ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিষয় : মীর কাশেমের রিভিউ পেছানো;###;প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- সবাই একমাস সাবধান থাকবেন ;###;মাফ চেয়েও রেহাই পাননি তথ্যমন্ত্রী

মন্ত্রিসভায় অসন্তোষ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৬ জুলাই ২০১৬

মন্ত্রিসভায় অসন্তোষ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি আসামিপক্ষের সময়ের আবেদনে এক মাস পিছিয়ে দেয়ায় মন্ত্রিসভায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ মামলাটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটি কারণ। তিনি বলেন, শুনানির জন্য সময় দেয়া এই এক মাসে দেশকে আরও অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা চালাবে। সকলে সতর্ক থাকুন। পাশাপাশি বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেও পার পাননি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। টিআর-কাবিখা প্রকল্পে চুরির জন্য সাংসদসহ জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের দায়ী করে বক্তব্য দেয়ায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সহকর্মীদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। গুলশানসহ রাজধানীর সকল আবাসিক এলাকায় অবৈধ হোটেল-রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এদিকে মন্ত্রিসভা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন আইন-২০১৬ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিতি একাধিক মন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় মীর কাশেম আলীর মামলা নিয়ে আলোচনার শুরু হয়। এ মামলার শুনানি এক মাস পিছিয়ে দেয়ায় মন্ত্রিসভায় উপস্থিত সকল সদস্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বিষয়টি উত্থাপিত হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, অন্য কোন যুদ্ধাপরাধীর মামলা রিভিউয়ে এত বেশি সময় দেয়া হয়নি। এমনকি দলের প্রধান নিজামীর ক্ষেত্রেও এত সময় দেয়া হয়নি। যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে রিভিউয়ের আবেদনের শুনানি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এ মামলাটির শুরুতেই এক মাসের বেশি সময় দেয়া হয়েছে। এখন আবারও এক মাস পিছিয়ে দেয়া হলো। এটি মোটেও সুখকর নয়। অন্য এক সিনিয়র মন্ত্রী বলেন, মীর কাশেম আলীর মামলা ঝুলে থাকায় দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এটি শেষ হলে দেশের জঙ্গীবাদ আর থাকবে না। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মামলাটি দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, সময় বাড়ানোতে এই এক মাস সকলে সাবধান থাকবেন। একে তো আগস্ট মাস। দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে ব্যাপক চেষ্টা চালাতে পারে। এমন খবর আমাদের কাছে আছে। তাই সকলে সতর্ক থাকবেন। এদিকে বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেও পার পাননি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। টিআর-কাবিখা প্রকল্পে চুরির জন্য সাংসদসহ জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের দায়ী করে বক্তব্য দেয়ায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে সহকর্মীদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে তথ্যমন্ত্রীকে। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইনু ওই বক্তব্যের জন্য আরেক দফা দুঃখপ্রকাশ করেছেন বলে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন। একজন মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ নিয়ে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ওই বক্তব্য দিয়ে তিনি (তথ্যমন্ত্রী) নিজেসহ সকলকে চোর বানিয়েছেন। রবিবার ‘বাংলাদেশ সামিট : টেকসই উন্নয়ন ২০১৬’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো এমপি, আমি জানি, টিআর কিভাবে চুরি হয়। সরকার ৩০০ টন দেয়, এর মধ্যে এমপি সাহেব আগে দেড় শ’ টন চুরি করে নেয়। তারপর অন্যরা ভাগ করে। সব এমপি করে না। তবে কিছু এমপিরা করে।’ ওই বক্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর আসার পর রাতে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইনু বলেন, ‘আমি নিজে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকভাবে সম্মান করি এবং সেই সম্মান অক্ষুণœ রয়েছে। তারপরও কেউ যদি অনভিপ্রেতভাবে দুঃখ পেয়ে থাকেন, সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’ তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে খবর ও তার দুঃখ প্রকাশের বিবৃতির অনুলিপি খামে করে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সব সদস্যকে দেয়া হয়। এ বিষয়ে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এক মন্ত্রী বলেন, সাংসদদের নিয়ে কথা বলার প্রেক্ষিতে উনি (ইনু) বিবৃতি দিয়ে আগেই দুঃখপ্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ওই বিবৃতির কপি সবাইকে দেয়া হয়েছে। এসব নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থিত মন্ত্রিসভার অপর এক সদস্য বলেন, মন্ত্রিসভার নিয়মিত এজেন্ডাভুক্ত আলোচনা শেষ হলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছি। আপনি আমাকে প্রতিমন্ত্রীও করেছেন। আমি জীবনে কোনদিন টিআর-কাবিখা থেকে এক ছটাক গম বা চাল নিয়ে খাইনি। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন আমি এক ছটাক চালও খেয়েছি, তা হলে আমি সংসদ সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেব বলে চ্যালেঞ্জ করছি। আপনার সামনে তথ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এ সময় তথ্যমন্ত্রী নিজেই দুঃখ প্রকাশ করেন এবং লেখা বিবৃতিটি পড়ে শোনান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তীর ছেড়ে দিলে এবং মুখের কথা বেরিয়ে গেলে ফিরে আসে না। পরে প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বলেন, এভাবে সবাইকে চোর বানানো ঠিক হয়নি। ওই কথা বলে তিনি (ইনু) সবাইকে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এ সময় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী শ্রম প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, ‘আমি ওইভাবে বলিনি’Ñ এমন বলার সুযোগ নেই। কারণ সংবাদমাধ্যম বক্তব্যের রেকর্ড দেখালে তখন আর বলার কিছু থাকবে না। সহকর্মীদের তোপের মুখে পড়ে তথ্যমন্ত্রী পরে আর কোন কথা বলেননি বলে বৈঠকে উপস্থিত আরেকজন মন্ত্রী জানান। এদিকে গুলশান-বনানীসহ রাজধানীর সকল আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ হোটেল, রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করার জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তালিকা তৈরি করে যারা বৈধ কাগজ দেখাতে পারবে না, তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। এতে কোন ছাড় দেয়া চলবে না। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পাঁচ দশমিক ৯৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। সচিবালয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এপ্রিল থেকে জুন মাসে মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১১টি মন্ত্রিসভা বৈঠকে ৯২টি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৬৫টি বাস্তবায়িত হয়েছে, বাস্তবায়নের হার ৭০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত বছরের এ সময়ে ১৩টি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৬৮টি সিদ্ধান্ত হয়েছিল জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, এর মধ্যে ৪৪টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়, বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পাঁচ দশমিক ৯৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। গত বছরের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নাধীন থাকলেও এবার একই সময়ে তার পরিমাণ ২৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, এ বছরের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত নয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই এবং ২০টি আইন সংসদে পাস হয়েছে। গত বছরের এ সময়ে নয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হলেও সংসদে পাস হয় তিনটি আইন। শিপিং কর্পোরেশন আইনের খসড়া অনুমোদন মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন আইন-২০১৬ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ১৯৭০ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের আলোকে শিপিং কর্পোরেশন চলছিল। সামরিক শাসনের সময় ওই অধ্যাদেশের বেশ কয়েকটি সংশোধনী হয়। সামরিক শাসনামলের আইনগুলোকে নতুন করে প্রণয়নে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকায় ওই আইনটিকে বাংলায় করা হচ্ছে। মূল আইনের বড় পরিবর্তন করা হচ্ছে না, অল্প কিছু সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে।
×