ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষমা চাইতে হলো যাত্রীদের

বিআরটিসির ডিপোতে জিম্মি করে যাত্রীদের ওপর হামলা

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৬

বিআরটিসির ডিপোতে জিম্মি করে যাত্রীদের ওপর হামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির থেকে সকাল আটটায় গুলিস্তানের উদ্দেশে ছেড়ে আসে একটি বিআরটিসি ডাবল ডেকার বাস। মুগদা পর্যন্ত এক কিলোমিটারের কম রাস্তা পৌঁছাতে সময় লাগে অন্তত ৩০মিনিট! এরমধ্যে অন্তত ছয়বার যাত্রী তোলা হয়েছে। বাসের উপরে নিচে তিল ধারণের কোন ঠাঁই ছিল না। অফিস টাইম। বারবার বাস থামানো ও যাত্রী ওঠানো নিয়ে সবাই প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কে শোনে কার কথা। এক পর্যায়ে টিটিপাড়া রেল লাইনের কাছে আসার পর ভাড়া তোলা শুরু হয়। মতিঝিল পর্যন্ত জনপ্রতি ১০টাকা ভাড়া দাবি করেন কন্ডাক্টর। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। যাত্রীরা জনপ্রতি ৫টাকা দিতে চাইলে কন্ডাক্টর বাস রাস্তার পাশে চাপিয়ে দিয়ে যাত্রীদের নেমে যেতে বলেন। ফের যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে দু’জন যাত্রীর গায়ে হাত দেয় কন্ডাক্টর। এ নিয়ে বাসে দেখা দেয় চরম উত্তেজনা। এক পর্যায়ে এক যাত্রী ছাতা দিয়ে কন্ডাক্টরের গায়ে আঘাত করে। আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন কন্ডাক্টর। বারবার হামলাকারী যাত্রীকে মারতে তেড়ে আসেন তিনি। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। এক পর্যায়ে মোবাইলে কমলাপুর ডিপোর লোকদের ঘটনা জানিয়ে হামলার প্রস্তুতি নিতে বলেন! দ্রুত বাসটি চালিয়ে ৮টা ৪০মিনিটে কমলাপুর বিআরটিসি ডিপোতে ঢুকানো হয়। এসময় যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও চালক কান দেননি। এমনকি বাসের কয়েকজন যাত্রী ঘটনা মীমাংসা করার চেষ্টা করলেও কন্ডাক্টর একেবারেই বেপরোয়া আচরণ করতে থাকেন। বলেন, ‘ছয় নম্বর বাসে এ ঘটনা হলে তোদের বাসের চাকায় পিসে দিতাম।’ ঘটনা মঙ্গলবার সকালের। প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীরা জানিয়েছেন, কমলাপুর ডিপোতে বাসটি নেয়ার পর সেখানের লোকজন দ্রুত গেট লাগিয়ে দেন। প্রায় অর্ধশত লোক পুরো বাসটি ঘিরে ফেলেন। তারা জিম্মি করেন দেড় শতাধিক যাত্রীকে। কারও কারও হাতে লাঠি ও লোহার রড ছিল। আতঙ্কিত যাত্রীদের কেউ কেউ লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে কন্ডাক্টরসহ কয়েকজন লোক ছাতা দিয়ে বাড়ি দেয়া যাত্রীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনতে বাসে ওঠেন। অন্য যাত্রীরা তাদের নিবারণের চেষ্টা করলে অনেকেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। বাইরে থেকে বিআরটিসি কর্মীরা যাত্রীদের গালাগাল করছিলেন। ‘জীবনের শিক্ষা আজ দেয়া হবে’ এমন কথা উচ্চারিত হচ্ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দু’জন আনসার সদস্য বাঁশি বাজিয়ে ঘটনাস্থলে আসার চেষ্টা করলেও তাদের আসতে দেয়া হয়নি। বাসের ভেতর থেকে কয়েকজন যাত্রী হামলাকারীদের কাছে ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করলে তারা যাত্রীদের গালাগাল করেন। এক পর্যায়ে কয়েকজন প্রতিবাদকারী যাত্রীকে গলা ধাক্কা এমনকি টেনেহিঁচড়ে ডিপো থেকে বের করে পকেট গেটও লাগিয়ে দেয়া হয়। কয়েকজন যাত্রী ডিপোর দ্বিতীয় তলায় ম্যানেজারের রুমে প্রবেশ করতে চাইলে বলা হয়, সেখানে গিয়ে লাভ নেই। ম্যানেজার এখনও আসেননি। তখন কয়েকজন লোক ছাতা দিয়ে বাড়ি দেয়া যাত্রীকে বাসের ভেতর থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনেন। তখন উপস্থিত যাত্রীরা বারবার না মারতে সবাইকে অনুরোধ করছিলেন। কেউ কেউ নিজে থেকেই যাত্রীর পক্ষে ক্ষমা চাচ্ছিলেন বারবার। এরপর নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলা হয় যাত্রীকে। এতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে মারতে উদ্যত হন বিআরটিসি কর্মচারীরা। পরে যাত্রীদের অনুরোধে হামলাকারী যাত্রী ক-াক্টরের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চান। এবং তিনি বলেন, ‘মাথা ঠিক ছিল না। তাই রাগের বশে ছাতা দিয়ে বারি দিয়েছেন তিনি।’ পুরো ঘটনা অসহায়ের মতো দেখতে হয়েছে বাস যাত্রীদের। এমনকি কন্ডাক্টরের ঔদ্ধত্য ও যাত্রীদের ওপর হামলার বিষয়টিও বলতে দেয়া হয়নি। একতরফা যাত্রীদের ওপর দোষ চাপানো হয়। বলা হচ্ছিল, ‘যেই প্রতিবাদ করবে তাকেই পেটানো হবে। কেউ বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে জীবন নিয়ে ফিরতে দেয়া হবে না। গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হবে।’ এক পর্যায়ে বাসটি আবারও ৮টা ৫৫ মিনিটে ডিপো থেকে বেরিয়ে আসে। তখন বেশিরভাগ যাত্রীই বিকল্প পথে গন্তব্য পৌঁছান। এ ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন উপস্থিত যাত্রীদের সবাই। বিআরটিসির সেবার মান ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচড়ন কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না উপস্থিত সবাই। বলছিলেন, একদিকে সেবার মান নেই। অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিআরটিসিতে। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের সেবার প্রতি মানুষের এখন আর কোন আস্থা নেই। যে কারণে বিআরটিসি বাসে যাত্রীরা উঠতে চান না। ঘটনাস্থলে উপস্থিত অপূর্ব নামের এক যাত্রী জানান, বারবার যাত্রী তোলা ও বাসটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় যাত্রীরা প্রতিবাদ করছিলেন। এ থেকেই মূলত ঘটনার সূত্রপাত। এরপর বাসের কন্ডাক্টর থেকে শুরু করে বিআরটিসি ডিপোর কর্মচারীদের ঔদ্ধত্য সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন। যা কোন সভ্যতার মানদ-ে পড়ে না। জনকণ্ঠ’র পক্ষ থেকে পুরো ঘটনা বিআরটিসির পরিচালক অপারেশন মোঃ শামসুল আলমকে জানানো হয়। তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে কমলাপুর ডিপো ম্যানেজারের কাছে খোঁজ নিয়েছি। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে পুরো ঘটনা বিআরটিসি পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল এ আর পারভেজ মজুমদারকে জানানো হলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি কর্তৃপক্ষতে জানানো হয়েছে। খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমলাপুর ডিপো ম্যানেজার আশরাফুল আলম প্রথমে পুরো ঘটনা অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। এরপর তিনি বলেন, যাত্রীদের সঙ্গে বাসের লোকদের কথা কাটাকাটি হয়েছিল শুনেছি। এরপর বাসটি ডিপোর সামনে দিয়ে যাবার সময় রাস্তায় থামে। এক পর্যায়ে ডিপোর কর্মকর্তা বাদশা দু’পক্ষকে মিলিয়ে দেন। জনকণ্ঠের প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ও পুরো ঘটনার বিবরণ দিলে তিনি বলেন, তাহলে আমাকে খোঁজ নিতে হবে। হয়ত আমাকে এতকিছু জানানো হয়নি। আপনি ডিপোতে আসেন। দোষীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুরো ঘটনা জানাতে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। যাত্রীরা জানিয়েছেন, বাসটি সকালে খিলগাঁও থেকে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে আসে। সেখান থেকে ছাড়ার পর পথে পথে থামিয়ে থামিয়ে ও মুগদায় টইটম্বুর করে যাত্রী তোলা হয়। পুরো বাসে স্টাফ ছিলেন তিনজন। কন্ডাক্টরের গায়ে কালো গেঞ্জি ছিল। মুখে দাঁড়ি ছিল। হেলপারের গায়ে ছিল লম্বা চেকের শার্ট ও প্যান্ট।
×