ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

রাজনীতির নয়, দরকার সামাজিক ঐক্য

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৫ জুলাই ২০১৬

রাজনীতির নয়, দরকার সামাজিক ঐক্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন প্রকৃত ধার্মিক। তাই তিনি মাঝে মাঝে এমন সত্য বলেন যা হজম করা অনেেেকর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এই যে তিনি বললেন উচ্চবিত্তের সন্তানরা স্বর্গের হুর কামনায় জান দিয়ে জান নিতে পাগল হয়ে গেছে, কথাটা কি মিথ্যে? কিন্তু এমন করে অনেকে বলেন না। বিশেষত গদিতে থাকলে তো বলার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি সাহস করে বলেছেন বলে আমরা বুঝতে পারি তাঁর অবস্থান কোথায়। তিনি একা এক হাতে যেভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলেছেন তাতে বিস্ময় মানতেই হয়। অথচ আজকের বাংলাদেশের এক বিশাল অংশ বিশেষত কথিত লেখাপড়া জানা মানুষগুলো তাঁর বিরুদ্ধে বিষ ছড়াতে ব্যস্ত। এখন আর অবাক হই না। দেশ-বিদেশে বাঙালীর মধ্যে অনেকেই আজ ধর্ম ও অবিশ্বাসের নামে একচোখ কানা। দেশে দেখুন বদলে যাওয়া বদলে দেয়ার হাউসের লোকেরা কি বলছে? তাদের এক তরুণ লেখক গুলশান আর শোলাকিয়ার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছে এভাবেÑ এর অন্তরালে বা ডামাডোলে নাকি ভারত ও আমেরিকানরা কি সব চুক্তি করে নিয়েছে। কি ভয়ঙ্কর উত্তেজনা ছড়ানোর প্রয়াস! অথচ এই লোক মাত্র কদিন আগে নিহত ফাইয়াজের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। এদের চরিত্রের এই দুর্বলতা ও দ্বিধাই আজকের বাংলাদেশ। এরা টাকার জন্য শোকগাথা লিখবে আর অন্তরে ধারণ করবে বাংলাস্তান। আমি শেখ হাসিনাকে আর একটি কারণে ধন্যবাদ জানাইÑ তিনি এদেশের অভ্যন্তরের পচে যাওয়া দিকটা বের করে এনেছেন। পুরো শরীর পচে যাওয়ার আগে দেশের পা বা হাতের পচন হয়ত সারানো যাবে। সময় গেলে তাও হয়ত হবে না। তিনি যখন সামাল দিচ্ছেন তখন হঠাৎ করে জাতীয় ঐক্যের ডাক এসেছে। কারা বলছে এ নিয়ে? বিএনপির নেতারা দেখলাম সরব। তারা এতদিন ধরে মানুষ মেরে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, সন্ত্রাসে নীরব সমর্থন যুগিয়ে না পেরে এখন বলছে আসুন ঐক্য করি। এখন জাতীয় ঐক্যের ডাক নিয়ে দেশে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। অভিনব বিষয় বৈকি! কিন্তু জাতীয় ঐক্যের ডাক বা দরকার পড়ল এতদিনে? যখন দেশ-জাতির সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই, যখন সন্ত্রাসের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সংস্করণও আমরা দেখে ফেলেছি, তখন এই ডাকের কথা মনে পড়ল রাজনীতিবিদদের? অনেক বিষয় বিলম্বে হলেও মঙ্গলের। যদি তা সার্বিক কল্যাণের পথ খুলে দিতে পারে। জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর কি দলীয় ঐক্য আছে? বিশেষত বিএনপি যখন এ নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করছে তাদের কাছে প্রশ্ন রাখি দল বাদ দিন, আপনারা নিজেরা কি নাজমুল হুদাকে বিশ্বাস করেন? তাঁকে রাখবেন জাতীয় ঐক্যে? তাঁর কথা বাদ। মওদুদ আহমদের ব্যাপারে আপনারা সংশয়হীন? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনারা তাঁকে এক শ’ পার্সেন্ট বিশ্বাস করেন? আওয়ামী লীগারদের বলি আপনারা আসলে মেনন-ইনুর সব বিষয় মানেন? ঠিকমতো আছে মহাজোটের ঐক্য? গদিতে আছেন বলে অনেক অনৈক্য চাপা পড়ে আছে। সে পাষাণচাপা অনৈক্য পুরাণের অহল্যার মতো যেদিন প্রাণ পাবে, দল তো দল, ঘরে ঘরে ঐক্য থাকে কিনা দেখে নেবেন! যদি থাকত নির্বাচনে বিদ্রোহী নামধারী নিজেদের দলের লোকদের ভেতর লড়াই চলত? শেখ হাসিনা না থাকলে বা কোন বিষয়ে নজর না দিলে মহল্লার কমিটি পর্যন্ত হয় না, সে জাতিতে আবার ঐক্য? আসুন বৃহত্তর পরিবেশে। নরেন্দ্র মোদিরা পাওয়ারে এসেছেন গান্ধী বিরোধিতা করে। তাঁরা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে বীর মনে করেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গান্ধীর সমাধি বা মূর্তির সামনে হাতে ফুল নেয়া নতজানু মোদির অজস্র ছবি দেখতে পাবেন। জাতীয় দিবস বা বিশেষ দিনে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনৈক্য নেই তাদের ভেতর। চলুন পাকিস্তানে। আমাদের যেসব সুশীল দেশপ্রেমিক এদেশের নাম শুনলে জ্বলে ওঠেন তাদের বলি আপনারা বাংলাদেশে শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে রবিবারে করতে পারবেন? পাকিস্তান পেরেছে। পারবেন তাদের মতো জাতীয় ঐক্যে মাদ্রাসা বন্ধ করতে? গত ফেব্রুয়ারিতে আমি লাহোর বর্ডারে দেখেছি তাদের দেশপ্রেম কতটা তীব্র। তাদের সবার মাথার ওপর জিন্নাহর ছবি। কোন সরকার এ যাবৎ জিন্নাহকে কায়েদে আজম মানতে অস্বীকার করেছে? একে বলে জাতীয় ঐক্য। আছে আমাদের? আমরা ভারত বা পাকিস্তানের মতো চুক্তিতে স্বাধীন হওয়া দেশ নই। রক্ত সংগ্রাম ইজ্জতহানিতে পাওয়া দেশ আমাদের। তারপরও আমরা এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে মানি না। আমরা কোন দলের কাউকে মানি না। অথচ এখন বলছি জাতীয় ঐক্য চাই। জাতীয় ঐক্যের মানে কয়েকজন নেতা মিলে বৈঠক করা। তারপর মিডিয়ায় হাসি হাসি মুখে বলা সব ঠিক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি বৈঠক করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। ঐক্য হতে হবে পুরো দেশের। সেটা কিভাবে সম্ভব? আমি গান শুনলে একজন বলবে হারাম। আমি নাচলে বলবে বেহায়াপনা, আমি কাঁদলে বলবে ভ-। এভাবে ঐক্য হয়? ঐক্য বা বন্ধনের একটাই পথ। জীবনমুখী মানুষের সংস্কৃতি ও আনন্দের সঙ্গে যোগ করে নেয়া। এককালে ছিল। ছিল বলেই মানুষ একজনকে মরতে দেখলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। সভ্যতা মিডিয়া সুবিধাবাদ অপ্রস্তুত বাংলাদেশীদের স্বার্থপর অন্ধ আর জঙ্গী করে তুলেছে। এখনও জঙ্গীবাদ দুর্বল। একবার আফগানিস্তানের আদলে নিতে পারলে আর কোনকালে আগের জায়গায় ফেরা যাবে না। ইরান তুর্কী আফগানিস্তান পাকিস্তান তার বড় উদাহরণ। তাই চাই বৈকি! জাতীয় ঐক্য চাই। ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে বৈঠক করে দেখুন কি হয়? ওরা আছে, ওদের অস্বীকার করবেন কিভাবে? নির্মূল উচ্ছেদ বা শেষ করার কথা বাদ দিন। জাতীয় সমঝোতার শেষ সুতোটা দিয়ে সবাইকে জড়িয়ে রাখুন। একত্রে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বঙ্গবন্ধুকে না মানার জাতিতে জাতীয় ঐক্য কঠিন। তবু সবাই চেষ্টা করে গেলে হয়ত পথ খুলে যাবে। তখন তা ডুমুরের ফুল না হয়ে এই বর্ষায় কদম হয়েও ধরা দিতে পারে। রাজনৈতিক তামাশার জাতীয় ঐক্য হলেও তা টিকবে না। তার চেয়ে জনগণের ঐক্য আর শুভবোধ সঙ্গে নিয়ে চললে অনেক কিছুই সামাল দেয়া সম্ভব।
×