ‘রেটিনা’ কোচিং সেন্টার শিবিরের সক্রিয় প্রতিষ্ঠান। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘নিউক্লিয়াস’, ‘সানরাইজ’ প্রভৃতি নামে ও নাম ছাড়াই আবাসিক এলাকায় বাসাভাড়া নিয়ে শিবির কর্মীরা কয়েকটি কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন। তবে দলীয় পরিচয় তারা সাধারণত গোপন রাখেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গড়ে তোলা ‘কনটেস্ট কোচিং সেন্টারের’ কার্যক্রম চলছে ২২ বছর ধরে। কনটেস্ট কোচিং সেন্টারের বর্তমান উপদেষ্টার তালিকায় রয়েছেনÑ জামায়াত নেতা সাবেক শিবির সভাপতি অধ্যাপক তাসনীম আলম, ছাত্রশিবির সভাপতি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, সাবেক শিবির নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুল, রেজাউল করিম ও বর্তমান সভাপতি দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী। এ কোচিং সেন্টারের প্রসপেক্টাসে লেখা রয়েছেÑ বিশ^বিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের আবাসিক সমস্যা দূরীকরণ ও আর্থিক সমস্যাসহ সব বিষয়ে সহযোগিতা দিয়ে থাকে তারা। ‘আবাসিক সমস্যা দূর’ করতে বিনোদপুর এলাকায় শিবিরের পরিচালনায় চালু রয়েছে ছাত্রাবাস। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রগুলো বলছে, শিবিরের কোচিং সেন্টার নিয়ে আগেই নজরদারি ছিল। কিন্তু এখন নানা তৎপরতার খবর পাওয়ায় নতুন করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
×