ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তেরেসার মাঝে ‘লৌহমানবী’র ছায়া

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৭ জুলাই ২০১৬

তেরেসার মাঝে ‘লৌহমানবী’র ছায়া

২০১০ সালে যখন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারী বাসভবনে ডেভিড ক্যামেরন এসেছিলেন তার পরেই সেখানে আসে ল্যারি। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির উপদ্রব ইঁদুরগুলোকে তাড়ানো, কিন্তু কীভাবে যেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দোস্তি হয়ে যায় তার তার পর থেকে কাজে কিংবা অকাজে যারাই এসেছে ডেভিড ক্যামেরনের কাছে তাঁদের অতি পরিচিত মুখ ল্যারি? ক্যামেরনের অতি আদরের পোষ্যবিড়াল?ব্রেক্সিটের ফল ঘোষণা হওয়ার পরেই ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল ল্যারি? গত ১৩ জুলাই বুধবার ডাউনিং স্ট্রিট ছেড়ে চলে গেলেন ডেভিড ক্যামেরন ? সরকারীভাবে দায়িত্ব নিলেন টেরেসা মে মার্গারেট ‘আয়রন লেডি’ থ্যাচারের পর লন্ডনের পার্লামমেন্টে দ্বিতীয় প্রমীলা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর বুধবার সন্ধ্যায় বাকিংহাম প্যালেসে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আনুষ্ঠানিকভাবে তেরেসা মে কে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এর আগে বিকেলেই বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে রানীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ডেভিড ক্যামেরন। বুধবার পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার আগে ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্যে ক্যামেরন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছিল তার জীবনের ‘সবচেয়ে বড় সম্মান।’ বুধবার সকাল থেকেই বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায় ল্যারিকে সে বোধহয় বুঝতে পেরেছিল তার প্রভু ক্যামেরন এই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে যে অধিকারী বদল হলেও ল্যারি ডাউনিং স্ট্রিটেই থাকবে কিন্তু তার মন যে খারাপ তা স্পষ্ট মন খারাপ ব্রিটিশদের একটা বড় অংশেরও, যারা ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা টেরেসা মে, যিনি ছেলেবেলায় ব্রিটেনের ‘প্রথম নারী সরকারপ্রধান’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন বলে বন্ধুদের ভাষ্য। ৫৯ বছর বয়সী মে ফ্যাশন সচেতন, কনজারভেটিভদের মধ্যে আধুনিকতাপন্থী। তারপরও অনাড়ম্বর ও স্বল্পভাষী এই নারীর অনমনীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ‘লৌহমানবী’ মার্গারেট থ্যাচারের ছায়া খুঁজে পান সহকর্মীদের কেউ কেউ। ডাউনিং স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাড়িতে এ পর্যন্ত যারা থাকতে এসেছেন, তাদের মধ্যে বয়সের বিচারে ৫৯ বছর বয়সী মে’র অবস্থান দ্বিতীয়। ১৯৭৬ সালে নির্বাচিত জেমস কালাহানই কেবল তার চেয়ে বেশি বয়সে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আর টেড হিথের পর মে হচ্ছেন দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী, যার কোনো সন্তান নেই। গেল ১১ জুন সোমবার কনজারভেটিভ পার্টির পরবর্তী নেতা এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড় থেকে জ্বালানিমন্ত্রী আন্ড্রে লিডসম ‘হঠাৎ করেই’ সরে দাঁড়ানোয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম হয় টেরেসা মে’র। আর ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন এ্যান্ড্রিয়া। সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেয়ার সময় তিনি বলেন, ব্রিটেনের এখন শক্তিশালী, স্থিতিশীল সরকারের প্রয়োজন। আর ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে টেরেসাই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্য মানুষ।’ এর আগে গত রবিবার একটি পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, মা হওয়ার কারণেই এই পদে তিনি যোগ্যতর প্রার্থী। প্রসঙ্গত টেরেসা মের কোন সন্তান নেই। এ্যান্ড্রিয়ার এই মন্তব্যের পর সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে গতকাল বার্তা পাঠিয়ে টেরেসার কাছে ক্ষমা চান তিনি। টেরেসাও তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠান। শেষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে টেরেসার সাফল্য কামনা করেন এ্যান্ড্রিয়া। এর আগেই দলের ৬০ শতাংশ এমপির সমর্থন পেয়ে কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান নির্বাচিত হন টেরেসা। বাকি ছিল দলের সমর্থকদের ভোট। তার আগেই এ্যান্ড্রিয়া সরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিকে সহজ করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার এই দৌড়ে প্রার্থী ছিলেন পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত প্রথম পর্বের ভোটাভুটিতে ঝরে পড়েন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্স এবং কর্ম ও পেনশনবিষয়কমন্ত্রী স্টিফেন ক্র্যাব। বিবিসি লিখেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অনেকের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটালেও মের কাজ করেছেন ভিন্ন কায়দায়। বড় বড় বিষয়ের পাশাপাশি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই তীক্ষè নজর ছিল তার। দলের অনেক নেতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ থাকলেও সেসবকে পাত্তা দেননি মে। ডাউনিং স্ট্রিটের অনেকের সমালোচনা ছিল- মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নিজের ব্যক্তিগত ‘জমিদারিতে’ পরিণত করেছেন। সেসব কথায় কান না দিয়ে ‘আপোসহীন’ টেরেসা মে নিরাপত্তাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। দি গার্ডিয়ান লিখেছে, ব্রেক্সিটের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পাশাপাশি টেরেসা মেকে লিমিটেড কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে বেতন নিয়ে আলোচনার সময় শ্রমিক প্রতিনিধিদের বাধ্যতামূলক উপস্থিতিসহ শ্রমিকবান্ধব পরিচালন নীতি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। কনজারভেটিভ দলের সাবেক চ্যান্সেলার কেন ক্লার্কের ভাষায়, মে হবেন ‘মার্গারেট থ্যাচারের মতোই’ একজন। তবে নতুন মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্যের নাম ঘোষণার পর লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসনের নিয়োগে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। ব্রিটেনের ইতিহাসের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দুনিয়ার সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন তেরেসা মে। কিন্তু নিজে শপথ নেয়ার পরেই ব্রেক্সিটের বাঁশিওয়ালা ও বিতর্কিত টরি নেতা বরিস জনসনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সবার দৃষ্টিকে বরিসের দিকে ঠেলে দিলেন তিনি। তেরেসা বন্দনায় ব্যস্ত হওয়ার বদলে এখন বরিস বধের মন্ত্র জপতে শুরু“করেছে বিশ্বের ডাকাবুকো রাজনীতিকরা ও প্রধান প্রধান গণমাধ্যমগুলো। ব্রিটেনের প্রধান কূটনীতিক হিসেবে বরিস জনসনের এই পদায়ন মানতে পারেনি মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন। বরিসের বিতর্কিত উক্তিগুলোকে একত্রিত করে বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমটি। তাদের দাবি, প্রবল সমকামিতাবিরোধী এই নেতা সমলিঙ্গের বিয়েকে অভিহিত করেন ‘কুকুর সঙ্গম’ হিসেবে। এদিকে ভিনদেশীদের প্রতি তার রয়েছে নাকসিটকানোর রীতি। বিদেশীদের ‘কালো সন্তান’, ‘নরখাদক’ প্রভৃতি বিশেষণে অভিহিত করতেন বরিস। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কেও তিনি কটু কথা বলতে অভ্যস্ত দাবি করেছে প্রতিবেদনটি। দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত নিজের বিভিন্ন লেখায় কঙ্গো ও নামিবিয়ার নাগরিকদের ‘তরমুজের মতো হাসি সর্বস্ব এবং কুৎসিত মানুষ’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি। এছাড়াও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিনকে হ্যারি পটার সিনেমার ভৃত্যের চরিত্র ‘ডবি’ বলে অভিহিত করেছেন এই বর্ণবাদী নেতা। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ‘জাতিকে বিভাজনকারী ব্যক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছে বরিস জনসনকে। প্রতিবেদনটি আরও বলছে, ‘ব্রেক্সিট গণভোটে জয়ের পর সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের জায়গায় নিজেকে অভিষিক্ত করার পরিকল্পনা করছিলেন বরিস। কিন্তু শেষ মুহূর্তের দলাদলিতে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। তবে দুই সপ্তাহের মাথায় আবারও দেশটির সর্বোচ্চ কূটনীতিকের পদ দখল করলেন তিনি।’ তার এই প্রত্যাবর্তনের জন্য নতুন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মেকে দায়ী করছে পত্রিকাটি। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানায়, ‘নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে বড় পদে নিয়োগ দিয়ে রাজনৈতিক সক্ষমতা বাড়ালেন তেরেসা, তবে দেশের ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলেন তিনি।’
×