ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুব হাসান

চির তারুণ্যের প্রতীক

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৬ জুলাই ২০১৬

চির তারুণ্যের প্রতীক

দড়ির মতো পেশি নিয়ে লিকলিকে একজন মানুষ শুইয়ে ফেলছে একঝাঁক গুণ্ডাকে। সরল কিন্তু ক্ষুরধার চাহনি, সঙ্গে অদ্ভুত এক কৌশল প্রয়োগ! রূপালিপর্দায় লোকটার কা-কীর্তি দেখে সবাই ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। স্বকীয় একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সময় লাগেনি তার। খুব অল্পসময়েই বিশ্বের সুপারস্টার হয়ে উঠেন পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চির এই হ্যাংলা যুবক। যার ধ্যান জ্ঞান মার্শাল আর্ট। সেই মার্শাল আর্ট সুপারস্টার প্রায় চার দশক আগে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু আজও তিনি এক ও অদ্বিতীয়- ব্রুস লি। একাধারে একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্য রচয়িতা, শিক্ষক, দার্শনিক এবং ‘জিৎ কুনে দো’ নামক নতুন ধরনের মার্শাল আর্ট এর প্রতিষ্ঠাতা; তাকে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী মার্শাল আর্ট শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রে মার্শাল আর্টকে উপজীব্য করে যে ধারার সূচনা ঘটে তার রূপকার ব্রুস লি। ব্রুস লির জন্ম ১৯৪০ সালের ২৭ নবেম্বর। পুরো নাম ব্রুস ইয়ুন ফান লি। জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে হলেও গায়ে বইছিল চিনা রক্ত। শৈশব থেকে শুরু“করে জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হংকংয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সিনেমা ও টিভিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। বারো বছর বয়সে একদিন রাস্তার কিছু বখাটে ছেলে শত্রুতাবশত তাকে মারধর করে। আর এ ঘটনাটাই আমুলে পাল্টে দেয় তার জীবন, সেই সঙ্গে মার্শাল আর্ট আর বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতও। পরবর্তী সময়ে মনপ্রাণ ঢেলে মার্শাল আর্টে তালিম নেন তিনি। এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আয়ু মাত্র পাঁচ বছর। এই শিল্পে ব্রুসলি যোগ করেন নিজস্ব ধাঁচের কুংফু কৌশল। মার্শাল আর্টের সঙ্গে আরও অনেক শারীরিক কলা জুড়ে দিয়ে তৈরি করেন নতুন আর্ট ‘জিৎ কুনে দো’। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাস্টার ইয়াপ ম্যানের (ওচ) সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। ম্যান তাকে উইং চুন স্টাইলের মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। পরবর্তীতে লি নিজেই কুং ফু শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু“করেন এবং নিজেই ‘জিত কুন ডো’ নামক লড়াইয়ের কৌশল উদ্ভাবন করেন। মার্শাল আর্টের বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ব্রুস লি। তিনি তাঁর গতি এবং নির্ভুলতা কাজে লাগিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর বিভিন্ন অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করতেন। অনেকেই তাঁকে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী মার্শাল আর্ট শিল্পী মনে করেন। নাচে দক্ষ লি ১৮ বছর বয়সে জাতীয় প্রতিযোগিতায় হংকংয়ের ঐতিহ্যবাহী চা-চা নাচের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। তবে এই জিনিয়াসের মেজাজটা ছিল বেশ চড়া। সে কারণে বেশ কয়েক বার হংকং পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা পোহাতে হয় তার। এসব দেখে বাবা-মা তাঁকে পাঠিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের চায়নাটাউনে আত্মীয়ের রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন। ক’দিন বাদেই দর্শনশাস্ত্রে পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সিয়াটলেই তিনি তাঁর প্রথম কুংফু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় লি টিভিতে টুকটাক কাজ করতে থাকেন। ক্যালফোনির্য়ার ওকল্যান্ডে তিনি দ্বিতীয় কুংফু স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন টিভিতে কাজ করার সুবাদে তাঁর নামডাক হতে শুরু করে এবং তিনি আস্তে আস্তে হলিউডের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সেখানে স্ট্যান্টম্যান ও পার্শ্বচরিত্রে কিছু কাজও করেন। সেভাবে নজর কাড়তে না পারলেও আর্থিকভাবে লাভবান হোন। ফিরে আসেন হংকংয়ে। হংকংয়ে বেশ কয়েকটি ছবি নির্মিত হয় তাঁকে ঘিরে। ৩২টি চলচ্চিত্র এবং অনেক ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ব্রুস লিকে দেখা গেছে। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য পাঁচটি চলচ্চিত্র হলো- দ্য বিগ বস (১৯৭১), ফিস্ট অব ফিউরি (১৯৭২), ওয়ে অব ড্রাগন (১৯৭২), এন্টার দ্য ড্রাগন (১৯৭২) এবং দ্য গেম অব ডেথ (১৯৭৩)। এসব ছবির মাধ্যমে তিনি বিশ্বজোড়া আইকনিক ফিগার হয়ে উঠেন। জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি হলো, শেষ ও সর্বোচ্চ বলে কোন কিছুই নেই। তুমি একটা সীমাতে প্রবেশ করবে কিন্তু সেই স্থানে স্থির না থেকে তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। তোমাকে শুধুই এগোতে হবে, যদি সামনে না এগোও তাহলে সামনের জিনিসগুলো তোমাকে ঘিরে ধরে তাহলে তোমাকে ধ্বংস করে ফেলবে। প্রতিটি মানুষেরই উচিত সে যতটুকু পারে সর্বদাই তার থেকে বেশি কিছু করার চেষ্টা করা।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে লিন্ডা এমেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয় ব্রুস লির। ১৯৬৪ সালে তারা বিয়ে করেন। পরের বছর প্রথম সন্তান ব্রান্ডন লির জন্ম হয়। মেয়ে শ্যাননের জন্ম হয় চার বছর পর। ২৮ বছর বয়সে ব্রান্ডন একটি ছবির শূটিং চলাকালে ভুলবশত গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। চীন-মার্কিন যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবি ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। এটি তার সর্বশেষ ও সবচেয়ে সফল ছবি। এর প্রিমিয়ারের কয়েকদিন আগে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই মারা যান এই কিংবদন্তি। বেদনানাশক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মৃত্যুর আগে চিত্রায়িত এ্যাকশন দৃশ্যগুলো ‘গেম অব ডেথ’ ছবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালের জ্যাকি চ্যান, জেট লি, ডনি ইয়ান, স্টিভেন সিগাল ও জঁ ক্লোদ ভ্যান ডেমের মতো জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট তারকাদের পথপ্রদর্শক তিনি।
×