ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ চুরির পুরো অর্থ ফেরত আসবে ॥ গবর্নর

নতুন মুদ্রানীতিতে ১৬.৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৭ জুলাই ২০১৬

নতুন মুদ্রানীতিতে ১৬.৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বেসরকারী খাতে ১৬.৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই’১৭-ডিসেম্বর’১৭) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারী খাতে ঋণের যোগান বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সতর্কতার কথাও বলা হয়েছে। বিশেষ করে ঋণপ্রবাহ যাতে অনুৎপাদশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যবহার না হয় সেজন্য নিবিড় তদারকি করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আগামী ছয় মাসের এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গবর্নর ফজলে কবির। তিনি এ মুদ্রানীতিকে সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী বলে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি ফেডারেল রির্জাভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের পুরোটাই ফেরত আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবর্নরের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান, এসকে সুর চৌধুরী, চেঞ্জ ম্যানেজম্যান্ট উপদেষ্টা আলাহ মালিক কাজেমী প্রমুখ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রেখে প্রতি ছয় মাসের জন্য আগাম মদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকার প্রক্ষেপিতহারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারী খাতে ঋণের যোগান বাড়ার ঘোষণা এসেছে। গেল মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণ যোগানের লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের এ যোগান ১৬ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীতের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত তা ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশে সীমিত রাখা হবে। ব্যাংকঋণের চাহিদা না থাকায় নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ধরা হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারী খাতে ঋণের যোগান ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত তা বেড়ে ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশে উন্নীতের আশা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৪ শতাংশে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের এ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করা গেলে তা বাজেটে ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ফজলে কবির। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির এ মাত্রা সরকার প্রক্ষেপিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যথেষ্ট বলে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে জানান গবর্নর ফজলে কবির। তবে অভ্যন্তরীণ এ ঋণপ্রবাহ যাতে অনুৎপাদশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ব্যবহার না হয় সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার কথাও জানান গবর্নর। তিনি বলেন, এ ঋণ যাতে অভ্যন্তরীণ ও রফতানি চাহিদার জন্য উৎপাদনের প্রকৃত প্রয়োজনে সদ্ব্যবহার হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় নজরদারি থাকবে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতে ঋণপ্রবাহের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকল্পে এ খাতেও নজরদারি অব্যাহত থাকবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর মাঠপর্যায়ে অর্থায়ন সাশ্রয়ী সুদে হওয়ার বিষয়ে নজরদারি কঠোরতর করা হবে। ঋণের সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপী ঋণকেই প্রধান বাধা বলেও মন্তব্য করেন ফজলে কবির। তিনি বলেন, প্রায় সময়ই ব্যবসায়ীরা ঋণ সুদহার কমানোর দাবি তোলেন। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঋণ বাজারে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ ঋণ পরিশোধে শৃঙ্খলা থাকে না। ঋণ পরিশোধে শৃঙ্খলার মাধ্যমে খেলাপী ঋণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে পারলেই ঋণের সুদহার কার্যকরভাবে কমানো সম্ভব। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে সক্রিয় হওয়ার জন্য ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গবর্নর। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের কার্যক্রমের সহায়তার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি পরিমিত ও স্থিতিশীল রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংযত, সঙ্কুলানমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব মুদ্রা ও অর্থায়ন নীতির ধারাবাহিকতা নতুন মুদ্রানীতিতেও বজায় থাকবে। এককথায় নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিমাকে কী বলছেনÑ সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এটাকে বলব সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী। এদিকে, নতুন মুদ্রানীতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ও ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১১ শতাংশ ও ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগামী বছরের জুন পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াবে ১৪ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। শীর্ষ খেলাপীদের নাম প্রকাশের চিন্তাভাবনা নেই ॥ চীনের সাংহাই মডেলের মতো আমাদের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ খেলাপীদের নামের তালিকা প্রকাশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ফজলে কবির বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ ২০ জন করে ঋণখেলাপীর নাম প্রতিটি ব্যাংকের কাছে আছে। অন্যান্য ব্যাংকে এতবড় ঋণখেলাপী নেই বা এটা হওয়ারও খুব সম্ভাবনা নেই। আর চীনের সাংহাই মডেলে আমরা এখনই যেতে চাচ্ছি না। ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে দুর্নীতি কিছু আছে। এটা কমন নলেজ। যখনই আমরা অভিযোগ পাব, কাগজপত্রে সেটা সিরিয়াসলি টেকআপ করব। এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন থেকে আরও সিরিয়াসলি টেকআপ করা হবে। এটি আমাদের গবর্নেন্সের একটি অংশ। রিজার্ভের পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা ॥ ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের পুরোটাই ফেরত আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। ফজলে কবির বলেন, আইনী প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের তরফ থেকে যা যা করার করেছি। এ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আমরা মিউচুয়াল লিগ্যাল সিস্টেম সিক করেছি। সে অনুয়ায়ী তারা ফর ফিউশন অব কেস করে পৌঁছে যাচ্ছে। ফিলিপিন্সের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল আমাদের আন্তরিকভাবে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিন্সও আমাদের সহযোগিতা করেছে। আমি সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিন্সের গবর্নরের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়াও ফিলিপিন্সের এ্যাম্বাসেডর জন গোমেজ সকল বিষয় কোঅর্ডিনেট করছেন। তিনি বলেন, আরও অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় সে দেশের এ্যান্টি মানি লন্ডারিং ফর ফিউচার কেস করেছে। তাদের যে এ্যাসেট ফ্রিজ করেছে, জব্দ করেছে, সেগুলো থেকে তাদের মাধ্যমে আমরা আশা করছি আরও অর্থ আসবে। বাকি অর্থের জন্য সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিন্স ব্যাপকভাবে তদন্ত করছে। এ তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আমরা আশা করছি তদন্ত আমাদের পক্ষে আসবে। তার ভিত্তিতে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ফিলিপিন্স বা এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল তাদের আদালতে আরসিবিসিকে দায়ী করবে। যদি ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরসিবিসিকে সাকসেসফুলি লাইএ্যাবল করতে পারে তাহলে আমাদের পুরো টাকা ফেরত আসবে। তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়টি সিআইডি বিশদভাবে তদন্ত করছে। সরকারের কমিটি তদন্ত শেষ করেছে। রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আছে। ফরেনসিক তদন্ত করেছে ফায়ারআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের রিপোর্টও সরকারের কাছে। সরকার দেখে এটা আমাদের দেবে। যদি কোন এ্যাকশনের প্রয়োজন হয় সরকার আমাদের জানাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি বিষয়ে গবর্নর বলেন, আমাদের পুরো সিস্টেমের জন্য একটি রেমিডিডেশন প্ল্যান নিয়েছি, যাতে সুইফট সিস্টেম পুরোপুরি স্টাবলিস্ট করছি। সব টেকনোলজি নতুন করে লাগাচ্ছি। এটা হলে আমরা সিকিউরড। তিনি জানান, সুইফটের নতুন সিস্টেম আসার পর তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অডিট হবে, যারা সুইফট বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না। তারা অডিট করে বলবে ঠিক আছে। তার পর নতুন সিস্টেমে কার্যক্রম শুরু হবে।
×