ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ থেকে ফের কর্মী নেয়ার ঘোষণা মালয়েশিয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ জুলাই ২০১৬

বাংলাদেশ থেকে ফের কর্মী নেয়ার ঘোষণা মালয়েশিয়ার

ফিরোজ মান্না ॥ অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে মালয়েশিয়া আবার বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সোর্স কান্ট্রি (উৎস দেশ) হিসাবে মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে তালিকাভুক্ত করেছে। আগামী মাসের শুরুতে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে। বৈঠকের পর বলা যাবে কবেনাগাদ বাংলাদেশ থেকে তারা কর্মী নিয়োগ করবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে। তারা দফায় দফায় কর্মী নিয়োগের বিষয়ে বৈঠক করেছে। আমরা বলেছি, কর্মী নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে আবার কর্মী নিয়োগ বাতিল করা হলে তাহলে কোন আলোচনার দরকার নেই। বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। আগামী মাসে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসার কথা রয়েছে। তখনই জানা যাবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা কর্মী নিয়োগ করবে। অতীতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছিল, এবার ওই সব সমস্যা হবে না বলে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। নতুন পদ্ধতিতে বেসরকারী খাতও কর্মী পাঠাতে পারবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বেশ কয়েক দফা জয়েন্ট ওয়র্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে কর্মী নিয়োগের ঘোষণা আসে। এ মাসের শুরুর দিকে মালয়েশিয়া এ ঘোষণা দিলেও অতীতের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলেনি। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়া নিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই আগে থেকে কিছু বলা মুশকিল। তবে তারা অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে এবার বৈধ পথে কর্মী নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছাত্র ভিসাসহ নানা মাধ্যমে দেশটিতে বৈধ কর্মীর চেয়ে অবৈধ কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবৈধ কর্মীদের বৈধ করে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তারা প্রস্তাবটি মেনে নিয়েছে। তবে দেশটির কর্তৃপক্ষ শর্ত দিয়েছে, অবৈধ কর্মী নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা তাদের শর্ত মেনে নিয়েছি। বাজারটি খুলবে কি খুলবে না তা আগামী মাসের শুরুতেই বোঝা যাবে। মালয়েশিয়া থেকে একটি প্রতিনিধিদল আসার কথা রয়েছে। তখনই চূড়ান্ত হবে বাংলাদেশ থেকে তারা কি প্রক্রিয়ায় কর্মী নিয়োগ করবে। কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই আলোচনা হচ্ছে। এবার তারা অবৈধ কর্মী ঠেকাতে বৈধপথে কর্মী নিয়োগে আগ্রহী হয়েছে। যদিও এর আগে মালয়েশিয়ার সঙ্গে কর্মী নিয়োগের চুক্তি হয়েও সেই চুক্তি মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষই মানেনি। এমন অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তাই এবার খুব সাবধানে বাংলাদেশ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এদিকে কর্মী নিয়োগে প্রতারণা ঠেকাতে এবারই প্রথম কর্মীদের বায়ো-মেডিক্যাল ও বীমার আওতায় আনা হবে। এরআগে কর্মীদের বিদেশ যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করা হতো। তাতে অনেকেই আনফিট হওয়ায় বিদেশে যেতে পারত না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সমুদয় টাকার অপচয় হয়েছে। বায়ো মেডিক্যালের ফলে এবার আর টাকা অপচয়ের সুযোগ থাকছে না। এরই মধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে এই প্রক্রিয়া। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে করা ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির আওতায় কর্মী নেয়ার পুরো প্রক্রিয়াই হবে অনলাইনে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। সরকারের তথ্যভা-ারের পাশাপাশি বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সিও কর্মী বাছাই করার সুযোগ পাবে। জানা গেছে, বাংলাদেশের বড় একটি শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। হঠাৎ করে ২০০৯ সালে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালে ‘জিটুজি’ (সরকারীভাবে) শুধু প্লান্টেশন খাতে কর্মী নিয়োগ শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় গত ৫ বছরে মাত্র ৭ হাজার কর্মী নিয়োগ করে তারা। ওই পদ্ধতি পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ‘জিটুজি প্লাস’ নামে এই চুক্তির আওতায় (সরকারী-বেসরকারী) সেবা, নির্মাণ, কৃষি, প্ল্যান্টেশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রতিবছর ৫ লাখ করে ৩ বছরে মোট ১৫ লাখ কর্মী নিয়োগের ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া। কিন্তু চুক্তি সইয়ের ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদি বাংলাদেশসহ সব দেশ থেকে কর্মী নেয়া আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। তবে, কয়েক মাসের মাথায় গত মে মাসে বিদেশী কর্মী না নেয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে দেশটি। বায়রার মহাসচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিন স্বপন বলেন, বিদেশী কর্মী না নিয়োগের যে ঘোষণা মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ছিল তা ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশকে সোর্স কান্ট্রি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দেশটিতে বর্তমানে বিদেশী কর্মীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি বাস্তবায়ন হলে কর্মী হয়রানি প্রতারণা অনেকাংশে বন্ধ হতো। বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ নিয়ে নানা ধরনের প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আগে কর্মীদের মেডিক্যাল পরীক্ষা নিয়ে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো। এখন আর তা লাগবে না। মেডিক্যাল পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার পর প্রাথমিক যাচাইয়ে অযোগ্য হলে তাকে আর মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে দেয়া হবে না। এতে কর্মীদের অযথা টাকা খরচ করতে হবে না। এতে মালয়েশিয়া গিয়ে ‘আনফিট’ হয়ে ফিরে আসার হার অনেক কমবে। এখানকার মেডিক্যাল রিপোর্টটিও হাতে হাতে দেয়া হবে না। অনলাইনের মাধ্যমে মালয়েশিয়াতেই পাঠিয়ে দেয়া হবে। আগে কর্মীরা শতভাগ ইন্সুরেন্স সুবিধা পেতেন না। ফলে তারা হাসপাতাল সেবা ও ক্ষতিপূরণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। এখন থেকে অনলাইনের মাধ্যমে দেশে থাকতেই ইন্সুরেন্স নিশ্চিত করা হবে। জিটুজি প্লাস চুক্তির আওতায় কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিটটিও নবায়ন করবে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান। যদি মালিকপক্ষ ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করতে চায় তাহলে অনলাইনে এটি ইমিগ্রেশন বিভাগকে জানিয়ে দেবে। এখানে ওয়ার্ক পারমিট জালিয়াতি করার কোন সুযোগ নেই। পাশাপাশি ‘ডাবল ভিসা’ ইস্যুর সুযোগও আর থাকছে না। কারণ, ভিসার সব তথ্যই থাকবে অনলাইনে। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবে না। চুক্তিতে কর্মীদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। কর্মীরা মারা গেলে কিংবা কর্মস্থলে দুর্ঘটনার কারণে পঙ্গু হলে তার নিকটজনেরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। সব ধরনের তথ্য অনলাইনে থাকায় স্বজনরা সহজে সব তথ্য জানতে পারবেন। সূত্র জানায়, অতীতে কর্মী নিয়োগকারীদের দ্বারা নির্যাতিত হলে, বেতন বা অন্যান্য সুবিধা না পেলে অভিযোগ জানানোর উপায় ছিল না বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছতে পারতেন না। এবার আর কর্মীদের এই সমস্যায় পড়তে হবে না। বাংলাদেশী কর্মীরা মালয়েশিয়ার যেকোন শহরের ওয়ান স্টপ সেন্টারে (ওএসসি) গিয়ে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে পারবেন। ওএসসি পরে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের শ্রম বিভাগকে বিষয়টি জানাবে। এরপর দূতাবাস বা হাইকমিশন ওই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
×