ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন

কুড়িগ্রামে পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই, বন্যার্তদের দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ জুলাই ২০১৬

কুড়িগ্রামে পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই, বন্যার্তদের দুর্ভোগ চরমে

রাজু মোস্তাফিজ, উলিপুরের হাতিয়ার বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এসে ॥ দুপুর পৌনে ১২টা। মাঝিপাড়ার পাচানী (৬০) স্বামী মৃত লাড্ডু, ভাটিগ্রামের খলিলুর (৫২) পিতা নদশেখসহ কয়েকশ’ বন্যাকবলিত মানুষ উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে চরম দুর্ভোগে পড়ে একটু ত্রাণের আশায় এক প্রকার উপোস থেকে চেয়ারম্যানের কাছে ছুটে এসেছেন। চেয়ারম্যান আবুল হোসেন এত মানুষ দেখে অসহায় হয়ে পড়েছেন। কিভাবে সামান্য এই ত্রাণ এত মানুষের মাঝে বিতরণ করবেন জানেন না। তিনি জানান, তার ইউনিয়নে ৮ হাজার ৫শ’ পরিবারের মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। চরম খাদ্য এবং পানির কষ্টে পড়েছে বন্যাকবলিত এ সব মানুষ। কারও কারও ঘরে যেসব চাল মজুদ ছিল তাও শেষ হওয়ার পথে। এমন অবস্থা রান্না করার জায়গা কোথাও নেই। সারাদিনে একবেলা রান্না করে কোন রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দিন যত যাচ্ছে বন্যাকবলিত এসব মানুষের খাবার দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। পানিতে থাকতে থাকতে তারা এখন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ ইউনিয়নে চলতি বন্যায় মাত্র ৪ টন চাল বরাদ্দ মিলেছে। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা কিভাবে বন্যার্ত মানুষের মাঝে এত অল্প পরিমাণ চাল বিতরণ করবেন জানেন না। তারপরও বন্যার্তদের একটি তালিকা করেছেন। সামান্য করে হলেও বন্যাকবলিত কিছু মানুষের মাঝে রবিবার বিকেলে চাল বিতরণ করে দেবেন। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কুড়িগ্রাম জেলার একটি উপজেলা উলিপুর। এটি কুড়িগ্রাম শহর থেকে ২২ কিমি দূরে অবস্থিত। ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলের পানিতে তলিয়ে রয়েছে। যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। হাতিয়া ইউনিয়নের মোট লোকসংখ্যা ৩৮ হাজার। এখানকার চরগুজিমারী, নয়াপাড়া, কামারটারী নীলকণ্ঠ, রামখানা, চরদাগরকুঠি, চরঅনন্তপুর, চরগাবুরজান, শ্যামপুর, ভাটিগ্রাম, রামরামপুর, দিগলহাইলা, তাজিপাড়া, বালারচর, মিয়াজীপাড়া, কারিপাড়া গ্রামগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে ৭ দিন ধরে। এখানকার গ্রামীণ সড়ক, কালভার্ট, ধানক্ষেত সব কিছুই পানির নিচে ডুবে আছে। একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা আর ভেলা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ যে কি সীমায় পড়েছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না। শহরের মানুষ অনুভব করতে পারবে না, কি কষ্টের মধ্যে আছে এসব এলাকার মানুষ। বিরাট এক জনগোষ্ঠী শুকিয়ে যাচ্ছে কঙ্কালের মতো। পেটে-পিঠে এক হয়ে যাওয়া মানুষ আহাজারি করছে। এখানকার মানুষ ঘরের চৌকির মাচানের ওপর কর্মহীন জীবন কাটাচ্ছে। এসব মানুষের রান্না করে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তারা চায় শুধু শুকনা খাবার। চরদাগরকুঠি, নয়াদাড়া গ্রামের প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন উঁচু জমিতে এবং বাঁধের ওপর পলিথিন টানিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল স্রোতে ভেঙ্গে গেছে। নদীর তীব্র স্রোতে ওয়াপদাবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় তিন কিমি এলাকা ভেঙ্গে গিয়ে প্রবল স্রোতে পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। চরদাগরকুঠির আবদুল মালেক (৫৫), আবদুল ওহাব (৪০), পরিমল (৩০) ষষ্ঠিবালা (৫২) এরা সবাই বড় গৃহস্থ। তাদের সকলের ৪ থেকে ৫ একর জমি, ঘরবাড়ি, তীব্র স্রোতে কয়েকদিনে বিলীন হয়ে গেছে। এখন তারা নিঃস্ব। বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে আছে। হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন আরও জানান প্রতিদিন বন্যাকবলিত মানুষ সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত তার কাছে ভিড় করছে। তারা শুধু খাবার চায়। তাদের ভয়ে এলাকার মেম্বার ও আমি এক প্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কারণ চাহিদা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ত্রাণ মিলছে না এলাকায়। শ্যামপুর গ্রামের খলিলুর (৩৫), গাবুরজানের রফিকুল ইসলাম, মাঝিপাড়ার পাচানী. গুজিমারী গ্রামের বাদশা (৫৫), আমিনুল (৩৫), আবলু হোসেন (৪০) ও দাগরকুঠি গ্রামের সুখমানি জানান ৭ দিন থেকে তাদের বাড়িতে কোমর পানি। তারা ঘরের মাচানের ওপর বসবাস করছে। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে রান্না করার অবস্থা নেই। আর তাদের ঘরে মজুদ খাবার দ্রত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাদের গ্রামে অনেক পুরুষ ঢাকায় কাজের জন্য গেছে এসব পরিবারের মহিলারা আরও কষ্টে পড়েছে। আর বন্যার কারণে এ অঞ্চলের পুরুষরা কর্মহীন জীবনযাপন করছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র স্রোতে হাতিয়া ইউনিয়নে চরগুজিমারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। দাগরকুঠি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চরগুজিমারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘেচুডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনন্তপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুরো ইউনিয়ন ঘুরে দেখেছি কয়েক হাজার বন্যাকবলিত মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব মানুষের জন্য মাত্র ৪ টন বরাদ্দ এসেছে যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম। এত অল্প ত্রাণে চেয়ারম্যান মেম্বাররা মানুষের ভয়ে এক প্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
×