ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

সঙ্কটের মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২৭ জুলাই ২০১৬

সঙ্কটের মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে

বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিনসন ও নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফালান্ড বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমীক্ষায় বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের নামকরা রেটিং বিশেষজ্ঞ সংস্থা মুভিস ও স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওরস কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে সন্তোষজনক অর্থনৈতিক রেটিং দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম সমালোচক হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের দি ইকোনমিস্টের মতে, বাংলাদেশের সূচকগুলো এতই ইতিবাচক যে, তা ধরে রাখতে পারলে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারবে। আর বাংলাদেশের অন্যতম পরম বন্ধু নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি এগিয়েছে। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর অর্থনীতির মুক্তির ক্ষেত্রে তলাবিহীন ঝুড়ির যে কথাটা প্রচলিত ছিল সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তখন সাড়ে ৭ কোটি জনগণের স্থলে আজ ১৭ কোটি। সে হিসেবে এক্সপোর্ট বেড়েছে, রেমিটেন্স বেড়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে। এগুলো প্রমাণ করে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। আইসিটি শিল্পের উন্নয়নে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিনির্মাণে বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করায় গত কয়েক বছরে আইসিটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছি। ২০০৮ সালে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটিতে। এতে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৃদ্ধি পেয়েছে। আইসিটি শিল্পের উন্নয়নে ও সম্প্রসারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকার ১২টি হাইটেক পার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সীমিত সম্পদের মধ্যে দেশের ভাল উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক, স্বাস্থ্য খাতেÑশিক্ষা খাতে উন্নয়ন হয়েছে বেশি। এছাড়া ব্যবসাবাণিজ্যে প্রাইভেট সেক্টর ভালভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তবে আরও উন্নয়ন হতো যদি আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত। দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত ও টেকসই হবে। অর্থনীতি পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সাল থেকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রত্যাশার চেয়ে অকল্পনীয়ভাবে অনেক বেশি এগিয়েছে। শিল্প, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বাংলাদেশের অনেক সেক্টরই এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আমাদের ধরে রাখতে হবে। খাদ্য উৎপাদনসহ কৃষিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বহুমুখী সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও এ খাতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। মাত্র ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটিতে এখন বছরে চার কোটি টন চাল উৎপন্ন হয়। দুই বছর আগেও যা ছিল সাড়ে তিন কোটি টনের নিচে। অল্প সময়েই খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য এনেছেন দেশের কৃষকরা। ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে চাল রফতানি করে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে আরেকটি মাইলফলক। ধান চাষ ও চাল উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। আর এতে পাল্টে গেছে জিডিপির গ্রাফ। পরিসংখ্যান অনুসারে শুধু কৃষিখাতে জিডিপির অবদান ২১ শতাংশ। আর কৃষিশ্রমে ৪৮ শতাংশ। কৃষির সাব-সেক্টরসহ এ পরিসংখ্যান ৫৬ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ। আর আলু উৎপাদন কৃষি খাতের সাফল্যের এক বিস্ময়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল ৫০ হাজার টনের নিচে। এখন তা এগোচ্ছে কোটি টনের দিকে। এ সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের কাতারে। এ স্বীকৃতিটি দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৮২ লাখ ১০ হাজার টন উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে অষ্টম স্থানে। যোগাযোগ খাতে বঙ্গবন্ধু সেতু মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। রাজধানীর যানজট নিরসনে মহাখালী, খিলগাঁও, গুলিস্তান ও কুড়িল ফ্লাইওভারও বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এদিকে মালিবাগ মৌচাক ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হবে শিগগির। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে পদ্মা সেতু, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, মেট্্েরারেল, উড়াল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় প্রকল্প এগিয়ে নিচ্ছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি নৌপথ সচল করতে দেশের ৫৩টি নদীর খনন কাজ চলছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ব্যাংকিংসহ নানা কাজে এখন ডিজিটালের ছোঁয়া লেগেছে। নিমিষেই তথ্য জানতে বা জানাতে পারছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। রাষ্ট্রীয় অনেক সেবা পাওয়া যাচ্ছে সহজে। যোগাযোগ প্রযুক্তিতে উন্নতির শিখরে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও বাংলাদেশ এখন বিশ্ব সভায় প্রতিনিধিত্ব করছে। টানা দ্বিতীয়বারের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। দ্রুতই বিকাশ ঘটছে ই-শিল্প বাণিজ্যে। বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন দেখে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে শত হাজার কোটি টাকা আয় করবে। দেশের প্রায় ১১শ’ প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার তৈরি করছে। এই শিল্পে বহু তথ্যপ্রযুক্তিবিদ কাজ করে যাচ্ছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ সফটওয়্যার শিল্পে এক লাখের বেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ কাজ করবে। বাংলাদেশের তৈরি সফটওয়্যার বিদেশের বাজারে বড় ধরনের জায়গা করে নিয়েছে। এখন এই শিল্প থেকে প্রতিবছর এক শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় হচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে এ দেশ সফটওয়্যার রফতানি করে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রতিটি ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে প্রযুক্তি। এজন্য এক হাজার ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্রামাঞ্চলে বহু কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে কৃষি ও কমিউনিটি রেডিও। সব সঙ্কটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাবে দেশÑ এমন প্রত্যাশা থেকেই আমরা সামনের দিকে পা রাখছি। ২০২১ সালে যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে, তখন বাংলাদেশ হবে বিশ্বের মধ্যে উদাহরণ সৃষ্টিকারী একটি রাষ্ট্র। মার্কিন জরিপেও দেখা যাচ্ছে দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির উন্নয়নের কারণে দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন। এখনও অনেক মানুষেরই বিশ্বাস, উন্নয়নের চেয়ে গণতন্ত্র বেশি জরুরী। তবে এরকম বিশ্বাসীদের সংখ্যা কমছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একটি জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারসের তত্ত্বাবধানে জরিপটি করেছে আইআরআই। জরিপে অংশ নেয়া ৬৪ শতাংশ বাংলাদেশী মনে করেন, শিক্ষা, যোগাযোগ, অর্থনীতির উন্নয়নের কারণে দেশ ঠিক পথেই রয়েছে। তবে ৩২ শতাংশের মতে বাংলাদেশ ভুল পথে হাঁটছে; কারণ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। আইআরআই বলছে, ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী। তাদের নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। আইআরআই এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ড্রেক লুইটেন বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের কাছে অর্থনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বোঝা যাচ্ছে, যদিও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে সবক্ষেত্রেই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ ও গবেষণা করে আইআরআই। বাংলাদেশেও ২০০৮ সাল থেকে জরিপ পরিচালনা করে আসছে সংস্থাটি। তবে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা দরকার বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। ৬৮ শতাংশ মানুষ এটি মনে করেন তবে ২৩ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তার কোন দরকার নেই। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ, যুক্তরাজ্য প্রবাসী [email protected]
×