ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি

যে দুটি এ্যাপ ব্যবহার করে গুলশান হামলার ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ জুলাই ২০১৬

যে দুটি এ্যাপ ব্যবহার করে গুলশান হামলার ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল

ফিরোজ মান্না ॥ থ্রিমা ও উইকার নামগুলো একেবারেই নতুন। গুলশান জিম্মি ঘটনার পর এই দুটি নাম আলোচনায় উঠে আসে। এগুলো হচ্ছে মোবাইল এ্যাপের নাম। যা দিয়ে দ্রুততম সময়ে মেসেজ, ছবি, অডিও এবং ভিডিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পাঠানো যায়। মুহূর্তের মধ্যে প্রাপক তা পেয়ে যান। প্রাপক মেসেজ, ছবি, অডিও ভিডিও পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভার থেকে সমস্ত তথ্য মুছে যায়। তৃতীয় পক্ষ এ সব তথ্য কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারে না। এমন কি এসব এ্যাপ কোনভাবেই হ্যাক করা যায় না। সেদিন জঙ্গীদের ব্যবহৃত জঙ্গীবাদী এ্যাপ দুটি ডাউনলোড করে সহযোগিতা করেছিল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম। দুই বিদেশীর মোবাইলে এ্যাপ দুটি ডাউনলোড করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি জঙ্গীবাদী সংগঠনের মুখপত্র ‘আমাক’ নিউজ এজেন্সির কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ওসব ছবি ও ভিডিও চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সের স্বত্বাধিকারী রিটা কাৎসের কাছে। যদিও গুলশানের ঘটনার পর এ্যাপ দুটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বলেন, এ রকম হাজারো এ্যাপ রয়েছে যেগুলো হ্যাক করা যায় না। বিভিন্ন সংস্থা তাদের নিরাপত্তার জন্য এসব এ্যাপ ব্যবহার করে। মুশকিল হচ্ছে এই এ্যাপগুলো এখন জঙ্গীরাও ব্যবহার করা শুরু করেছে। থ্রিমার ও উইকার এ্যাপ ব্যবহার করতে কোন ই-মেইল আইডির প্রয়োজন নেই। ফলে নিরাপদে দ্রুততম সময়ে ছবি, অডিও ভিডিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পাঠিয়েছিল জঙ্গীরা। নিরাপদ এনক্রিপশন এ্যাপ জঙ্গীদের হাতে চলে আসায় বিষয়টি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ্যাপগুলো ভাল কাজের জন্য আবিষ্কার করা হলেও এখন জঙ্গীরা এটাকে তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। গুগলের তথ্যে জানা গেছে, ২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে জার্মান বংশোদ্ভূত ম্যানুয়েল ক্যাসপার এই থ্রিমা এ্যাপসটি তৈরি করেন। পরের বছর ২০১৩ সাল থেকেই স্মার্ট ফোনে এটি এন্ড্রয়েড এ্যাপস হিসেবে চালু হলেও জার্মান এ্যাপস হিসেবেই থ্রিমা সারাবিশ্বে পরিচিত। থ্রিমা এ্যাপস ব্যবহার করার সময় কোন ই-মেইল আইডি বা মোবাইল ফোন নম্বরের প্রয়োজন হয় না। একটি কুইক রেসপন্স কোড (কিউআর কোড) দিয়ে কাক্সিক্ষত মোবাইল ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এই এ্যাপস ব্যবহার করলে দুটি মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সময় অযাচিত কোন তৃতীয় ব্যক্তি কোনভাবেই তা ট্রেস করতে পারবে না। দু’পক্ষের কথোপকথনের মাঝেও ঢুকতে পারবে না। অ্যাপসটি এতই নিরাপদ যে ই-মেল আইডি বা মোবাইল ফোন নম্বরের পরিবর্তে কিউআর কোড ব্যবহার করায় দু’প্রান্তের যোগাযোগকারীদের শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না। উইকার হচ্ছে প্রাইভেট বার্তা আদান-প্রদানের এ্যাপ। এটি ব্যবহার করে টেক্সট, ছবি, অডিও বার্তা আদান-প্রদান করা যায়। এটিও থ্রিমার মতোই নিরাপদ এনক্রিপশন করা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থার হাত থেকে ব্যবহারকারীর ফোন সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন এ্যাপ্লিকেশন নির্মাতা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে, বেশকিছু এ্যাপ নির্মাতা দাবি করেছেন, সরকারের কঠোর নজরদারি এড়িয়েও তাদের এ্যাপের সাহায্যে যোগাযোগ করা সম্ভব। গোপনীয়তা রক্ষাকারী এ্যাপের তালিকায় রয়েছে সাইলেন্ট সার্কেল ও উইকার মতো আরও কিছু এ্যাপ। এ্যাপগুলোর নির্মাতারা জানিয়েছেন, এ্যাপগুলোর ‘মিলিটারি-গ্রেড এনক্রিপশন’ ক্ষমতা রয়েছে। এগুলো থ্রিজি, ফোরজি বা ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ফোন, টেক্সট মেসেজ ও ভিডিও ফাইল নিরাপদে স্থানান্তর করা সম্ভব। আইফোন এবং স্মার্টফোনের জন্য এ রকম কিছু এ্যাপ রয়েছে। এ্যাপগুলো নিজস্ব পরিচয় লুকাতে ব্যবহারকারীকে সাহায্য করে। এমন কি এ্যাপগুলোর মাধ্যমে ফোনের কথোপকথনের বিষয়বস্তুও পরিবর্তন করা যায়। বিটিআরসির কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার (এ্যাপ নিয়ে কাজ করেন) বলেন, উইকার ব্যবহার করে টেক্সট বা মেসেজ আদান-প্রদান করা যায়। এটিও থ্রিমার মতোই নিরাপদ এনক্রিপশন করা এ্যাপ। থ্রিমা এ্যাপটি ব্যবহার করে নিরাপদে ছবি অডিও ভিডিও আদান-প্রদান করা হয়। এটি এনক্রিপশন বা নিরাপদে বার্তা পাঠানো। এই এ্যাপ ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদানের সময় তৃতীয় পক্ষ কোনভাবেই তা ধরতে পারবে না। এটি অনেকটা জনপ্রিয় মেসেজিং এ্যাপ টেলিগ্রামের মতোই। টেলিগ্রামও এনক্রিপশন করা। গুলশান ঘটনায় মেসেঞ্জার এ্যাপ থ্রিমা এবং উইকার বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবে গুগলে ঢুকে হাজার রকমের এনক্রিপশন এ্যাপ ডাউনলোড করা সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়াটা অনেক বড়। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষরা একটা বন্ধ করলেও অন্যটার সন্ধান করে নিতে পারে। সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, থ্রিমা গোপনীয় বার্তা আদান-প্রদান সংক্রান্ত একটি অত্যাধুনিক এ্যাপ। এটি সার্ভার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বার্তা মুছে ফেলতে পারে। থ্রিমা ব্যবহারকারীদের পরিচয় গোপন রাখে। ফলে এর ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, সুইজারল্যান্ডের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি থ্রিমা এ্যাপসটি তৈরি করেছে। এর সার্ভারও সুইজারল্যান্ডে। তবে এর ব্যবহারকারীদের মধ্যে জার্মানদের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ থ্রিমা ব্যবহার করে। থ্রিমা হচ্ছে তাৎক্ষণিক মেসেজ পাঠানোর এমন একটি এ্যাপ যা ব্যবহারকারীর তথ্য গোপন রাখে। এটি আইফোন, এ্যান্ড্রয়েড ও উইন্ডোজ পরিচালিত ফোনসহ সব ধরনের ফোনে ব্যবহার করা যায়। ক্ষুদে বার্তার পাশাপাশি এর মাধ্যমে ভয়েজ মেসেজ, ছবি, ভিডিও ইদ্যাদি আদান-প্রদান করা যায়। জঙ্গী সংগঠন আইএস এই এ্যাপগুলো ব্যবহার করছে। আগে আইএস টেলিগ্রাম এ্যাপ ব্যবহার করত। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রাম এ্যাপসটি কিনে নিলে ধীরে ধীরে আইএস এই এ্যাপস থেকে সরে যায়। থ্রিমা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুসারে, ম্যাসেজ প্রেরণকারী ও প্রাপকই কেবল এ্যাকাউন্টে এ্যাক্সেস করতে পারে। এর বাইরে কোন এ্যাক্সেস করার সুযোগ নেই। এমনকি সেবা প্রদানকারী কোম্পানিটিও কোন এ্যাকাউন্টে এক্সেস করতে পারে না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, থ্রিমা ও উইকার মেসেজিং এ্যাপ বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশ পাওয়ার পর ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, ইন্টারনেট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তা কার্যকর করেছে। অবশ্য বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়ার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, থ্রিমার হচ্ছে ছবি পাঠানোর একটি এ্যাপ আর উইকার হচ্ছে মেসেসিং এ্যাপ। এ দুটি এ্যাপ এত নিরাপদ যে, কেউ হ্যাক করতে পারে না। বিটিআরসি এ দুটি এ্যাপ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও এ ধরনের হাজারো এ্যাপ আছে যেগুলো কেউ হ্যাক করতে পারে না। এ সব এ্যাপের সার্ভার সুইজারল্যান্ডসহ উন্নত দেশের হাতে। তারা ইচ্ছে করলে অডিও ভিডিও বা টেক্স উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু শর্তানুযায়ী তারা তা করে না। তাই বিটিআরসির এই উদ্যোগ খুব একটা কার্যকর হবে কিনা বলা মুশকিল। কারণ এর আগে বিটিআরসি ফেসবুক টুইটারসহ আরও কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ওসব প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমই ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় কোন কিছুই বন্ধ করে রাখা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গত বছরের নবেম্বরে বার্তা সংস্থা এএফপি থ্রিমা এ্যাপস নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে থ্রিমা কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র রোমান ফেল্পের কাছে জানতে চেয়েছিল, এই ধরনের এ্যাপস ও গোপানীয়তা সন্ত্রাসীদের (আইএস) সহায়ক হচ্ছে কি না? উত্তরে তিনি বলেন, সন্ত্রাসের সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তাই শুধু নজরদারি বাড়িয়ে সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। তারা কোনভাবেই এ্যাপটির নিরাপত্তা কাঠামোয় কোন পরিবর্তন আনবেন না। অন্যদিকে, টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, থ্রিমা ব্যবহার করার ফলে গুলশান হামলার ‘ফরেনসিক ক্লু’ খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর।
×