ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুখরোচক, স্বাদে মিষ্টি- ভিটামিনে ভরপুর

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৭ জুলাই ২০১৬

মুখরোচক, স্বাদে মিষ্টি- ভিটামিনে ভরপুর

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ ‘আসেন ভাই আসেন, একটা খাইয়া যান। একবার খাইলে আরেকবার খাইতে মন চাইবো। মাত্র ছয় টাহায় ছিল্যা-কাইট্টা লবণ লাগাইয়া দিমু। বরিশাইল্যা আমড়া, খাইয়া খালি কামড়া।’ জয়তু বরিশালের আমড়া। এভাবেই চিৎকার চেঁচামেচি করে ক্রেতাকে আমড়া খেতে আহ্বান করছিলেন বরিশাল মহানগরীর কীর্তনখোলা তীরের মুক্তিযোদ্ধা পার্কের মৌসুমী হকার হানিফ মোল্লা। প্রতিটি মৌসুমে বাজারে আসা আম, জাম, কাঁঠাল আমড়া ইত্যাদি বিক্রি করাই হানিফ মোল্লার কাজ। নগরীর বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, এই হানিফ মোল্লার মতো আরও অনেক মৌসুমী হকার আমড়া বিক্রি করছেন। এদেরই একজন কাউখালী উপজেলা সদরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি আমড়া কেটে কাঠি লাগিয়ে বিক্রি করছেন। আবার ছোট পলিব্যাগের ভেতরে আমড়া ভরে রেখেছেন কিছু প্যাকেটও। ইসমাইল হোসেন জানান, যারা কম সময়ে আমড়া খেতে চান তাদের জন্য এই প্যাকেট। তার কাছেই জানা গেল, ভ্রাম্যমাণ আমড়া বিক্রেতারা অধিকাংশই মৌসুমী হকার। মৌসুমী ফলের ব্যবসায় লাভ বেশি হওয়ায় তারা যখন যে ফলের মৌসুম তখন সেই ফল ফেরি করে বিক্রি করেন। এখন আমড়ার মৌসুম, তাই তারা আমড়া বিক্রি করছেন। মুক্তিযোদ্ধা পার্কে বেড়াতে এসে মসলা মাখানো আমড়া খাচ্ছিলেন বিএম কলেজের ছাত্রী শাকিলা ইসলাম ও তার বান্ধবী সিনথিয়া রহমান। আমড়া খাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে তাদের ভাষ্য, এক কথায় অসাধারণ! অদূরেই দেখা গেল এক বাদাম বিক্রেতাও আমড়া খাচ্ছেন। চল্লিশোর্র্ধ এই বাদাম বিক্রেতা জানান, আমড়া তার প্রিয় ফল। প্রতি মৌসুমে তিনি দিনে কমপক্ষে ৪/৫টি আমড়া খেয়ে থাকেন। প্রতিবছর আমড়ার মৌসুমে দেশের প্রতিটি লঞ্চ, বাস ও ট্রেন স্টেশনে হকারদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় ‘লাগবে বরিশাইল্লা আমড়া’। আমড়ায় ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও লৌহ ইত্যাদি মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। বরিশালের আমড়া মুখরোচক এবং তুলনামূলক মিষ্টি হওয়ায় সর্বত্র এর চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বরিশাল বিভাগের এমন কোন জেলা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়নের ঘরবাড়ি নেই যে বাড়িতে আমড়া গাছ নেই। এরমধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিভাগের পিরোজপুরের কাউখালী, নাজিরপুর ও রূপকাঠিতে বাণিজ্যিকভাবে আমড়ার চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের ছোট-বড় রাস্তার পাশে বাড়ির উঠানে একটি আমড়া গাছ লাগানো যেন এখন প্রতিটি মানুষের নিয়মে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষ পতিত জমি কেটে আইল তৈরি করে আবার কেউ কেউ ফসলি জমিতে বড় বড় আমড়ার বাগান তৈরি করেছেন। কোন কোন চাষীর বাগান থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে আমড়া বেচে। এবারও বরিশালে আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে পাকা আমড়া পাওয়া যায়। গ্রামের বেশিরভাগ এলাকায় আমড়া কেনা-বেচার বেপারী রয়েছে। তারা ফাল্গুন, চৈত্র মাসে কুঁড়ি দেখেই আগাম টাকা দিয়ে বাগান কিনে রাখেন। আবার অনেক চাষী নিজেরাই ভরা মৌসুমে আমড়া বিক্রি করেন। কাউখালী উপজেলার প্রধান বন্দর লঞ্চঘাট, দক্ষিণ বাজারসহ বিভিন্ন বড় বাজারে রয়েছে অসংখ্য আমড়ার আড়ত। পাইকাররা আড়ত থেকে আমড়া কিনে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মেঘনাঘাট এলাকায় চালান করেন। কাউখালী এলাকার আমড়া চাষী জাকির হোসেন বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিক মুনাফার কারণে আমড়া উৎপাদনকারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পাইকাররা গৃহস্থদের কাছ থেকে এক বস্তা আমড়া ৭-৮শ’ টাকায় কিনে কাউখালী মোকামে বিক্রি করেন ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকায়। কাউখালীর ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, আড়ত থেকে ঢাকা বা মুন্সীগঞ্জে এক বস্তা আমড়া পৌঁছাতে খরচ হয় ২১০ থেকে ২১৫ টাকা। এরপর আড়তে বিক্রয় মূল্যের শতকরা ১০ ভাগ আড়তদারি দিতে হয়। প্রতিটি বস্তায় ৮শ’ আমড়া ধরে। ঢাকায় প্রতিবস্তা আমড়া বিক্রি হয় প্রায় ২ হাজার টাকায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, নিঃসন্দেহে আমড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। চলতি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে আমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। আমড়ার বাগান করা বা চাষ করা খুবই সহজ। আমড়ার চারা লাগানোর জন্য উৎসাহিত করা, ফলন বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই দমনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। বরিশালের কৃষক বন্ধু জেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় যে আমড়া বিক্রি হচ্ছে তার বেশিরভাগই বরিশালের। এ অঞ্চলের আমড়া খেতে খুবই সুস্বাদু বলে সবার কাছে বরিশালের আমড়া অনেক জনপ্রিয়। তিনি অভিযোগের সুরে আরও বলেন, অনেকেই বরিশালের আমড়ার কথা বলে অন্য এলাকার আমড়াও বিক্রি করে থাকেন।
×