ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৎস্যমেলা খামারবাড়িতে

হরেক তথ্য, ফরমালিন মুক্ত তাজা মাছ কেনার ধুম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ জুলাই ২০১৬

হরেক তথ্য, ফরমালিন মুক্ত তাজা মাছ কেনার ধুম

মোরসালিন মিজান ॥ শহরে মাছ মানেই ডিপ ফ্রিজে রাখা পলিথিনের ছোট-বড় প্যাকেট। ওসব প্যাকেটে রাখা মাছ প্রাণহীন। জমাটবদ্ধ। মাসের পর মাস অবিকল থাকে। হয়ত তাই মৎস্য মেলায় মাছের সাঁতার কাটার দৃশ্য দেখে যারপর নাই বিস্মিত রাজধানীর মানুষ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো বাবা-মায়ের হাত ছেড়ে মাছের পিছু নিচ্ছে! বড়রা ফরমালিনমুক্ত দেশী মাছ কেনায় ব্যস্ত। এসবের বাইরে, মেলায় মাছ নিয়ে আছে নানা ধরনের গবেষণা। প্রজনন, চাষ পদ্ধতি, জাত উন্নত করণসহ নানা বিষয়ে তথ্য দেয়া হচ্ছে মেলা থেকে। বহুমাত্রিক আয়োজন একবারটি ঘুরে দেখে আসার মতো বৈকি! অনেকেরই জানা, মৎস্য সপ্তাহ চলছে এখন। সারাদেশেই নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর খামার বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় মৎস্য মেলার। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া মেলা এখন জমজমাট। মৎস্য অধিদফতর আয়োজিত মেলায় সরকারী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী উদ্যোক্তারা অংশগ্রহণ করেছেন। ত্রিশটির মতো স্টল। আছে একাধিক প্যাভিলিয়ন। বিগত বছরগুলোতে মেলাটি রমনা পার্কে আয়োজন করা হয়েছে। এবার স্থানান্তরিত করা হয়েছে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের খোলা চত্বরে। ২৬০ প্রজাতির মাছের নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এখানে। মূল রাস্তার পাশে হওয়ায় বেশ চোখে পড়ে আয়োজনটি। চত্বরে প্রবেশ করার আগেই দৃশ্যমান হয় মাছ ভর্তি নদী পুকুর খাল বিলের ছবি। বিশাল আকারের রুই, কাতল, বোয়াল দুই হাতে ধরে রাখা জেলেদের হাসিমুখ দেখে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অতীত মনে পড়ে যায়। মাছের সুদিন তুলে ধরা ছবিগুলো দেখতে দেখতে প্রবেশ করা হয়ে যায় মেলায়। প্রথমেই চোখে পড়ে মৎস্য অধিদফতরের প্যাভিলিয়ন। এখানে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। বাড়ি ঘর পুকুর ধানের জমি জলাশয় সব কৃত্তিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। একটি অংশে ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা। কাঁচ দিয়ে বিশেষভাবে ঘেরা পাত্রে মাছ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে মাছ। তেজগাঁও কলেজের একদল শিক্ষার্থী প্রতিটি মাছ খুঁটিয়ে দেখছিল। তিন বন্ধুর একজন আশীষ। বলল, কৈ, শিং, মাগুর মাছ তো অনেক দেখা হয়েছে। কিন্তু এই মাছগুলো যে এমন সাঁতার জানে, মনেই ছিল না। কিছু নতুন মাছও দেখছি। একটি মাছ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সে বলল, এটার নাম কার্প। প্রথম দেখেছি মাছটা। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টলে কাঁচের চৌবাচ্চা। নানা জাতের মাছ ভেতরে ছোটাছুটি করছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা রাসেল জানান, মাছ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করেন তারা। গবেষণার ফল হিসেবে মহাশোল, টেংরা, গুলশা, কৈসহ বেশ কিছু মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা গেছে। নিয়ন্ত্রিত প্রজনন কৌশলের মাধ্যমে জাত উন্নতকরণের কাজ হয় বলে জানান তিনি। ইউএসএআইডির একটি স্টলে পোনা নিয়ে গবেষণার নানা দিক। মোহাম্মদ জাকির হোসাইন জানান, উন্নত জাতের পোনা উৎপাদনের কাজ করেন তারা। বিভিন্ন জেলার মৎস্য চাষীদের শেখান এই উৎপাদন কৌশল। মেলায় আছে প্রায় ৩০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের উপস্থাপনা। মেরিন ফিসারিজ নামের একটি স্টলে এ ধরনের মাছ কেমিক্যাল দিয়ে বৈয়ামে ভরে রাখা হয়েছে। কাঁচের বৈয়ামগুলো দেখতে অভিনব। এসবে পুরে রাখা মাছের নামগুলোও বিচিত্র। যেমনÑ হাঙর, রাজকাঁকড়া, রূপমান, রঙ্গিলা, তাপসী, সবুজ চেউ, রাঙ্গা চইক্কা, দাড়কুটা, চাশা চিংড়ি, লইট্টা ইত্যাদি। ল্যাব থেকে তুলে আনা মাছ দেখতে ভিড় লেগেছিল দর্শনার্থীদের। আজিজ মার্কেটের ব্যবসায়ী স্বপন মেলায় এসেছিলেন সপরিবারে। নিজের দুই মেয়ে স্বপ্নবেলা, স্নিগ্ধাবেলা মাছের সঙ্গে রীতিমতো খেলাধুলা করছিল। বৈয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে যারপর নাই অবাক তারা। কাছে গিয়ে দেখছিল। মাছের নামগুলো পড়ছিল। কী কী মাছ দেখেছ? কেমন লাগছে? এমন প্রশ্ন বার বার করা হলেও তারা কথা বলায় তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। সব আগ্রহ বৈয়ামে। বাবা স্বপন জানতে চাইলে প্রথম মুখ খুলল। স্বপ্নবেলা চোখে মুখে আনন্দ নিয়ে বলল, অক্টোপাস দেখেছি! তার আগে একটি স্টলে ইলিশ দেখার কথা জানাল স্নিগ্ধাবেলা। দেখার পাশাপাশি মেলায় আছে ফরমালিন মুক্ত তাজা মাছ কেনার দারুণ সুযোগ। মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশনের একটি স্টল থেকে ফরমালিন মুক্ত মাছ বিক্রি করা হচ্ছে। স্টলের কর্মকর্তা তসলিমা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের মাছের মূল উৎস রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক। এছাড়াও নানা জায়গা থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়। গলদা সংগ্রহ করা হয় গোপালগঞ্জ থেকে। সাতক্ষীরা থেকে আসে টেংরা ও বাগদা। রুই আসে সিরাজগঞ্জ থেকে। আড়তদারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মাছ নারায়ণগঞ্জে ফরমালিন টেস্ট শেষে ঢাকায় আসে। সঙ্গত কারণেই এখানে মাছ বিক্রি হচ্ছিল দেদারসে। মাছ চাষ ও বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরীক্ষিত কয়েকজনও মেলায় স্টল সাজিয়েছেন। হাবিব এন্টারপ্রাইজের একটি স্টলে মাছ দেখে চোখ সত্যি ছানাবড়া! অধিকাংশই বিশালাকৃতির মাছ। ১১ কেজি ওজনের একটি মাছ দেখিয়ে বিক্রেতা পলাশ জানান, এটি নদীর কাতল মাছ। সাড়ে ৮ হাজার টাকা দাম। বোয়ালও ১২ কেজি ওজনের। দাম সাড়ে ৮ হাজার টাকা। আরেকটি মাছের নাম কালবাউশ। এর নাকি দারুণ স্বাদ। ৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। হিরামুক্তা বহুমুখী মৎস্য প্রকল্পের স্টলের মেঝেতে কৃত্রিম পুকুর। জলভর্তি পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। দেশীয় পাবদা, গুলশা, টেংরা, শোল, কৈ ইত্যাদি মাছের ছুটাছুটি দেখছিলেন দর্শনার্থীরা। ময়মনসিংহ থেকে আসা স্টল মালিক হজরত আলী সরকার জানান, শতভাগ দেশী মাছ বিক্রি করছেন তিনি। শহুরে মানুষ না খেলে এসব মাছের স্বাদ ঘ্রাণ অনুমান করতে পারবেন না বলেই মনে করেন তিনি। এত কিছুর পর মেলা থেকে মাছ কেনার সুযোগ কেউ আর হাত ছাড়া করতে চান না। প্রতিটি স্টলে ভিড় লেগে ছিল। যাদের টাকা কোন সমস্যা নয়, তারা একাই যেন সব মাছ কিনে ফেলবেন! হেদায়েত উল্লাহ নামের এক ব্যবসায়ী কয়েক মিনিটের মধ্যে ২২ হাজার টাকার মাছ কিনে ফেলেন। এত মাছ দিয়ে কী হবে? জানতে চাইলে তার জবাব, আরে প্রতিদিন যা খাই সেগুলো তো মাছ নয়। এখানে যা কিনছি সবই মাছ। যেটা দেখছি রেখে যেতে মন চাইছে না। নামকরা এক রাজনীতিবিদকেও দেখা গেল ঘুরে ঘুরে মাছ কিনতে। জলে সাঁতার কাটা মাছগুলো থেকে বেছে কিনছিলেন তিনি। বললেন, তাজা মাছের স্বাদ ভুলে গেছি। এখানে তো সব ফ্রেশ মাছ। তাই কিনছি। সপ্তাহব্যাপী কেন্দ্রীয় মৎস্য মেলা আজ সোমবার পর্যন্ত চলবে।
×