ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন

পিস স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রহস্যজনক তদন্ত শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৬ জুলাই ২০১৬

পিস স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে রহস্যজনক তদন্ত শুরু

বিভাষ বাড়ৈ ॥ জামায়াত-শিবিরের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক আদর্শে দেশে পিস স্কুল চলছে- সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার এমন সুনির্দিষ্ট তদন্ত রিপোর্টের পরেও নীরব শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুই মন্ত্রণালয়ে এ রিপোর্ট আসার পর চার মাস চলে গেলেও বিতর্কিত বক্তা জাকির নায়েকের প্রতিষ্ঠান পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের লোগো শব্দ ব্যবহার করেই নির্বিঘেœ চলছে শিক্ষার নামে জঙ্গবিাদী কার্যক্রম। গোয়েন্দা রিপোর্টের পরেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ড এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা না নিয়ে এবার রহস্যজনক কারণে নতুন করে আবার তদন্ত শুরু করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আলাদা তদন্ত করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও (এনসিটিবি)। সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেশে অন্তত ২৭ পিস স্কুলে জামায়াত-শিবিরের কর্মকা- চলার প্রমাণ মিলেছে আগেই। সংস্থাটি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুই মন্ত্রণালয়ের সুপারিশও পাঠায়। কিছুদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, এসব স্কুলের বিষয়ে আমাদের কাছেও গুরুতর অভিযোগ এসেছে। আমরা শিক্ষা বোর্ডগুলোতে চিঠি পাঠিয়ে জানতে চেয়েছি কিভাবে স্কুলগুলো অনুমোদন পেয়েছে, কারা এসব অনুমোদন দিয়েছে আর অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছেন কারা। এছাড়া জঙ্গীবাদী প্রচারণার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতে পিস টিভি বন্ধের পর পিস স্কুল বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছিল। কিন্তু প্রথমে রবিবার এনসিটিবি ও সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন করে তদন্ত করার ঘোষণায় উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিএনপি-জামায়াত পন্থী কয়েক কর্মকর্তা অপচেষ্টা করছেন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট এরিয়ে কাজ করতে। তাদের উদ্দেশ্য উগ্রবাদী এসব প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা। এজন্য আগের রিপোর্ট এড়িয়ে দফায় দফায় তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার অপকৌশল নিয়েছেন তারা। তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে বিতর্ক না উঠলেও অভিযোগ উঠেছে তাদের নিয়ন্ত্রণকারী এক কর্মকর্তাকে নিয়ে। বিএনপি-জামায়াত পন্থী এ কর্মকর্তার বাবা একাত্তরে ‘বন্ধু’ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে শান্তি কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন বলে ইতোমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। তার কর্মকা- নিয়ে ইতোপূর্বে কয়েক দফা প্রশ্ন ওঠার পর এখন আবার তার প্রভাব নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, পিস স্কুলের নামে জঙ্গীবাদী কর্মকা- চলছে প্রমাণ পাওয়ার পর সে অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষেই মতামত ছিল অধিকাংশ কর্মকর্তার। কিন্তু কয়েকজনের কারণে আবার তদন্ত করতে হচ্ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে পিস স্কুলগুলোর কর্মকা- তদন্তে সোমবার দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটির সদস্যরা হলেন- উপ সচিব সালমা জাহান ও এনামুল হক। ১৫ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে সারাদেশের পিস স্কুলের কর্মকা- নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে তদন্ত কমিটিকে। এর আগে রবিবার পিস স্কুল নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কী পড়াচ্ছে, সরকারী কারিকুলামের বই পড়াচ্ছে কিনা, কি কি অননুমোদিত বই পড়াচ্ছে- এসব অনুসন্ধান করবে এ তদন্ত কমিটি। গবেষণা কর্মকর্তা আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করছে। এদিকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ‘পিস’ নামের তিনটি স্কুলকে শোকজ করেছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। বোর্ডের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে শোকজের চিঠি পাঠানো হয়। শোকজ পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, রাজধানীতে ‘পিস’ নামের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে। এর মধ্যে দুটি কলেজ এবং একটি স্কুল ও কলেজ। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজটি লালমাটিয়ায় অবস্থিত। আর কলেজ দুটির একটির নাম ঢাকা পিস কলেজ। এটি ভাটারা থানায় অবস্থিত। অপরটির নাম পিসফুল কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি বনশ্রীতে অবস্থিত। তিনি বলেন, ঢাকায় এ ধরনের কতটি প্রতিষ্ঠান আছে আমার জানা নেই। তবে শুনেছি ধানম-ি, মিরপুর ও উত্তরায় অনুমোদনহীন তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোর মধ্যে উত্তরারটি বেশি ভয়ংকর। সেটির থিম সংয়ে আপত্তিকর কথামালা আছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হবে। তবে বারবার কেন তদন্ত করা হচ্ছে? এমন প্রশ্নে কোন উত্তর দিতে রাজি নন কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিতো আপনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।’ এ কর্মকর্তা জানেন না বলে দাবি করলেও উপ-সচিব সালমা জাহান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ১৫ দিনের সময় দিয়ে তদন্ত করার কথা বলা আছে। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা কেউ কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। এক কর্মকর্তাকে নতুন তদন্ত ও এতদিনেও ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আলোচনা হয়েছিল নতুন কোন পিস স্কুল হতে পারবে না। এবং আগের সব বন্ধ করা হবে। কিন্তু এখন আবার কেন তদন্ত করা দরকার হচ্ছে সে বিষয়ে স্যাররা বলতে পারবেন। জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোপোর্টেই ঢাকাসহ দেশের ১৫টি জেলায় ‘পিস’ নাম যুক্ত করে ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের প্রায় সবাই জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মী। জনগণের চোখে ধুলা দিতে কোথাও আওয়ামী লীগের নেতা আবার কোথাও বিএনপি নেতাদের সভাপতিসহ পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকার সমর্থক ব্যক্তিদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশও করা হয়েছিল রিপোর্টে। তদন্ত রিপোর্ট বলছে, জামায়াতের ‘পিস স্কুল’, চলছে জঙ্গীবাদী কর্মকান্ড দেশের ছয়টি জেলায় পরিচালিত ২৭টি পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ জামায়াতের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজনৈতিক আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। ‘পিস’ শব্দটি ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের শতাধিক স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে জামায়াতের দলীয় আদর্শের পাঠ্যবই পড়ানো হয়। এসব স্কুলের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। আবার কোন কোন স্কুল পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও রয়েছেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় নামে- বেনামে পরিচালিত স্কুলগুলোকে জামায়াত-শিবির সাংগঠনিক কাজে ব্যবহার করছে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। পিস স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জামায়াত-শিবিরের নেতা ও জড়িত সরকারী কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে এতে। এ ছাড়া স্কুলের আয়ের উৎস ও ব্যয় খতিয়ে দেখতেও বলা হয়েছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলার কথাও আছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এসব প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার জন্য দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়ার সুপারিশও আছে। প্রতিবেদনে পিস স্কুলের শিক্ষার্থীরা উগ্র ধর্মীয় মতবাদে দীক্ষিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন কোন পিস স্কুল পরিচালিত হয় ‘ইনভাইটস পিস লিমিটেড’ নামের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর জামায়াতের রোকন আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক স্কুল কার্যক্রম সম্পাদক ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর জামায়াতের রোকন আলমগীর মোঃ ইউনুস। পিস স্কুলে কেন্দ্রীয় জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য ড. আহসান হাবীব ইমরোজ সম্পাদিত বাংলা বই, সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী ও মতিউর রহমান নিজামীর লেখা সাংগঠনিক বই পড়ানো হয়। পিস স্কুলের বিষয়ে বোর্ডের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথ্য চেয়েছিল জানিয়ে ঢাকা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, আমরা লালমাটিয়ার পিস স্কুলের তথ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। লালমাটিয়ার বি-ব্লকের হাউস ৪/৯ এর ‘পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের’ জুনিয়র সেকশন এবং লালমাটিয়ার বি-ব্লকেরই হাউস ৫/৭-এ এই স্কুলের সিনিয়র সেকশন পরিচালিত হচ্ছে। যোগাযোগ করা হলে এই স্কুলের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সাল থেকে তারা স্কুল পরিচালনা করছেন। ইংরেজী মাধ্যমের এই স্কুলে প্লে-গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। সরকারের অনুমোদন ছাড়া যেসব পিস স্কুল পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোতে আরবী, ইংরেজী ও বাংলার সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয় বলে স্কুলগুলোর ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে। ঢাকার মালিবাগ, উত্তরা ও মিরপুরের তিনটি পিস স্কুলের যোগাযোগের নম্বরে যোগাযোগ করলেও কেউই ফোন ধরেননি। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য স্কুলগুলোর ওয়েবসাইটে দেয়া মোবাইল নম্বরগুলোও বন্ধ পাওয়া যায়। ঢাকার ৪০০/বি মালিবাগ চৌধুরীপড়ায় ‘পিস স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় চলছে। পিস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে উত্তরা ও মিরপুরে দুটি স্কুলের খোঁজ পাওয়া গেছে। উত্তরা ক্যাম্পাসের ঠিকনায় লেখা আছে- হাউস ৫৯, রোড ৫, সেক্টর ১৩, উত্তরা মডেল টাউন। আর মিরপুর ক্যাম্পাসের ঠিকানা- প্লট-৫, রোড-২৮/ক, রূপনগর আবাসিক এলাকা। ঢাকাসহ সারা দেশে পিস স্কুলের নামে ২৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন। শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অনেকেই বলছেন, জঙ্গী হামলার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে দেশের সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ এবং মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জঙ্গীবাদ নিয়ে বৈঠক করলেও পিস স্কুল নিয়ে কেবল তদন্ত তদন্ত খেলা হচ্ছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠান শিশু-কিশোরদের ইসলাম শিক্ষা দেয়ার নামে ‘উগ্রতা’ শেখাচ্ছে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের বিষয়ে চুপ থাকলেও আতঙ্কের কারণে গত কয়েক দিনে একাধিক পিস স্কুল তাদের সাইনবোর্ড পরিবর্তন করেছে। এরই মধ্যে উত্তরা ও রাজশাহীসহ কয়েকটি শহরে তারা পিস স্কুল এন্ড কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে নিয়েছে। পিস স্কুলের পরিবর্তে তারা কোথাও লিজেন্ড একাডেমি নাম দিচ্ছে আবার কোথাও কোন নামই রাখছে না। ইনভাইট পিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাবেক শিবির সভাপতি প্রচার করা হয়, পিস স্কুল দেশের প্রথম ত্রিভাষিক চেন স্কুল। এই প্রতিষ্ঠানে আরবী, ইংরেজী ও বাংলার সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। তবে জানা গেল, রাজধানীতে পিস স্কুল এ্যান্ড কলেজ পরিচালিত হচ্ছে ইনভাইট পিস লিমিটেড নামক একটি কোম্পানির মাধ্যমে। এর চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ। তিনি ছাত্রশিবিরের ১১তম সভাপতি ছিলেন। যিনি ১৯৯১-৯২ সেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাকে বিভিন্ন সময় ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে দেখা গেছে। ছাত্রশিবিরের মুখপত্র ছাত্র সংবাদেও নিয়মিত লিখেন ওবায়েদুল্লাহ। এই ইনভাইট পিস লিমিটেড সারাদেশে অনেক শাখা স্কুল পরিচালনা করছে। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, দিনাজপুর ও খুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। মালিবাগ শাখার তৃতীয় শ্রেণীর এক ‘ন’ আদ্দাক্ষরের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার সঙ্গে তার মাও উপস্থিত ছিলেন। মায়ের হাত ধরে শিশুটি বলছিল, স্যাররা আমাদের বলেছেন, এখানে পড়লে আল্লাহ খুশি হবেন। ড. জাকির নায়েক আমাদের স্কুল দেখতে আসবেন। তিনিই এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে জাকির নায়েক ইস্যুতে কোন শিক্ষক আ অন্য কেউ কথা বলতে রাজি হননি। খিলগাঁও থেকে আসা সপ্তম শ্রেরীর এক ছাত্রকে তাদের পড়ালেখা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেই এক বাক্যে উত্তর দিচ্ছিল, আমাদের স্কুল ভাল। স্যাররা বলেছে, ‘এখানে পড়লে নিজ ধর্মের জন্য কাজ করতে পরব।’ অন্য ধর্ম কেমন? এ প্রশ্নে তার উত্তর, ‘হিন্দুরাতো কাফের। অন্যরাও তাই। এজন্যইতো এখন তাদের কতল করা হচ্ছে।’ জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে প্রশ্ন করা হলে এ ছাত্রের উত্তর, না আমাদের এসব গাওয়া হয় না। লালমাটিয়া শাখায় অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেল বেশ কিছু তথ্য। জানা গেল, এখানে জাতীয় সঙ্গীত যেমন নিষিদ্ধ তেমনি শেখানো হয় ‘জাতীয় সঙ্গীত’ খারাপ। এটা গাওয়া হারাম। এসব ইসলামবিরোধীদের বিষয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানের এক শিশুশিক্ষার্থী কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের কাছে বলেছিল, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন কাফের। এদের সঙ্গে মেলামেশা যাবে না। তাদের সঙ্গে বদ্ধুত্ব করা মহপাপ। ‘পিস স্কুল’ ও ‘পিস পাবলিকেশন’ নিষিদ্ধের দাবি ॥ জাকির নায়েকের ‘পিস’ শব্দ ব্যবহার করে জামায়াত-শিবিরের চালানো ‘পিস স্কুল’ ও ‘পিস পাবলিকেশন’ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন দেশের বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় পিস শব্দ ব্যবহার করে অসংখ্য স্কুল ও কলেজ পরিচালনা করছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির, যেখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে জামায়াতের দলীয় আদর্শের পাঠ্যবই পড়ানো হয়। বাংলাদেশ থেকে যেসব আলোচক পিস টিভির অনুষ্ঠানে গিয়ে জঙ্গীবাদের পক্ষে কথা বলেছেন তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। পিস পাবলিকেশন ও পিস স্কুলও নিষিদ্ধ করতে হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বাংলাদেশের নির্বাহী চেয়ারম্যান আল্লামা অধ্যক্ষ শেখ আব্দুল করিম সিরাজনগরী ও নির্বাহী মহাসচিব আল্লামা মাসউদ হোসাইন আল কাদেরী এক বিবৃতিতে বলেছেন, পিস পাবলিকেশন ও পিস স্কুল ও কলেজ বন্ধ করা অপরিহার্য। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান আল্লামা এমএ মান্নান বলেছেন, পিস পাবলিকেশন, পিস স্কুল ও কলেজ বন্ধ করাসহ ওদের পৃষ্ঠপোষক এবং মতাদর্শ লালনকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে না পারলে দেশকে জঙ্গীবাদমুক্ত করা সম্ভব হবে না। পিস পাবলিকেশন ও পিস স্কুলের মাধ্যমে হাজার হাজার নিবরাস ইসলাম আর রোহান তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানানোর জন্য। তাই পিস পাবলিকেশন ও পিস স্কুল নিষিদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা বলছে, সরকার জঙ্গীবাদের উস্কানিদাতা পিসটিভি বন্ধ করেছে। কিন্তু জঙ্গী উন্মাদনা সৃষ্টিকারী পিসটিভির ভাষ্যকার বিলাল ফিলিপসের উগ্র ধর্মীয় চেতনার বইসমূহ এখনও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী অনুযায়ী পাঠ দান চলছে। সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেন, জঙ্গীবাদী বিলাল ফিলিপসের ‘তাওহীদ’ বইটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ৯ম-১০ম শ্রেণীতে পাঠ্য করা হয়েছে এবং নর্থ-সাউথসহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ নামে এই উগ্রবাদী লেখকের বইসমূহ সিলেবাসভুক্ত করে পড়ানো হচ্ছে। এসব বইয়ে ইসলামের শাশ্বত মূলনীতি বিরোধী ও জিহাদের অপব্যাখ্যা করে ধর্মীয় উগ্রবাদ সৃষ্টির শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সরকার দেশ থেকে জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটন করতে চাইলে অবশ্যই এসব বিতর্কিত বই নিষিদ্ধ করতে হবে এবং বাংলাদেশে এসব বই প্রকাশনায় জড়িত সিয়ান ও পিস পাবলিকেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
×