ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ শামসুর রহমান

ফিরতে হবে ’৭১-এর চেতনায় ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৬ জুলাই ২০১৬

ফিরতে হবে ’৭১-এর চেতনায় ॥ অভিমত

স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে লক্ষ্য করা গেছে বাঙালী যখনই কোন ধরনের সঙ্কটে পতিত হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য দ্বারস্থ হয়েছে ’৫২-এর চেতনার কাছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের মাধ্যমে যে চেতনার বীজ ’৫২-তে রোপিত হয়েছিল সেটিই পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে মুক্তিকামী বাঙালীকে প্রেরণা দিয়েছে। দিয়েছে দিকনির্দেশনা। চেতনার শিকড়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণে ঔপনিবেশিক পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর কোন ষড়যন্ত্রই বাঙালীদের রুখতে পারেনি। এই চেতনার পুঞ্জীভূত ঐক্যই পরবর্তী সময়ে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক আহ্বানে সাড়া দেয়ার পেছনে মূলত ’৫২ই ছিল চেতনার প্রধান অস্ত্র, যা প্রেরণা হিসেবে শক্তি যুগিয়েছে। এই চেতনার প্রতি অবিচল আস্থা বাঙালীদের মাঝে কোন শক্তিই অনৈক্যের দেয়াল সৃষ্টি করতে পারেনি। স্বাধীনতার স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বার বার এ জাতিকে মহাসঙ্কটে পড়তে হয়েছে ও হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেন? এই প্রশ্নের উত্তর স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্ধদশকে স্বাধীনতাবিরোধীদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে বিচ্যুতির অপপ্রয়াস থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে। তাই জাতির এই সঙ্কটকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দ্বারস্থ হওয়া ব্যতীত বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে এই চেতনাকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যে বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী গ্রহণ করেছিল, আজকের বিভাজিত সমাজ-রাষ্ট্রে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতি, লুটপাটের মূল অনুষঙ্গগুলো তখনই গ্রোথিত হয়েছে। সামগ্রিক বাস্তবতায় স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ’৫২-এর চেতনা যেভাবে বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে সংগ্রাম-আন্দোলনে তেমনি আজকের বাংলাদেশের সব সঙ্কট উত্তরণের জন্য ’৫২-এর মতো ’৭১-এর চেতনায় জাতিকে ফিরে যেতে হবে। এই কাজটি করতে পারলেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্ট সব হতাশা-বিভেদ দূর হবে। ’৭১-এর চেতনাকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে নতুনভাবে যে স্বপ্ন জাগিয়েছে, সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। জাতি আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছেÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতোমধ্যে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। এই ঐক্যের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে তার নির্দেশে দেশের প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলায় সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠিত হচ্ছে। সমগ্র জাতি প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে ’৭১-এর চেতনাকে সামনে রেখে জাতির এই ঐক্যকে কাজে লাগাতে পারলে শুধু সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ নয়, সব অশুভ শক্তির উত্থান প্রতিহত করা সম্ভব। এ লক্ষ্যেÑ ক. সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ কমিটির কর্মপরিধি বিস্তৃত করে ‘সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ করা প্রয়োজন; খ. প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নানাভাবে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে উস্কে দিচ্ছে। তাই জাতীয় পর্যায়ে সৎ, নিষ্ঠাবান, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি একান্ত অনুগত দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সার্চ কমিটি করে সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যাহার বা ওএসডি করা; গ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও অর্জিত সাফল্য ধরে রাখার জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের প্রতি শতভাগ আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়োগের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা সৃষ্টি ও জবাবদিহির আওতায় আনা। গুলশান ও শোলাকিয়া ট্র্যাজেডিতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উপ-উপাচার্যের প্রত্যক্ষ মদদ এ বিষয়টি জাতির সামনে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তাই সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারিসহ এ ধরনের চক্রান্তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত শিক্ষকদের অবিলম্বে চাকরি থেকে বহিষ্কারসহ বিচারের আওতায় আনা। এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর, সব বোর্র্ডের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠন করা; ঘ. সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সব মসজিদে ইসলামের আলোকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা চালানোর বিষয়ে ইমামদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে; ঙ. প্রত্যেক সংস্থায় সর্বস্তরের জনবল নিয়ে সংস্থাপ্রধানের নেতৃত্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিষয়ে আলোচনার আয়োজনসহ সংস্থার ভেতরে জঙ্গী তৎপরতার অনুসন্ধানে কমিটি গঠন ও তদারকি জোরদার করা; চ. মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তানদের যাতে অপশক্তি ব্রেইনওয়াশ না করতে পারে, সেজন্য পাড়া-মহল্লায় সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ও খেলাধুলাসহ বিনোদন কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেয়া; ছ. অভিভাবক-দেশবাসীকে সচেতন ও সতর্ক করার জন্য জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত বক্তব্য প্রচার করা; জ. দেশপ্রেমে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের শুরু বা শেষে যৌথভাবে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবনে নেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে ও বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা নিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত দাঁড় করার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। মেধাবী তরুণ সমাজকে মূল স্রোতে ধরে রাখার জন্য সমাজ-রাষ্ট্রের বিদ্যমান আত্মকেন্দ্রিকতার রাশ টেনে ধরতে হবে। সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষাকে মানব উৎকর্ষ সাধনের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে এমন হাজারো ইতিবাচক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে তরুণ সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশার মেঘ কেটে যাবে। সর্বোপরি জয় হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। পরাজিত হবে অপরাজনীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সব ষড়যন্ত্র। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি
×