ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাঁচ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে ॥ এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি কোন কোন এলাকায়

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি- বাড়ছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৬ জুলাই ২০১৬

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি- বাড়ছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ সোমবার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট ও মধুমতির পানি রবিবারের চেয়ে আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যাকবলিত জেলার সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে ১৪ তে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বন্যার্তের সংখ্যাও। এখনও কোন কোন এলাকায় ত্রাণ না পৌঁছানোর খবর পাওয়া গেছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সঙ্কট বেড়ে চলেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে জমির ফসল। ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্য মোকাবেলা করছে কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা। সরকারী হিসাবে জেলার নয় উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এতে একটি ফেরিঘাট বিনষ্ট হওয়ায় যানবাহন পারাপারে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে। এদিকে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখানকার কোন কোন এলাকায় এখনও ত্রাণ না পৌঁছানোর অভিযোগ রয়েছে। এদিকে সুনামগঞ্জে সুরমা, খসিয়ামারা, পিয়াইন, জাদুকাটা নদীর পানি বেড়েছে। সুনামগঞ্জ-হালুরঘাট সড়কের নবীনগর এলাকায় রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় দুই লাখ মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলো হচ্ছে পঞ্চগড়, নওগাঁ, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, লালমনিরহাট, ফরিদপুর, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের। কুড়িগ্রাম ॥ গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করছে কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে ঘর-বাড়ি, স্কুল, প্রতিষ্ঠান। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাকা ও কাঁচা সড়ক ডুবে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। সোমবার সকাল থেকে ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৯ সে.মি ও ধরলার নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সরকারী হিসেবে ৯টি উপজেলার ৫৩টি ইউনিয়নের ৬৩ হাজার পরিবারের ৫শত গ্রামের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কিন্তু স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান জানান, ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রে ৮, ধরলায় ২৫, তিস্তায় ৫ ও দুধকুমারে ১৬ সেন্টমিটার পানি বেড়েছে। যাত্রাপুর বাজারের নিকট বাঁধের ১৫০মিটার ভেঙ্গে যাওয়ায় পানির তোড়ে ১৫টি বাড়ি ভেসে গেছে। চর যাত্রাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন ভাঙ্গনের মুখে। তিনি আরও জানান, ২০০৭ সালের পর কোন বন্যায় পানি এত উচ্চতায় ওঠেনি। এবারের বন্যায় ২২ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। তবে দ্রুত তা মেরামতের চেষ্টা চলছে। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কে দু’দিন ধরে গরু ও পণ্যবাহী ট্রাকসহ সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রবল স্রোতের টানে ভেসে গেছে অন্তত অর্ধশত ঘর-বাড়ি। রাস্তা, গুচ্ছগ্রাম ও বাঁধে আশ্রিতদের সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও পয় নিষ্কাশন সংকটের পাশাপাশি বেড়েছে পশুখাদ্যের সঙ্কট। কৃষি বিভাগের হিসাবে, ১৮ হাজার কৃষকের এক হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ত্রাণ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল মোত্তালিব মোল্লা জানান, সরকারী হিসাবে ৫৩টি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৬২ হাজার ৮৪২টি। এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৮টি। ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১টি। সিভিল সার্জন ডাঃ জয়নাল আবেদীন জিল্লুর দাবি করেছেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওর স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে। রাজশাহী ॥ উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং অব্যাহত বৃষ্টিপাতের ফলে বেড়েছে পদ্মার পানি। ফলে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায়। এছাড়া রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ না হতেই দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। বালির বস্তা ফেলে তা ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ভাঙ্গন আতঙ্ক রয়েছে নগরীর পশ্চিমাংশ থেকে পবার সোনাইকান্দি এলাকাতেও। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহিদুল ইসলাম জানান, সোমবার বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মায় প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ১৬ দশমিক ৯৫ মিটার। এর আগে ২৩ জুলাই ১৬ দশমিক ৮৮ মিটার রেকর্ড করা হয়। বাঘা উপজেলার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের গোকুলপুর, কিশোরপুর, আলাইপুর ও মনিগ্রাম ইউনিয়নের হরিরামপুর এবং নবগঠিত চকরাজাপুর ইউনিয়নের চর কালিদাস খালি, দিয়ার কাদিরপুর, চৌমাদিয়া, লক্ষীনগর এবং আতারপাড়া এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিনে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে প্রায় ৩ শতাধিক একর ফসলী জমি। ভাঙ্গন আতঙ্কে এখন রয়েছে এসব এলাকার কয়েক হাজার পরিবার। চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আলম জানান, ভাঙ্গন আতঙ্কে অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারছেন না। বাঘা উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শফিউর রহমান শফি বলেন, দুর্গতদের জন্য এখনো কোন ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছেন। রাজবাড়ী ॥ গোয়ালন্দের কাছে দৌলতদিয়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৭ সেন্টি মিটার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। দৌলতদিয়া বিআইডব্লিউটিসি ফেরী ঘাটের তত্ত্বাবধায়ক জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে নদীতে প্রবল স্রোতের কারণে ফেরি চলাচলে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে সময় অনেক বেশি লাগছে। পন্টুন বিনষ্টের কারণে ৩ নম্বর ফেরিঘাটটি সাময়িক বন্ধ রয়েছে। পদ্মায় পানি বৃদ্ধি এবং তীব্র স্রোতের নতুন করে রাজবাড়ীর বরাট ইউনিয়নে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। পঞ্চগড় ॥ অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই হাজার পরিবারের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। পৌর এলাকার নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় এক হাজার পরিবার বাড়িঘর ফেলে আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান নিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ তাদের মাঝে কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করলেও জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের কোন ত্রাণ এখনও বিতরণ করা হয়নি। পৌর মেয়র জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষদের মাঝে যারা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। পৌর এলাকার ৮০৫টি পরিবার পানিবন্দী হয়েছে মর্মে তালিকা দিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে ত্রাণ সহায়তার জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেখান থেকে ত্রাণ সহায়তা পেলে বন্যার্ত মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হবে। এদিকে তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী মহানন্দা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সোমবার সকাল থেকে পানি কমতে থাকায় বিকেল থেকে মানুষ তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করা হয়। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সোমবারও তাদের শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। নওগাঁ ॥ কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিপাত ও উত্তরের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানির প্রবল চাপে সোমবার আত্রাই নদীর পাঁচুপুর ইউনিয়নের শিকারপুর নামক স্থানে পাকা সড়ক ভেঙ্গে যায়। এতে ওই এলাকার শিকারপুর, মালিপুকুর, জগদাস, বিপ্রবোয়ালিয়া, বৈঠাখালি, নবাবের তাম্বু, খঞ্জরসহ প্রায় ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে ২০ হাজার মানুষ। আত্রাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাউছার রহমান জানান, ভারি বৃষ্টিপাত ও পাকা সড়ক ভেঙ্গে ওই এলাকার প্রায় ১ হাজার সদ্য লাগানো রোপা ধান, ধানের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত আক্রান্ত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মকলেছুর রহমান জানান, ২/১ দিনের মধ্যে ভাঙ্গনস্থল মেরামত করা সম্ভব হবে। নীলফামারী ॥ ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলের কারণে সোমবার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখেও পানির তোড় সামলাতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। টানা ১৫ দিনের বন্যা ও ভাঙ্গনে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার তিস্তা নদী অববাহিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটে চলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সব কিছু হারিয়ে এখন ছিন্নমূলে পরিণত হয়ে তিস্তার বিভিন্ন বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। নীলফামারী জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন জানান, গত কয়েকদিনের বন্যা ও ভাঙ্গনে সোমবার পর্যন্ত ডিমলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন ও জলঢাকা উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম বন্যা ও ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স¤পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে তিন শ’ ৮৮টি ঘড়বাড়ি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ হাজার দুইশ’ ৪৬টি ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ১৪ হাজার দুইশ’ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চারটি। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে শুকনো খাবার, ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনার পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ৫ উপজেলার ২৫ ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। কাজিপুর থেকে চৌহালী পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ৫ সহস্রাধিক ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। ঘরবাড়ী ছেড়ে অনেক পরিবার বাঁধে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। দুর্গম চরাঞ্চলের পরিস্থিতিও নাজুক হয়ে পড়েছে। কাজিপুর উপজেলার বৃহৎ ঢেকুরিয়া হাট বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সিরাজগঞ্জ সদর ও কাজিপুর উপজেলার শুভগাছা, রতনকান্দি,মেঘাই অঞ্চলের হাটবাজার পানিতে ডুবে গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও হাইস্কুলে বন্যার পানি প্রবেশ করার শিক্ষাক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ৫টি উপজেলায় ৬৫ মেট্রিকটন চাল ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। জামালপুর ॥ অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে জেলায় পুরাতন ব্রহ্মহ্মপুত্র নদ ও যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রবিবার রাতে পানির তীব্র স্রোতে ভেঙ্গে গেছে ইসলামপুর উপজেলার নেয়ারপাড়া-রামভদ্রা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি অংশ। এতে নোয়ারপাড়া ও মাহমুদপুর ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন ইসলামপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার আংশিক, মেলান্দহ উপজেলার ২টি ইউনিয়ন মাহমুদপুর ও শ্যামপুর, মাদারগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন এবং সরিষাবাড়ী উপজেলার ২টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ ও হাজার হাজার গবাদিপশু এখন পানিবন্দী। দুর্গত প্রতিটি গ্রামে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। কাঁচা তরিতরকারি, শাকসবজি, অসংখ্য বীজতলা, উঠতি আখ ও পাট ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। গাইবান্ধা ॥ জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ঘাঘট নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৪২ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৫ সে. মি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৪০ সে.মি. বেড়ে ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদ সীমার ১৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দু’সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী থাকা জেলার ২ লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভোগে চরম আকার ধারণ করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য সঙ্কট, গবাদি পশু সংরক্ষণ ও পশুখাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সাঘাটা উপজেলার ঘুড়িদহ ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে চিনিরপটল, পবনতাইড়সহ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৬ হাজার মানুষ নতুন করে পানিবন্দী হয়েছে। ঘাঘট নদীর গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের গোদারহাট, কুঠিপাড়া পয়েন্টে কিছু অংশ ধসে যাওয়ায় বাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। তা রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ৫০ মে. টন চাল, নগদ ৪ লাখ টাকার শুকনো খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি অনুসারে সরকারী ত্রাণ সামগ্রী অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার অধিকাংশ মানুষ এখনও ত্রাণ থেকে বঞ্চিত। বগুড়া ॥ উজান থেকে আসা ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বগুড়ার যমুনা তীরবর্তী ৩ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। সোমবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হয়। এ পর্যন্ত ৭৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাকবলিত এলাকা থেকে অনেক লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী সারিয়াকান্দি, সোনাতালা ও ধুনট উপজেলার মোট ১৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি প্রবেশ করেছে ১০৭টি গ্রামে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে এ পর্যন্ত ১৩৫ মে. টন চাল ও ৫০ হাজার নগদ টাকাসহ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। লালমনিরহাট ॥ লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৫ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে, গৃহহীন মানুষ বাঁধের রাস্তায় ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় তিস্তা নদী বিপদসীমার ১ সে.মি. ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৩শ’ বিঘা ফসলের জমি ও প্রায় একশ’ ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বানভাসি মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নদীর কূলবর্তী মানুষের চেয়ে চর ও দ্বীপ চরে আশ্রয় নেয়া মানুষের দুর্ভোগ বেশি। সেখানে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাচ্ছে না। লালমনিরহাট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, সরকারী সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে নদীতে পানি থাকায় দুর্গমাঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফরিদপুর ॥ পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ফরিদপুর সদরের ডিক্রিরচর ও নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের শতাধিক বাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। এছাড়া প্রায় পাঁচশ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এছাড়া নর্থ চ্যানেল এলাকার দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চরভদ্রাসন উপজেলার সদর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল আর টানা বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সোমবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি ‘ষেলঘর পয়েন্টে’ বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদী তীরবর্তী এলাকার পাশাপাশি হাওর এলাকাতেও গত তিনদিন ধরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মার পানি সোমবার বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নিম্নাঞ্চলের নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় মাওয়ায় ১১ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে এখন বিপদসীমার মাত্র ১ সেন্টিমিটার নিচে দিয়ে বইছে। নড়াইল ॥ জেলার মধুমতি নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কালনাঘাটের দুটি গ্যাংওয়ে তলিয়ে যাওয়ায় যাত্রী, যানবাহন ও পণ্য পারাপারে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
×