ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে জঙ্গী তৎপরতায় ॥ দুদক চেয়ারম্যান

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৫ জুলাই ২০১৬

দুর্নীতির অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে জঙ্গী  তৎপরতায় ॥ দুদক  চেয়ারম্যান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুর্নীতির অর্থই জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যথায় এত অর্থ কোথায় পায় জঙ্গীরা? এমন মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তাই জঙ্গীবাদের মতো ‘অর্থসন্ত্রাসকে’ সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে কেউই এর হাত থেকে রক্ষা পাবেন না। দায়িত্ব পালনের গত চার মাসে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দুদকের ওপর রাজনৈতিক কোন চাপও আসেনি। এছাড়া দুর্নীতি প্রশ্নে রাজনৈতিক কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না কমিশন। দুর্নীতি প্রতিরোধে যা যা করা দরকার দুদক তাই করবে। রবিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ৫ বছর মেয়াদী খসড়া ‘কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ২০১৬-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে দুদক এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, প্রতিবছরই পরিবেশ পরিস্থিতি ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ কৌশলগত এ কর্মপরিকল্পনা রিভাইজ করা হবে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিকে কোনক্রমেই ছাড় দেয়া হবে না। আটটি অগ্রাধিকার ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার উন্নয়ন, কার্যকর তদন্ত ও অনুসন্ধান কার্যক্রম, কার্যকর বিচার প্রক্রিয়ার জন্য দৃঢ় প্রসিকিউশন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা, দুর্নীতি প্রতিরোধে এ্যাডভোকেসি ও শিক্ষা কার্যক্রমে জোর দেয়া, দুর্নীতি প্রতিরোধ উদ্ভাবনী গবেষণা কার্যক্রম চালু, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বাধীনভাবে কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্র জোরদারকরণ ও আইনী কাঠামো দৃঢ়করণ। চেয়ারম্যান বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দমনে কাজ শুরু করব। সভায় চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থই জঙ্গীবাদে ব্যবহৃত হয়। যদি তা না হয় তাহলে এক একটি ব্যাংক হিসাবে এত টাকা কোথা থেকে আসে। সাদা টাকা তো কষ্টের টাকা। এ টাকা তো জঙ্গীবাদে ব্যবহার করা সম্ভব না। তাই এই অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি আমাদের সমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে। তাই এখনই সময় তা বন্ধ করতে হবে। তিনি সমাজে দুর্নীতি প্রতিরোধে মিডিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করেন। মূলত মিডিয়াসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন না হলে জঙ্গীবাদ ও অর্থসন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে না। জঙ্গীবাদের মতো ‘অর্থসন্ত্রাসকে’ সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েই কেবল দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। মূলত দুর্নীতি প্রতিরোধই কমিশনের প্রধান কাজ। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল অবস্থা হলে চলবে না।’ আর জেলে নেয়া হলেই কেবল দুর্নীতি কমবে না। দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য যা যা করা দরকার দুদক তাই করবে। এজন্য সমাজের সব শ্রেণীর মতামত গ্রহণ করা হবে। অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিশনের জনবলের স্বল্পতার কথা স্বীকার করে চেয়ারম্যান বলেন, এ পর্যন্ত দুর্নীতির কারণে যত মামলা হয় তার প্রায় সব কটিই পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কারণে। আমাদের জনবল দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি খুঁজে খুঁজে বের করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সেজন্য মিডিয়ার অবদান রয়েছে। তাদের কারণেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রকাশ পাচ্ছে। আর আমরা তদন্ত করে মামলা করছি। কালো টাকা প্রসঙ্গে ইকবাল মাহমুদ বলেন, কালো টাকা হচ্ছে দুর্নীতির বিশাল গহ্বর। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কালো টাকা কেউ শেয়ার ব্যবসায়, ফ্ল্যাট বা প্লট কেনায় ব্যয় করছে। যা হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে হবে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শীঘ্রই সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশ করা হবে। কোন অভিযোগ পেলেই মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে যেন কোন নিরীহ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হয় সাংবাদিকদের এমন আহ্বানের জবাবে তিনি বলেন, দুদক থানার মতো কাজ করে না। বিশেষ কোন প্রয়োজন না হলে কাউকে ডাকি না। অনুসন্ধান পর্যায়ে কাউকে ডাকা হয় না। তদন্ত পর্যায়ে দুদক মানুষের কাছে যায়। আমি যতটুকু দেখেছি দুদক আইনে দুর্বলতা নেই। দুর্নীতি নির্মূলে আইনের কোন কমতি নেই। আমাদের ওপর বিভিন্ন মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার রাজনৈতিক চাপ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, শিক্ষার মান বর্তমানে অনেক কমে গেছে। যে ছাত্রই পরীক্ষা দেয় সেই জিপিএ পায়। কেউ যেন ফেল করে না। মান কমার পেছনে ফেল কালচার দায়ী। সবাই জিপিএ’র দিকে ঝুঁকছে। তাই যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক বিষয়ে ফেল করার পরও ছাত্রছাত্রীদের অটো পাস করিয়ে দেয় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। নাম্বার দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলেই পাস করিয়ে দেবেন এটি ক্ষমতার অপব্যবহার। এটিও এক প্রকারের দুর্নীতি। তাই আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলেছি টেস্ট পরীক্ষার খাতা পরবর্তী এক বছর সংরক্ষণ করতে হবে। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৮৫ লাখ ছাত্রছাত্রীকে আমরা দুর্নীতি বন্ধে শিক্ষা প্রদান করছি। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, যেসব চিকিৎসকসহ সরকারী কর্মকর্তারা সরকারের বেতন নিয়ে উপজেলা পর্যায়ে যান না, ডাক্তারগণ কর্মস্থলে থাকেন না, রোগী দেখেন নাÑ এর মাধ্যমে তারা দুর্নীতি করেন। এটাও ক্ষমতার অপব্যবহার। এমন অনেক হাসপাতাল আছে যেখানে মেশিন কেনা হয়েছে অথচ সেগুলো রোগীর জন্য ব্যবহার করা হয় না। তাহলে মেশিন কেনা হলো কেন? আমরা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ হাসপাতালের মেশিন নিয়ে মামলা করেছি। আরও মামলা করা হবে। তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ার করে দেন। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, সরকারী ছাড়া প্রাইভেট ব্যাংক মানেই প্রাইভেট নয়। এখানে জনগণের টাকাই রাখা হয়। প্রাইভেট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সকল অব্যবস্থাপনা দূর করা হবে। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিকে কোন প্রকারে ছাড় দেয়া হবে না। এজন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। সভায় সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, সারাবিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা জঙ্গীবাদ ও দুর্নীতি। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। তবেই কেবল দুর্নীতি রোধ করা সম্ভভ হবে। লোক দেখানো নয় দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষের মনে গেঁথে থাকে এমন কিছু কাজ করতে হবে, এ জন্য কমিশন গণমাধ্যমকে ব্যবহার করবে, আর এতে গণমাধ্যমও সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, অভিভাবক ও শিক্ষকরা হচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণীতে শিশুদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী ও নৈতিক শিক্ষা দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়টি নতুন প্রজন্মের অন্তরে দেয়া গেলে দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, দুদক যতটুকু সম্ভব দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে, আমরা গণমাধ্যম থেকে যেসব সহযোগিতা করার, তা করে যাচ্ছি। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কোন অন্যায় করলে মন্ত্রীদের ডেকে পাঠালে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। রাষ্ট্রের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার পর তা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া কোন নিরীহ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে। কমিশন যত বেশি তথ্য দেবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের তত বেশি কাজ করা সম্ভব হবে। ৭১ টেলিভিশনের এমডি মোজাম্মেল বাবু বলেন, রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ে কোন কাজেরই সঠিক টেন্ডার হয় না। যোগ্যদের বিভিন্ন অভিযোগ দেখিয়ে টেন্ডার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বিদেশী প্রকল্পের বেলায় সমঝোতা করা হয়। সাদা কাগজে দর না উল্লেখ করে টেন্ডারের কাগজ জমা দেয়া হয়। এসব বিষয় যেন কমিশনের নজরে আসে। ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমিশনকে নিয়মিত কাজের বাইরে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করতে হবে। দৈনিক সংবাদের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ুন বলেন, কোন ব্যক্তির প্রভাব বিস্তারের কারণে দুদকের তদন্ত আটকে গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হবে না। তবে নিজের ঘরে দুর্নীত বা কি হচ্ছে তা যেন কমিশন খতিয়ে দেখে। এ বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য কমিশনকে আহ্বান জানান। দুর্নীতির দায়ে করা মামলাগুলো বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে কমিশনের প্রসিকিউশনকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন অনলাইন পত্রিকা বাংলানিউজের আউটপুট এডিটর অশোকেশ রায়। সভায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এস এম হারুন অর রশিদ, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক নওয়াজেশ আলী খান প্রমুখ তাদের মতামত পেশ করেন। মতবিনিময় সভায় কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। সভায় দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ ও দুদক সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামালসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের ব্যক্তিরা বক্তব্য রাখেন।
×