ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্গী হই সন্তানের -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৮ জুলাই ২০১৬

সঙ্গী হই সন্তানের -স্বদেশ রায়

রাইজ অফ আইসিস বইটাতে বোগদাদীর জীবনের নানা দিকের ভেতর একটি দিক লক্ষণীয়, ছাত্র জীবনে বোগদাদী কো-এডুকেশন পছন্দ করতেন না। সেভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেন। হলি আটির্জানের ঘটনায় মৃত জঙ্গীদের কথা নানাভাবে সোশ্যাল ফোরামে তাদের বন্ধু ও পরিচিত জনের মাধ্যমে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রোহানও কো-এডুকেশন পছন্দ করত না। তার কোন মেয়ে বন্ধু তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে মাথা নিচু করে কথা বলত। তাদের দিকে তাকাত না। আমাদের অভিভাবকদের অনেকে এখন সচেতন হয়েছেন। তারা তাদের সন্তানের প্রতি যত্নবান হতে চাচ্ছেন। কিন্তু যত্নবান হতে হলে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে সেটা তাদের জানতে হবে এবং এগুলো গাইড পড়ে বা সরকারী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবটুকু হয় না। কেউ কোন গাইড লাইন দিয়ে দিতেও পারেন না। এগুলো মা-বাবাকে তার নিজ সন্তানের চরিত্র লক্ষ্য করে বুঝতে হবে। কারণ একটা বিষয় সব সময় মনে রাখা দরকার, চরিত্রের অনেক দিক থেকে মানুষ ও পশুর মিল থাকলেও কিন্তু মানুষ ও পশুর সব থেকে বড় পার্থক্য মানুষ ইনডিভিজ্যুয়াল, পশু তা নয়। যেমন সব বাঘের চরিত্র একই কিন্তু প্রতিটি মানুষই আলাদা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, কেউ সচেতন, কেউ অচেতন, কেউ চালাক অতি... আমারও চোখে সখী শুধু ঘুমঘোর। কিন্তু আমরা বেশি ক্ষেত্রে একটা ভুল করি যে, আমরা সব মানুষকে একই রকম মনে না করলেও সে নিজে যেমন তেমনি মনে করে। যেমন ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই, আমার কোন লেখায় যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সঠিক দিককে সঠিক বলি (আমার চোখে যেটা ভুল তা যে বলি না এমন দোষটি মনে হয় পাঠক আমাকে দেবেন না) তখন দেখা যায়, আমার লেখার নিচে মন্তব্য কলামে অনেকে লিখছেন, ‘মন্ত্রী সভায় যোগ দিচ্ছেন কবে?’ হাসি পায়, কীভাবে বোঝাব তাদের, আমার চোখে রাজপাট আকর্ষণীয় মনে হয় না, আমার চোখে শুধু ঘুমঘোর। তাই কার সন্তানের চোখে কী আকর্ষণীয় তা পিতা-মাতাকে বুঝতে হয়। আমি এখানে আত্মজীবনী লিখতে বসিনি, তার পরেও বলছি, যারা আমার মন্তব্য কলামে এসব লেখেন তাদের উদ্দেশে বলি, আমার বাবা তার সন্তানকে বুঝেছিলেন বলেই এই লেখালেখির কষ্টের জীবন মেনে নিতে কোন বাধা দেননি। বিজ্ঞানের কিশোর ছাত্রটিকে কবিতার বইয়ে ডুবে থাকার সব স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ভাল বইগুলো বাবা বা জ্যাঠামশাইরা হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মাফ করবেন সকলে, লেখার ভেতর ব্যক্তিগত বিষয় টেনে আনার জন্য। তবে বাস্তবতা হলো, এখন আমাদের সমাজের জন্য কঠিন সময় যে, সন্তানকে উপলব্ধি করা ও তাকে সঠিক দিকে প্রবাহিত করা। সন্তানের মনোজগত গড়তে পারে বর্তমান সময়ে তিনটি শক্তি খুব বড়। এক. পিতা-মাতা, দুই. শিক্ষক , তিন. রাষ্ট্র। হলি আর্টিজানের ঘটনার পরে সমাজের একটি বড় অংশ সচেতন হয়েছে। তবে সকলে সচেতন হয়নি। কারণ গত সপ্তাহজুড়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে, জামায়াত ও বিএনপির একটি কট্টর অংশ তারা ওই ঘটনাকে ভিন্ন রূপ দিতে চাচ্ছে। কিছু মানুষ সেটা বিশ্বাসও করছে। তার পরেও সমাজের যে বড় অংশের অভিভাবকরা সচেতন হয়েছেন, তারা কী করবেন সন্তানকে নিয়ে। আসলে হিউম্যান সাইকোলজি এত জটিল, এ নিয়ে কেউ কখনও বলতে পারে না কী করা যেতে পারে। তবে তার পরেও প্রথম যে বিষয়টি আছে তা হলো বোধের রাজ্য। সন্তানের মস্তিষ্কে একটি বোধের রাজ্য আছে সেখানটিতে ছোটবেলা থেকে যাতে চাষাবাদ হয়, যাকে রামপ্রসাদ বলেছেন, এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা। এই সোনা ফলানোর কাজটি পিতা-মাতা, শিক্ষক ও রাষ্ট্রকে করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র এখন এমনভাবে কথা বলছে যে সব দায় পিতা-মাতার। আসলে কিন্তু তা নয়, পিতা-মাতা যে দায়িত্ব পালন করবে সে পরিবেশ রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্র তার সর্বগ্রাসী চরিত্র দিয়ে সমাজকে প্রায় খেয়ে ফেলেছে। তাই হাজার হাজার বছর ধরে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল তার ওপরে এখন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলের কর্মীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্য অনেক দেশের মতো সমাজকে আমাদের এখানে পুরোপুরি বাঁচতে দেয়া হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ অবধি রাষ্ট্র কিন্তু মনোজগত গড়ার জন্য খুব বেশি কাজ করেনি। যতটুকু হচ্ছে, তা ম্রিয়মাণ সামাজিক শক্তি থেকে। যেমন মানুষের বোধের রাজ্য খুলে দেয়, সাহিত্য। সত্যি অর্থে আমাদের দেশে এ মুহূর্তে কোন সন্তানের মনোজগত গড়ার মতো কোন সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না। কিছু পপুলার লেখক আছেন। তাদের লেখা সস্তা বিনোদনের পর্যায়ে পড়ে। তাদের লেখা দিয়ে মনোজগত হয় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সব থেকে দরকার ছিল বিদেশী ভাল সাহিত্য দেশে যাতে সুলভে মেলে তার ব্যবস্থা করা। আবারও সেই পুরনো কথা লিখতে হয়। এ কলামে বহুবার লিখেছি। সৃজনশীল বই আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করা। অর্থমন্ত্রী প্রত্যাহার করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন কায়েমী স্বার্থের কাছে। যারা এই বই আমদানিতে শুল্ক রেখে নিজেদের নিম্নমানের বই বেশি দামে বিক্রি করার চক্র তৈরি করেছেন, এরাও মূলত পক্ষান্তরে আমাদের সন্তানদের জঙ্গী হতে সাহায্য করছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সব থেকে দুঃখের বিষয় আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আচরণ। গত সাত বছরেও তিনি একবারও এ বিষয়টি ভেবে দেখেননি তার এই কোটি কোটি সন্তানের মনোজগত তৈরি হবে কীভাবে? আসলে তারুণ্য ও যৌবনে তার মনোজগত যে এক রৈখিক চিন্তার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে, সেখানে এই বহুত্বকে নিয়ে চিন্তা করা তার জন্য অসম্ভব। তিনি নিজেকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় পাননি। এখন আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের ছয় কোটি যদি তরুণ সন্তান হয় তারা তো ছয় কোটি ইনডিভিজ্যুয়াল। এদের জন্য যে বহুত্বের জগত সৃষ্টির দায় শিক্ষামন্ত্রীর। সেটা তিনি বুঝছেন কিনা সন্দেহ আছে। বরং তিনি সব সময় সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেন। যেমন ২৪ তারিখ মাওলানাদের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বললেন, আমার মাদ্রাসার কোন ছাত্র জঙ্গী হয়নি। শোলাকিয়া ও হলি আর্টিজানের ঘটনায় উচ্চবিত্তদের এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্তানরা জড়িত, মাদ্রাসার কোন ছাত্র নয়। এর থেকে বোঝা যায় তিনি হলি আর্টিজানের ঘটনার নিউজগুলোই পড়েননি। সেখানে মূল নেতৃত্ব দিল বগুড়ার যে ছেলেটি সে যে মাদ্রাসার ছাত্র এটা তিনি জানেন না। অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির কম্বিনেশনের মতো জঙ্গীতেও যে উচ্চবিত্ত ও মাদ্রাসার ছাত্রদের একটি কম্বিনেশন হয়েছে এটা শিক্ষামন্ত্রী জানেন না। তাই এ মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত মানুষকে বলছেন- তা সম্পর্কে দেশের শিক্ষামন্ত্রী যদি এভাবে অজ্ঞ থাকেন তাহলে কীভাবে রাষ্ট্র সন্তানদের মনোজগত পরিবর্তন করতে সহায়ক হবে? তাই রাষ্ট্র যে খুব সহায়ক হবে এ ধারণা করা এখন ভুল হবে। কারণ একা শেখ হাসিনা কী করবেন? রাষ্ট্রের এই অক্ষমতার দায়টি কাঁধে নিতে পারতেন শিক্ষকরা। কিন্তু দলীয় রাজনীতি ও স্কুল-কলেজ লেভেলে ছাত্র পড়িয়ে বাড়তি ইনকাম এই দুই মিলে শিক্ষকদের বড় অংশ যেখানে গেছেন, তাতে করে শিক্ষকদের ওপর ভরসা কতটুকু রাখা যায়? খুব বেশি কি রাখা যাবে! তারা তাদের বেতনের বৈষম্য হলে যেভাবে দলমত ভুলে ক্ষুব্ধ হয়ে নেমে পড়েছিলেন, এখন কিন্তু তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। কিছু যে তারা করছেন না তা নয়, কিন্তু সেগুলো টেলিভিশনের পর্দায় যত বাস্তবে কি তত? যেমন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পদযাত্রা করল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন তাদের ছাত্রদের নিয়ে ওই পদ যাত্রায় গেলেন না? শিক্ষকরা সংস্কৃতি মনা নন? তাদের ছাত্ররা সংস্কৃতিমনা নয়! ওখানে কি শুধু গানের শিল্পী, নাটকের শিল্পী, আবৃত্তি শিল্পীদের যেতে হবে- আর কেউ সংস্কৃতিমনা নন? ওই দিন অল্প লোকের মিছিল দেখে মনে হয়েছিল, আজ যদি মতিন চৌধুরী স্যার থাকতেন তিনি ঠিকই পাঁচ হাজার ছেলে নিয়ে ওখানে সবার আগে উপস্থিত থাকতেন। অনেকে বলেছেন বৃষ্টি ছিল, বৃষ্টিতে সংস্কৃতিমনাদের মিছিলে তো আরও জোর হওয়ার কথা। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি মাথার ওপর ঝরলে কবিতা ও গানে তো আরও সুর আসার কথা? তাই এখন দায় দেখা যাচ্ছে পিতা-মাতার। পিতা-মাতাকে তাই অনেক সময় দিতে হবে সন্তানের জন্য। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তার মনোজগত বুঝতে হবে। সব থেকে বড় বন্ধু হতে হবে। চানক্য বলেছেন, পুত্র বারো বছরে পড়লে তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে। পুত্র হোক, কন্যা হোক দশ বারো বছরের পর থেকে ধীরে ধীরে তার সঙ্গে সব ধরনের আলোচনা করা প্রয়োজন। এ জন্য পিতা-মাতাকে সময় দিতে হবে। বর্তমানে মধ্যবিত্তের অবশ্য সময় কমে গেছে। একটা সমাজ যখন প্রথম সম্পদের স্পর্শ পায় তখন সে সমাজ ওই ধাক্কায় পড়ে যায়, অর্থাৎ সকলেই তার সকল সময়টুকু দিয়ে অর্থ সম্পদ গড়তে চায়- তার মনে থাকে না, তার সব থেকে বড় সম্পদ তার সন্তান। অতএব পরিমিত সম্পদ গড়ে সন্তানকে পরিমার্জিতভাবে গড়ে তুলি। তা হলে সে ওই সম্পদ ভোগ করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে তার প্রয়োজনীয় সম্পদ সে গড়ে নিতে পারবে। সমাজে যখন প্রথম অর্থ আসে তখন কিন্তু মানুষ থামতে ভুলে যায়, এই থামতে না পারাটাই কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যা। তবে আবার মনে রাখতে হয়, পিতা-মাতা বন্ধু হতে গিয়ে যেন তার বয়সী বন্ধুদের দূর না করে দেন। এখানেও অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে সৈয়দ মুজতবা আলী বুঝেছিলেন ওই শিক্ষা পদ্ধতি নেয়া দরকার। যে আমার গুরু শেখায় কিন্তু বুঝতে দেন না তিনি শেখাচ্ছেন। সন্তানকে এভাবেই শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করতে হয় পরিবার থেকে। এসব ছাড়াও আরও একটি বিষয় এসেছে, আধুনিক টেকনোলজি। একটি রেডিওর একজন রিপোর্টারের সিরিয়ার আইএস জঙ্গীর সঙ্গে স্কাইপেতে কথা বলা ও আরও অনেক বিষয় নিয়ে একটি রিপোর্ট ছাপা হয় গার্ডিয়ানে। রিপোর্টটি মূলত পুরো ঘটনার অংশ বিশেষ- গোটা ঘটনা নিয়ে বই বের হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ওই আইএস জঙ্গীটির দায়িত্বই হচ্ছে, তরুণ ও তরুণীদের মোটিভেটেড করে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া। সে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার অনেক কাজের ভেতর একটা হলো ওই তরুণ বা তরুণীকে পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা। তাই আপনার সন্তান টেকনোলজির সঙ্গে থাকুক কিন্তু যদি কখনও মনে হয় সে আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে তখন কিন্তু চূড়ান্ত সাবধান হওয়ার সময়। পাশাপাশি তার টেকনোলজির সঙ্গীও কিন্তু হওয়া যায়, যেমন সন্তানের রুচি মতো তার সঙ্গে বসে ভাল একটা মুভি দেখা বা তাদের জেনারেশনের একটি গান শোনা। আমরা নতুন কিছু শুনলে বিরক্ত হই। এই জেনারেশন যে গান শোনে মনে করি এগুলো চিৎকার। শুনে দেখুন কয়েকদিন ওদের সঙ্গে ওদের মেটাল মিউজিক খারাপ নয়। আপনি নিজেই না হয় একটু বদলে গেলেন, একটু আধুনিক হলেন, সময়ের সঙ্গে এলে ক্ষতি কি? উন্নত পৃথিবীর অনেক বেশি বয়স্করাও কিন্তু নতুনকে গ্রহণ করেন। এখন কিছু জায়গায় নিজেকে বদলাব কিছু জায়গায় বদলাব না এমন তো হতে পারে না। সঙ্গী হই না সন্তানের, তাতেই আখেরে লাভ হবে। নিজের সন্তান নিজের সৃষ্টি, তাকে বিকশিত করাও আরেক সৃষ্টির আনন্দ। [email protected]
×