ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আব্দুল মালেক

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ডোনাল্ড ট্রাম্প পারবেন কি বৈতরণী পার হতে?

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৬ জুলাই ২০১৬

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন  ডোনাল্ড ট্রাম্প পারবেন কি বৈতরণী পার হতে?

নিউইয়র্কের অভিজাত এক ক্লাবে ঢোকার মুহূর্তে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ সেই তরুণটিকে একদিন। কারণ সেখানে প্রবেশাধিকার পাবার মতো সামাজিক কৌলিন্যের বিশেষ তকমাটি ওই তরুণের তখন ছিল না। অপমানিত হয়ে ক্লাবের দোরগোড়া থেকে সেদিন তাকে ফিরতে হয়েছিল বটে কিন্তু সেটা ছিল না মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো। বরং সেদিন তার অপমানিত অন্তর আবদ্ধ হয়েছিল মাথা উঁচু করা এক কঠিন প্রতিজ্ঞায়। সমাজে এমন মর্যাদা তাকে অর্জন করতেই হবে যাতে একদিন এই বন্ধ দরজার কপাট তার জন্য খুলে দেয়া হয় সসম্মানে। অনড় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সেই যুবক এরপরই একটা জেদ নিয়ে মনোনিবেশ করতে শুরু করলেন পিতার রিয়াল স্টেটের ব্যবসায়। ফল হিসেবে একজন অন্যতম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা নয়, তীক্ষè মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের এই ব্যক্তি দেশের অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তি হিসেবে উত্থান ঘটালেন নিজের। ঐতিহাসিক কর্মপ্রয়াস হিসেবে তিনি বদলে দিলেন আমেরিকার বাণিজ্যিক রাজধানী নিউইয়র্ক নগরের স্কাইলাইন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় ডোনাল্ড ধন অর্জনেই মত্ত থেকেছেন। সেই সময় তিনি কোন রাজনৈতিক পদে নির্বাচন তো দূরের কথা এর প্রবেশ পথে দাঁড়ানোর চিন্তাও করেননি বোধ হয়। কারণ উভয় দলের তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদদের হাতে তিনি বরাবর তুলে দিয়েছেন দল চালানো ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ। কিন্তু ৯০ দশকের পর থেকে ট্রাম্পকে হঠাৎ করে রাজনীতিতে যোগ না দিয়েও অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে মাঝে মাঝে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা গেল। আবার দেখা গেল সময়মতো সরে যেতেও। মানুষ ধারণা করেছিল এটা বিত্ত আর বৈভবে ভরপুর এক ধনকুবেরের সখ পূরণ বৈ আর কিছু নয়। কে জানত ২০১৬ সালে নির্বাচনী ধারায় এমন বিস্ময়কর পথ পরিক্রমায় গ্রান্ড ওল্ড পার্টি তথা রিপাবলিকান দলের আকাশে পরিবৃত সকল উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো ম্লান করে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সেই ধনপতি উদিত হবেন সূর্যের আলো নিয়ে। আর আমেরিকার সর্বোচ্চ পদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনের জন্য দেশের সর্ব প্রাচীন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেয়ে যাবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী নবেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন সিনেটর, গবর্নর বা কংগ্রেসম্যান ইত্যাদি পদাধিকারী ১৭ ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ট্রাম্প একদিকে বহিরাগত অন্যদিকে প্রাইমারির শুরু থেকে তার নানা বিতর্কিত মন্তব্য যেমন, ল্যাটিনোদের ধর্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করা, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ, অবৈধ ইমিগ্রান্টদের বহিষ্কার, নারীদের নিয়ে কটু মন্তব্য পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বকে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। একপর্যায়ে পার্টির পক্ষ থেকে বলাও হয়, ট্রাম্পের ওইসব বিতর্কিত বক্তব্য তার নিজস্ব। বিশেষ করে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ ও মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার নীতি দলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পার্টির চেয়ারম্যান প্রিভিসি কখনও কখনও কিছুটা নমনীয় মনোভাব প্রকাশ করলেও কংগ্রেসের স্পিকার পল রায়ান তাকে সমর্থন না করার ব্যাপারে ছিলেন অনড়। ধারণা করা হয়, দলের ৩০ শতাংশের বেশি কর্মী-সমর্থক পলের অনুসারী। এসব কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প কাক্সিক্ষত ম্যাজিক নম্বর পাবেন কিনা সেটা নিয়ে সর্বমহলে সংশয় ছিল। কন্টেস্টেড কনভেনশনের সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে প্রচুর। এমনকি অভিজ্ঞজনেরা এক রক্তারক্তির সম্ভাবনার আশঙ্কা করেছিলেন কনভেনশন স্থানে। তাই ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির নমিনেশন লাভ করাটি ছিল না ভিনি ভিডি ভিসি- বাংলায় যাকে বলে এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম। এর আগে আমেরিকান নির্বাচন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলাম তার সামনের এগোবার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তেরো মাস আগে গত বছরের ১৬ জুন তিনি যখন প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণা দেন তখন থেকেই পার্টির অভ্যন্তরে যে বিরোধিতার শুরু সেটি ক্লিভল্যান্ডের কনভেনশন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই রিপাবলিকান পার্টির ওয়াশিংটন নেতৃত্বের আশীর্বাদপুষ্ট প্রেসিডেন্সিয়াল প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত তো হননি সে কথা বরাবরই ওপেন সিক্রেট। নেতৃত্বের উচ্চপর্যায়ের মানুষজন প্রায় সকলে আগাগোড়াই ছিলেন ট্রাম্পবিরোধী। কিন্তু পার্টি নেতৃত্বের নিরঙ্কুশ সমর্থন না পেয়েও কেবল জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে আরোহণ করা যায় চূড়ায় সেটাই এবার সবাইকে উপলব্ধি করতে হলো। দলীয় প্রাইমারিতে তৃণমূল রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে ১৪ মিলিয়ন ভোটের যে বিপুল সমর্থন ট্রাম্প পেলেন সেটি রিপাবলিকান দলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট। চার বছর আগে প্রাইমারিতে প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে এই সংখ্যা ৬০ পার্সেন্ট বেশি। তাছাড়া রিপাবলিকান দলের মোট ডেলিগেটস সংখ্যা যেখানে ২ হাজার ৪৭২ এবং মনোনয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল যে ১ হাজার ২৩৭ ম্যাজিক সংখ্যা সেখানেও ট্রাম্প সহজভাবে অর্জন করেছেন ১ হাজার ৫৪৩ ডেলিগেটস। এ কথা বলতেই হবে গত ১৮ থেকে ২১ জুলাই চার দিনের এই কনভেনশন ছিল চমক আর হাই ড্রামায় ভরা। প্রথম দিন ট্রাম্পকে নমিনেশন না দেয়ার জন্য তার বিরোধী ডেলিগেটসদের পক্ষ থেকে ফ্লোরে প্রস্তাব ওঠে। তখন পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা, হৈচৈ ও চিৎকারের মধ্যে ভোটাভুটি করে বিরোধিতাকারীরা পরাস্ত হয়। অন্যদিকে সম্মেলনের অদূরে চলছিল শত নগ্ন নারীর ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ। এই গ-গোলের সুবাদে প্রাইমারিতে হেরে যাওয়া সিনেটর টেড ক্রুজ কনভেনশনে তার মুখ বন্ধ রাখতে পারেননি। ভাষণে ট্রাম্পকে সমর্থন না দিয়ে ডেলিগেটদের প্রতি আহ্বান জানালেন বিচার বিবেচনা করে উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার। কিন্তু তার এমন এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সেসময় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে তার স্ত্রীকে নিরাপত্তার জন্য অতি দ্রুত কনভেনশন সেন্টার থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশেষে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে (আরএনসি) হাজার হাজার ডেলিগেটের হর্ষ উৎফুল্ল­ধ্বনির ভেতর গত ২১ জুলাই রাতে বিজয়ীর বেশে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন গ্রহণের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনা করলেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। যার শেষ ভাল তার সব ভাল কথাটাই এখানে প্রযোজ্য। ৭৫ মিনিটের ভাষণে ট্রাম্প আমেরিকাকে কিভাবে আবার সর্বোচ্চ অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন ঘোষণা করলেন তার রূপরেখা। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা, কর্মসংস্থান, ইমিগ্রেশন, ট্রেড, জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ ইস্যুসহ নানা বিষয়ে তার কর্মসূচীর কথা জানালেন। একই সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল স্ক্যান্ডাল, লিবিয়ার বেনগাজি হত্যা নিয়ে কথা বললেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কঠোর সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন হিলারি একজন অবিশ্বাসযোগ্য রাজনীতিক এবং তার অদূরদর্শী নীতির কারণে আজ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সৃষ্টি হয়েছে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ও আইসিসের উত্থান। যার ফলে দেখা দিচ্ছে আমেরিকার নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা। এই বক্তব্যের সময়ে ডেলিগেটদের মধ্য থেকে ‘লক আপ হার- লক আপ হার’ বলে সেøাগান উঠলে মনোনয়ন গ্রহণকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, আগামী নবেম্বরের নির্বাচনে তাকে আমাদের পরাস্ত করতে হবে প্রথম। অতীতে দেখা গেছে ঐতিহ্যবাহী রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশনে দলের বর্তমান ও সাবেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বরা যোগ দিয়ে তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর গুণাবলী বর্ণনা করে একজন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতেন। শুধু তাই নয়, কনভেশনের পরপরই নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে চাঙ্গা করে তুলতেন দলকে। কিন্তু এবারে রিপাবলিকান দলে ঘটল একেবারে বিপরীত ঘটনা। কনভেনশনে তারকা নেতাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অনুপস্থিতির তালিকাতেই সহজে বোঝা যায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এখনও পার্টির নেতৃত্ব কতটা ক্ষুব্ধ। অনুপস্থিত থেকেছেন দল থেকে নির্বাচিত সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট সিনিয়র ও জুনিয়র বুশ এবং এবারে মনোনয়নপ্রত্যাশী এই পরিবারের আরেকজন বুশ ফ্লোরিডার গবর্নর জেব। আরও আসেননি ২০০৮ সালে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ম্যাক কেইনসহ ১৯ সিনেটর এবং ২০১২ সালের দলের মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সাবেক গবর্নর মিট রমনি। দেখা যায়নি ট্রাম্প সমর্থক সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী গবর্নর সারা পেলেনকেও। পার্টির এসব ক্ষুব্ধ নেতার দল যেমন গরহাজির ছিলেন কনভেনশনে তেমনি উপস্থিতরাও ট্রাম্পের পক্ষে কথা বলতে যেন বসেছিলেন মুখে কুলুপ এঁটে। তবে উপস্থিতদের মধ্যে তার পক্ষে সরব ছিলেন সাবেক স্পীকার নিউট গিংরিচ, নিউজার্সির গবর্নর ক্রিস্ট কৃষ্টি ও নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি। নানা সূত্রে প্রকাশ, কনভেনশনের একমাস আগে থেকে পার্টির পক্ষ থেকে ৫০ জন খ্যাতনামা রিপাবলিকান গবর্নর, সিনেটর ও হাউস মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল কনভেনশনে বক্তৃতা দেবার ব্যাপারে। কিন্তু তারা গড়িমসি করে জানিয়েছিলেন, ক্লিভল্যান্ড অবধি তাদের যাওয়া হবে কিনা সে বিষয়েই তাদের সংশয় আছে। কিন্তু এতেও তৃণমূল সমর্থকদের কিছুই যায় আসেনি। ট্রাম্পের বর্তমান স্ত্রী মেলোনিয়ার বক্তৃতা ফার্স্ট লেডি মিশেলের এক বক্তৃতার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় জন্ম দিয়েছিল কৌতুক ও সমালোচনা, সেটাও তারা গায়ে মাখতে নারাজ। কারণ পিতা ট্রাম্পের পেছনে দৃঢ় পায়ে দাঁড়ানো কন্যা ইভাঙ্কা, পুত্র ডোনাল্ড জুনিয়র ও এরিক ট্রাম্পসহ সমগ্র পরিবার বক্তৃতা ও এন্ডোর্সমেন্টের মাধ্যমে কনভেনশনে সমাবিষ্ট জনচিত্তকে ভরিয়ে দিয়েছেন চমৎকারিত্বে। গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিয়ানা রাজ্যের গবর্নর রক্ষণশীল মাইক পেন্সকে ডোনাল্ড ট্রাম্প রানিংমেট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছেন। দলের কট্টরপন্থীদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্য হিসেবেই তিনি হয়েছেন এমন পছন্দের পাত্র। ইতোপূর্বে মাইক আট বছর দায়িত্ব পালন করেছেন কংগ্রেসম্যান হিসেবে। কোন কোন রাজনৈতিক প-িত অবশ্য মতাদর্শের বৈপরীত্যের কারণে ট্রাম্প-পেন্স জুটিকে অসম জুটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কনভেনশনের পরে বিভক্ত রিপাবলিকান দল ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে কতটা ঐক্যবদ্ধ হতে যাচ্ছে তা বলা মুশকিল। এ রকম একটি দল নিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে তিনি কতটা সাফল্য দেখাতে পারবেন তা সময় বলে দেবে। লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক
×