ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গী অর্থায়নে ৫৬৩ সন্দেহজনক এনজিও চিহ্নিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৬ জুলাই ২০১৬

জঙ্গী অর্থায়নে ৫৬৩ সন্দেহজনক এনজিও চিহ্নিত

রহিম শেখ ॥ জঙ্গী বা উগ্রপন্থীদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য শুধু ব্যাংক-বীমা কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ টাকা এসেছে দেশে। এসব এনজিও’র অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। ধর্মভিত্তিক নাম দেয়া এসব এনজিওতে অর্থ বা সহায়তা আসত মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্তত এগারোটি দেশ থেকে। চলত নানামুখী কর্মকা-। আড়ালে হতো জঙ্গী অর্থায়ন। সম্প্রতি এসব এনজিও’র তালিকাসংবলিত একটি প্রতিবেদন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং নাশকতা সৃষ্টিতে সন্দেহভাজন ৫৬৩ এনজিও চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব এনজিও দেশে সিএসআরের নামে বিভিন্ন জিহাদী প্রকল্পে জঙ্গী-সন্ত্রাসী অর্থায়ন করেছে। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় সাত হাজার এনজিওকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। এসব এনজিওর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণের অর্থ আসে বাংলাদেশে। এ অর্থ দেশে আসার পর কোথায় কিভাবে খরচ করা হয়েছে তার তথ্য অজানা সবার কাছে। তবে গোয়েন্দা তথ্যমতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, কাতার, সৌদি ও যুক্তরাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ এসেছে এসব এনজিওতে। এসব অর্থের একটি বড় অংশই জঙ্গী তৎপরতার কাজে ব্যয় করা হয়েছে। সম্প্রতি আইন সংশোধন করে এনজিওর বিদেশী অনুদানপ্রাপ্তি কঠিন করা হলেও দেশ-বিদেশ থেকে জঙ্গী অর্থায়নের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সূত্র মতে, জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত বলে অভিযুক্ত এনজিওর বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এ তালিকায় রয়েছে রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইচএস), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী, সোসাইটি অব সোশ্যাল রিফর্ম, কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি, আল মুনতাদা আল ইসলামী, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফুরকান ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও), কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, মুসলিম এইড, দার আল-খায়ের, তাওহিদী নূর, সৌদিভিত্তিক হায়াতুল ইগাছা এবং দ্য গ্রিন ক্রিসেন্ট। জেএমবির আর্থিক মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী সৌদি আরব সরকারের একটি সাহায্য সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ (এমডব্লিউএম) নামে পরিচিত। এটির আরেকটি সহযোগী এনজিও ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও)। সম্প্রতি জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫৬৩ এনজিও নামের তালিকাসংবলিত একটি প্রতিবেদন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সারাদেশে জামায়াত ও এর নেতাদের পরিচালিত ৫৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে কারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের নামের তালিকাও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠান ও এগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনজিও ব্যুরোর পরিচালক কেএম আব্দুস সালাম বলেন, আমরা বেশ কিছু এনজিওকে নজরদারিতে রেখেছি। তাদের খুঁটিনাটি তথ্য নিচ্ছি। হিসাবে গরমিল আছে কিনা, অর্থ কোথায় ব্যয় হয়, সে হিসাব রাখছি। অনিয়ম, জঙ্গী অর্থায়নের প্রমাণ মিললেই তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ শতাধিক ধর্মভিত্তিক এনজিও আছে, যেগুলো কার্যক্রম চালাতে পারছে না। অনেক এনজিও মাঠপর্যায় থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। অনেকে পুনর্নিবন্ধন করতে আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই কোন একসময় এগুলোর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। কালো তালিকাভুক্ত অনেক এনজিও এই ফতুরের তালিকায় আছে। সুযোগ পেলে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। সক্ষমতা ও দক্ষ জনবলের অভাবের কথা জানিয়ে মোঃ আসাদুল ইসলাম বলেন, আমরা কিন্তু বসে নেই। সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আমরা এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি। প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে বিদেশী অর্থায়নপুষ্ট এনজিওগুলোর কার্যক্রম নিবিড় পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়া জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা বেশকিছু এনজিও রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধেও জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন, জাস্টিস কনসার্ন, ইসরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসহারুল মুসলিমিন, রাবিতা আল আলম আল ইসলামী, আল হারামেইন ইসলামী ফাউন্ডেশন, আল ফোরকান ফাউন্ডেশন, ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশন, সার্ভেন্টস অব সাফারিং হিউমিনিটি ইন্টারন্যাশনাল, ইসলাহুল মুসলিমিন, রিভাইভ্যাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি, রাবেতা তৌহিদ ট্রাস্ট, বেনোভোলেন্ট ট্রাস্ট, আল হারমেইন, কুয়েত চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, ইসলামিক এইড সমিতি, এ্যাসোসিয়েট অব মুসলিম ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন, আদর্শ শিক্ষা পরিষদ, আদর্শ কুটির, এগ্রো-ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট, আল ফারুক সোসাইটি, আল আমিন, আল মুদারাবা ফাউন্ডেশন লিমিটেড, আল মজিদ সোসাইটি, আল ইনসান-সুনিসি সমিতি, আঞ্জুমান ইতিহাদ বাংলাদেশ, এ্যাসোসিয়েশন ফর ওয়েলফেয়ার অব হিউম্যান সার্ভিসেস, এ্যাসোসিয়েশন অব মুসলিম ওয়েলফেয়ার এজেন্সি ইন বাংলাদেশ, বায়তুস সার্ফ ফাউন্ডেশন লিমিটেড, সাঁথিয়া-বাংলা পরিষদ, বাংলাদেশ কৃষি কল্যাণ সমিতি, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মসজিদ সমাজ, দারুল ইফতা, দারুস সালাম সোসাইটি, ধলেশ্বরী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, আল ফারুক ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মানারাত ট্রাস্ট। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এসব এনজিও থেকেই অর্থ পাচ্ছে জঙ্গীদের আত্মঘাতী গ্রুপের মধ্যে থাকা কতল বাহিনী, শহীদ নাসিরুল্লাহ খান আরাফাত ব্রিগেড, আল্লাহর দল ব্রিগেড, আহসাব বাহিনী, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবিটি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ জেএমজেবি, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল হিকমা, হিযবুত তাহরীর, হরকাত-উল জিহাদ-আল-ইসলামী বাংলাদেশ হুজি এবং সরকারিভাবে কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন আল্লাহর দল, ইসলামী সমাজ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, তামির-উল-দীন বাংলাদেশ, তাওহিদ ট্রাস্ট নামের তথাকথিত জিহাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা। এসব জঙ্গী সংগঠনসহ জামায়াত-শিবির ও বিভিন্ন ইসলামী দলের অনেক কর্মী বিদেশে রয়েছেন, যারা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জঙ্গী সংগঠনগুলোকে সরবরাহ করছেন। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের আলোকে জঙ্গী অর্থায়নে জড়িত এনজিওর কার্যক্রম কঠোর নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, জিহাদীকরণ প্রক্রিয়াতে ধর্মীয় চ্যারেটির মাধ্যমে অর্থায়ন হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে সরকারী নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
×