ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক জঙ্গী আহত অবস্থায় গ্রেফতার, পালিয়ে গেছে একজন;###;নিহতরা সবাই জেএমবির সদস্য;###;বাড়ির মালিক, ছেলে ও স্ত্রীসহ ৪২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ

নিহত ৯ জঙ্গী ॥ কল্যাণপুর আস্তানায় অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৭ জুলাই ২০১৬

নিহত ৯ জঙ্গী ॥ কল্যাণপুর আস্তানায় অভিযান

শংকর কুমার দে/গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গীবিরোধী ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ নামে চালান এক ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে ভবনে থাকা ৯ জঙ্গী নিহত, ১ জঙ্গী আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছে ১ জঙ্গী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। নিহতরা সবাই জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)র সদস্য ও উচ্চশিক্ষিত বিত্তবান ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান বা এলিট শ্রেণীর। গুলশানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত জেএমবি এবং কল্যাণপুরে নিহত জেএমবি জঙ্গীরা এক গ্রুপের। কল্যাণপুরের ঘটনায় বাড়িটির মালিক, ছেলে ও স্ত্রীসহ অন্তত ৪২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জঙ্গী সম্পৃক্ততা না থাকায় অনেককেই ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভবনটিতে ফরেনসিক দল প্রবেশ করে পরীক্ষা ও আলমত সংগ্রহ করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব কথা জানিয়েছেন। সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের জাহাজ বিল্ডিংয়ের নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিল নামের ৬ তলা ভবনের ৫ তলায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হলে সারারাত ধরে কিছুক্ষণ পর পর থেমে থেমে গুলি, বোমা, গ্রেনেড ও গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে এলাকা। মঙ্গলবার ভোরে ৯ জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জঙ্গীবিরোধী অভিযান শেষে জঙ্গীদের মেস হিসাবে ভাড়া নেয়া ৫ তলার জঙ্গী আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৩টি পিস্তল, ২২ রাউন্ড গুলি, ২৩টি গ্রেনেড ও ৫ কেজি বিস্ফোরক, পাশের ভবনের ছাদ থেকে আরেকটি অস্ত্র উদ্ধার ও জিহাদী বই, কালো পোশাক, কালো পতাকা ও আরবী ভাষায় লেখা ব্যানার উদ্ধার করেছে যৌথবাহিনী। জঙ্গীদের পরনে ছিল পাঞ্জাবি, পাগড়ি যা আইএস-এর পোশাক বলে পরিচিত। ‘আল্লাহু আকবর, নারায়ে তাকবির’, ‘ইসলামের শত্রুরা নিপাত যাক’ ধ্বনি দিয়ে পুলিশের দলকে লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গুলশানের হলি আর্টিজানের পুলিশী অভিযানে জঙ্গীদের গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের আঘাতে দুই পুলিশ সদস্যদের হতাহতের ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে কল্যাণপুরে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান পরিচালনা বন্ধ রেখে রাতভর অপেক্ষার পর ভোরে অভিযান পরিচালনা করা হয়। দেশে জঙ্গী বিরোধী অভিযানে এত বিপুলসংখ্যক জঙ্গীদের হতাহতের ঘটনা ও বড় ধরনের সাফল্যের ঘটনা এটাই প্রথম এবং গুলশানে জঙ্গী হামলার ২৫ দিনের মাথায় ও শোলাকিয়ার জঙ্গী হামলার ১৮ দিন পর এক বড় ধরনের জঙ্গী বিরোধী অভিযানে নেমে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাত করে দেয়া হয়েছে। রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিল নামের ৬ তলা ভবনের ৫ তলায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানোর সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলির সময়ে ৯ জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সোমবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে কল্যাণপুর গার্লস হাইস্কুলের রোডের শেষ প্রান্তে অবস্থিত জাহাজ বিল্ডিং ভবন ও তার চারপাশের রাস্তা ঘিরে রেখে সোয়াত, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশসহ (ডিবি) আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য অভিযানে অংশ নেয়। রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ভবনটি জাহাজ বিল্ডিং নামেই পরিচিত। পাঁচতলা এই ভবনের দোতলায় থাকেন বাড়িওয়ালা। স্থানীয়রা বলছেন, বাড়ির মালিকের নাম আতাহার উদ্দিন আহমেদ। তিনি সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তা। তার দুই স্ত্রী রয়েছে। প্রথম স্ত্রী ঘটনাস্থলের বাড়িতেই থাকেন। তার এক ছেলে জুয়েল। তিনি ব্যারিস্টার। একমাত্র মেয়ে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। বাড়িটির যাবতীয় দেখভাল করেন প্রথম স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে গুলশানের আরেকটি বাড়িতে বসবাস করেন আতাহার উদ্দিন আহমেদ। নিচ তলায় তেমন কেউ থাকেন না। মমিন নামের একজন কেয়ারটেকার থাকেন। আর দ্বিতীয় তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ফ্যামিলি বাসা। পঞ্চম তলা ও ষষ্ঠ তলায় মেস। বাড়িটি দুই ইউনিটে। প্রতি ইউনিটে তিনটি করে কক্ষ রয়েছে। কোন কোন ইউনিটে আবার চারটি কক্ষও রয়েছে। গত ১২ জুলাই ভবনটির ৫ তলার দক্ষিণ দিকের ইউনিটটি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গীরা। মাসিক ভাড়া প্রায় পনের হাজার টাকা। সোমবার রাত সাড়ে বারোটার দিকে পুলিশ বাড়িটির চতুর্দিকের অন্তত কোয়ার্টার কিলোমিটার এলাকা কর্ডন করে। প্রতিটি রাস্তায় যানবাহন চলাচল ও মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপর বাড়ির পাশের ডিন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভেতরে পুলিশ অভিযান চালানোর জন্য জড়ো হয়। এরপর একটার দিকে আরও পুলিশ বাড়িটির চারদিকে অবস্থান নেয়। রাত দেড়টার দিকে পুলিশ বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। রাত দুইটার দিকে পুলিশ বাড়িতে অভিযান চালাতে গেলে জঙ্গীরা প্রথমে গ্রেনেড চার্জ করে। কিন্তু গ্রেনেড লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এর আগেই পুলিশ বাড়িটির সামনেসহ আশপাশে থাকা সব বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে ফাঁকা গুলি চালাতে থাকে। এটি ছিল জঙ্গীদের দিকভ্রান্ত করার কৌশল। সেই কৌশলে পা দেয় জঙ্গীরা। তারা জানালা ভেঙ্গে উঁকি দিয়ে পুলিশের অবস্থান জানার চেষ্টা করে। সেইসঙ্গে নারায়ের তকবীর আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তুলে। জঙ্গীরা এমন করতে থাকে। তারাও পাল্টা গুলি চালায়। অন্যদিক দিয়ে পুলিশ পাশের বাড়ির আরেকটি ভবনে উঠে জঙ্গীদের প্রকৃত অবস্থান নিশ্চিত হয়। এরপর শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। অভিযান চলে থেমে থেমে। অভিযান শুরু হলে থেমে থেমে মুহুর্মুহু আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি, বোমা, গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে গোটা কল্যাণপুর এলাকা কেঁপে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গীরা ‘আল্লাহু আকবর, নারায়ে তাকবির’, ‘ইসলামের শত্রুরা নিপাত যাক’ ইত্যাদি সেøøাগান দিয়ে গুলিবর্ষণ, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এদিকে পুলিশের কয়েকটি দল বিভিন্ন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢোকার প্রস্তুতি নেয়। রাত তিনটার দিকে আরেক দফা অভিযান চলে। স্থানীয়রা বলছেন, গুলির শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয় ভোর পাঁচটার দিকে। এ সময় পুলিশ ও জঙ্গীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। বেশ কয়েকটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিলেন, অন্তত একহাজার রাউন্ড গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভোর প্রায় ছয়টার দিকে চূড়ান্ত আক্রমণ চালায় যৌথ বাহিনী। ঘণ্টাখানেক গুলি চলার পর সব নিস্তব্ধ হয়ে আসে। পুলিশ জানায়, তারা নানা দিক থেকে জঙ্গীদের আস্তানা আক্রমণ চালায়। এর আগে নিচ তলায় থাকা লোকজনদের অনেককেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। তবে অনেককেই সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। মঙ্গলবার সকাল প্রায় সাতটার দিকে অভিযান চূড়ান্তভাবে শেষ হয়। অভিযানে ৯ জঙ্গী নিহত হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান ৯ জঙ্গী নিহত হবার পর পুলিশ অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, জাহাজ বিল্ডিং ভবনের ৫তলায় মোট ১১ জন জঙ্গী ছিল। এর মধ্যে সোমবার রাতে ভবনে ঢোকার সময় পুলিশের গুলিতে আহত এক জঙ্গীকে আটক করা হয়। ৯ জঙ্গীর নাম বলেছে : আটক জঙ্গী হাসানের দেয়া জবানবন্দীতে জানা গেছে, ক্যলাণপুরের ওই বাড়িতে ছিল ১১ জঙ্গী। এর মধ্যে ৯ জঙ্গীর নাম জানা গেছে। তারা হলেন, রবিন, সাব্বির, তাপস, অভি, আতিক, সোহান, ইমরান, ইকবাল ও হাসান। আটক জঙ্গী হাসান এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিল ॥ আহত অবস্থায় আটক হাসানের (১৮) প্রকৃত নাম রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান। পিতার নাম রেজাউল করিম। বাড়ি বগুড়া শহরের সরকারী আজিজুল হক কলেজসংলগ্ন জামিলনগরে। সে এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিল। সিরিয়া যাওয়ার কথা ছিল জঙ্গী আস্তানা থেকে আটক হাসানের। মঙ্গলবার কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ভবনে চালানো পুলিশের অভিযানে ৯ জঙ্গী নিহত হয়। একজনকে আটক করে পুলিশ। আটক এই জঙ্গীকে আহতাবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এক বছর ধরে এই দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। এখানে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করত সে। হাসানের দাবি, তারা আইএসের লোক। হাসানই পুলিশকে জানায়, মেসে তারা ১১ জন ছিল। বাম পায়ের রানের ওপরে গুলির জখম রয়েছে তার। জঙ্গী হাসানকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ড কক্ষ থেকে কেবিন ব্লকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাকে বর্তমানে ৩৭ নম্বর কেবিনে রাখা হয়েছে। ঢামেকের উপ-পরিচালক খাজা আব্দুল গফুর বলেন, সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগ এড়াতে এবং জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার হাসানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের অনুরোধে হাসানকে কেবিনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে তার অবস্থা বিপদমুক্ত। সময়মতো তার পায়ের অপারেশন করা হবে। হাসপাতালে হাসানকে দেখতে আসায় এক যুবককে আটক করে শাহবাগ থানায় নেয়া হলেও পরে ছেড়ে দেয়া হয়। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীর মায়ের বক্তব্য ॥ রিগ্যানের মা রোকেয়া আক্তার নন্দীগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ নার্স। রিগ্যানের এক বোন আছে। রিগ্যানের মায়ের দাবি, ২০১২ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি জামিলনগরে জায়গা কিনে টিনশেড বাড়ি করে বসবাস করেন। রিগ্যান ২০১৩ সালে করতোয়া মাল্টিমিডিয়া স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে। সরকারী শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে ২০১৫ সালে। এর পর মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেতে বগুড়া শহরে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। গত বছরের জুলাইয়ে ছেলে নিখোঁজ হয়। এ ব্যাপারে বগুড়া সদর থানায় তখনই একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। ছেলের সঙ্গে এক বছর ধরে কোন যোগাযোগ নেই বলেও তিনি দাবি করেন। তাদের বাসায় একজন ভাড়াটিয়া ছিল। তার এক ছেলের সঙ্গে মেশার পর থেকেই রিগ্যান বিপথে চলে গেছে বলে তিনি সন্দেহ করছেন। রিগ্যান নিখোঁজ হওয়ার পর ওই ভাড়াটিয়ার ছেলেও নিখোঁজ হয় এবং এর কিছুদিন পর ওই ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে যায়। বগুড়া সদর থানার ওসি আবুল বাসার জানান, রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যানের মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দুপুরের দিকে থানায় নেয়া হয়েছিল। ছেলের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশের তৈরি করা নিখোঁজদের তালিকাতেও রিগ্যানের নাম রয়েছে। যেভাবে পালালো এক জঙ্গী ॥ কল্যাণপুরের স্থানীয়রা জানান, জঙ্গী আস্তানাটি লাগোয়া একটি বাড়ি রয়েছে। প্রচ- গোলগুলির মধ্যেই পাশের বাড়ির পাইপ বেয়ে নিচে নামে এক জঙ্গী। একপর্যায়ে সে লাফিয়ে সেখানে থাকা একটি টিনের বাড়ির কাছে পড়ে। তার কাছে একটি ব্যাগ ছিল। পরবর্তীতে সে ব্যাগ নিয়েই ওই জঙ্গী পালিয়ে যায়। কালো পোশাকে জঙ্গীদের লাশ ॥ কল্যাণপুরের ওই জঙ্গী আস্তানায় মঙ্গলবার সকালে অভিযান চালানোর পর বাড়িটি পুলিশ প্রহরায় রাখা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফরেনসিক বিভাগের লোকজন ও পুলিশ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের জন্য পুলিশের তোলা ছবিতে মেঝেতে পড়ে থাকা জঙ্গীদের গায়ে কালো পোশাক দেখা গেছে। তাদের কারও কারও মাথায় পাগড়িও দেখা গেছে। ছবিতে ঘরের ভেতর ও সিঁড়িতে কয়েকটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের পরনে ছিল কালো পায়জামা-পাঞ্জাবি। মেঝেতে রক্ত জমাটবেঁধে আছে। ঘরের ভেতর আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। একটি প্লাস্টিকের তাক রয়েছে, তাতে কিছু বই রয়েছে। এছাড়া রয়েছে তোষক, বালিশ ও চাদর। আসবাবপত্র না থাকলেও বাসায় ১০-১২টি ব্যাগ ও ব্যাগপ্যাক রয়েছে। ভাড়া করা মেসে কোন খাট, চৌকি, চেয়ার, টেবিল বা কোন আসবাবপত্র না রেখে শুধুমাত্র মেঝেতেই বিছানায় শুয়ে থাকে। মেঝেতেই পড়েছিল কলো পোশাক পরিহিত জঙ্গীদের লাশ। আগ্নেয়াস্ত্র ও গ্রেনেড উদ্ধার ॥ কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ে অপারেশন স্টর্ম-২৬ নামের অভিযান শেষে মঙ্গলবার জঙ্গী আস্তানা থেকে চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, ২২ রাউন্ড গুলি, ২৩টি গ্রেনেড ও পাঁচ কেজি বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে যৌথবাহিনী। এর মধ্যে ভবনটির পঞ্চম তলায় কথিত জঙ্গী আস্তানা থেকে তিনটি পিস্তল এবং এর পাশের ভবনের ছাদ থেকে আরেকটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে আরও কিছু জিহাদী বই, কালো পোশাক, কালো পতাকা ও আরবী ভাষায় লেখা ব্যানার উদ্ধার করেছে যৌথবাহিনী। তথ্য ফরম জমা দেয়নি ॥ চলতি মাসের ১২ তারিখ কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলা ভাড়া নেয় জঙ্গীরা। ওই সময় সাতজন মিলে বাসাটি ভাড়া নেয়। বাড়ি ভাড়া নিলেও তারা ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম পূরণ করেনি। মিরপুর মডেল থানার পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তথ্য না দেয়া অপরাধ। এ অপরাধে বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে আইনানুগ যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দকার তা আমরা করব। বাড়ির দ্বিতীয় তলায় মালিকের এক ছেল পরিবার নিয়ে থাকে। মূলত তিনি ও কেয়ারটেকার বাড়ির দেখভাল করেন। আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক নিশ্চিত নয় ॥ কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানা থেকে আইএস লেখা কালো কাপড় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এ জঙ্গীদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গীগোষ্ঠী আইএসের সরাসরি কোন সম্পর্ক আছে তা নিশ্চিত নয় পুলিশ। এছাড়া অভিযানের সময় ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর, ইসলামের শত্রু নিপাত যাক’ বলে চিৎকার করে জঙ্গীরা এবং নিহতদের সবার গায়েই কালো পোশাক রয়েছে। তিনি বলেন, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে মোট ১১টি গ্রেনেড ছোড়ে জঙ্গীরা। এর মধ্যে একটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গী আস্তানা থেকে চার থেকে পাঁচ কেজি বিস্ফোরক, চারটি পিস্তল, ২১ রাউন্ড গুলি, একটি তলোয়ার, তিনটি অটোমেটিক ছুরি, সাতটি ছোট ছুরি এবং বেশকিছু আইএস লেখা কালো পতাকা পাওয়া গেছে। জঙ্গীরা উচ্চশিক্ষিত ॥ অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে নিহতদের পোশাক, কথার ধরন, ব্যবহার্য জিনিসপত্র সবকিছু দেখে মনে হয়েছে তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত, বিত্তবান, সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান ও এলিট শ্রেণীর। নিহতদের পরিচয় এখনও জানায়নি পুলিশ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক হাসান নামে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার দেয়া তথ্য যাচাই করে নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিরপুরে বাংলা কলেজের ভুয়া পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেখিয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরের ওই বাসায় ওঠে জঙ্গীরা। ওই বাসা থেকে এ রকম বেশকিছু ভুয়া আইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। ওই বাসা থেকে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের বেশকিছু বই এবং জিহাদী মতাদর্শের কয়েক বস্তা বই উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, দু’একদিনের মধ্যে বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতেই কল্যাণপুরে অবস্থান নিয়েছিল জেএমবি সদস্যরা। ‘ব্লক রেইড’ নামে যৌথবাহিনীর রুটিন অভিযান চলছিল। অভিযান সফল হয়েছে। আগে থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ব্লক রেইড দেয়া হচ্ছে। তবে কখন কোথায় অভিযান চালানো হবে তা জানানো হচ্ছে না। রাজধানীতে বিভিন্ন জায়গায় ব্লক রেইড চলবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আগাম তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কল্যাণপুর এলাকায় গেলে রাত সাড়ে ১২টায় একটি বাড়ি থেকে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একজনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় তার সহযোগীরা কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। জঙ্গী ছাড়া সাধারণ কোন মানুষ মারা যায়নি। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জেএমবি সদস্যরা এ কাজ করেছে। জঙ্গীরা সফল হলে আইএস বলে ঘোষণা দিত। আসলে যারাই জেএমবি, তারাই বাংলাটিম, হরকাকুল জিহাদ। ওরা সরকারকে বিব্রত করতেই এ ধরনের কাজ করছে। পোশাক, অবস্থান ও গোলাবারুদ দেখে মনে করা হচ্ছে গুলশান হামলার সঙ্গে তাদের লিংক রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, গোয়েন্দা তথ্যে আরও নিশ্চত হওয়া যাবে। তিনি বলেন, জঙ্গী সম্পৃক্ততায় আনেককে আটক করা হয়েছে। অনেককে চিহ্নিত করেছি। আরও নিশ্চিত হয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরা হবে। আটক ও মৃত জঙ্গীদের শরীরে ড্রাগের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হবে বলে জানান তিনি। মঙ্গলবার দুপুর পৌনে একটার দিকে সচিবালয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানা উচ্ছেদে পরিচালিত অভিযান অপারেশন স্টর্ম-২৬ সফল হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদাজ্জামান খান কামাল। ওরা বলে আইএস, আমরা বলি জেএমবি ॥ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেছেন, কল্যাণপুরের নিহত জঙ্গীরা জেএমবির সদস্য। তারা নিজেদের বলে আইএস, আমরা বলি জেএমবি। তিনি বলেন, তারা গুলশান হামলার জঙ্গীদের মতোই কলো পোশাক পরা ছিল। তাদের মাথায় ছিল পাগড়ি। তারা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। গুলশানে ‘জেএমবির যে গ্রুপটি’ হামলা চালিয়েছিল, এরা সে দলেরই সদস্য বলে আইজিপি শহীদুল হকের ধারণা। নিরাপত্তার কারণে কল্যাণপুরের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা ॥ নিরাপত্তার কারণে কল্যাণপুরের সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিরাপত্তার স্বার্থে কল্যাণপুর এলাকায় অবস্থিত ২৭টি স্কুল মঙ্গলবারের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সকালবেলা থেকে অভিভাবকরা বারবার ফোন করে জানতে চাচ্ছিলেন যে, তারা সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন কি-না। এরপর স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আজকের জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জঙ্গীদের লাশ ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরের ওই জঙ্গী আস্তানা থেকে নিহত জঙ্গীদের লাশ মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় সরানো হয় চারটি এ্যাম্বুলেন্সে। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। প্রথম এ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হয় চারটি মরদেহ। দ্বিতীয় এ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয় দুটি মরদেহ। তৃতীয় এ্যাম্বুলেন্সে তিনটি মরদেহ। মোট ৯টি লাশ ঢামেকে নেয়া হয়। লাশ বহনকারী ব্যাগে করে এগুলো ঢামেকে নেয়া হয়। বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে লাশ ঢামেকে পৌঁছায়। জঙ্গীরা মাদকাসক্ত কি-না তাও পরীক্ষা করে দেখা হবে।
×