ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোয়াজ্জেমুল হক

জঙ্গীপনা নির্মূলের এখনই সময়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৫ জুলাই ২০১৬

জঙ্গীপনা নির্মূলের  এখনই সময়

দেশে ভর করেছে নতুন আপদ। যার নাম জঙ্গীপনা। এই জঙ্গীপনার নেপথ্যের চিত্র ভয়ানক ও উদ্বেগজনক। এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জঙ্গীপনার সঙ্গে সমাজের প্রথম শ্রেণীর বিত্তবান পরিবারের সদস্যরাও জড়িত। প্রতিনিয়ত যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পৌঁছাচ্ছে তা একদিকে যেমন দুঃখজনক, অন্যদিকে আগামী দিনগুলোর জন্য অনিশ্চিত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, আইএস (ইসলামিক স্টেট) নামের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনটি বিশ্বে কয়েকটি দেশের বিচিত্র কিছু মানুষের মতো এদেশের যুবসমাজ এবং তাদের অভিভাবকদের ক্ষুদ্র একটি অংশকেও কব্জা করতে সক্ষম হয়েছে। এ আইএসের টানে ইতোমধ্যে দেশত্যাগ করে চলে গেছে একটি অংশ। যে সংখ্যা এখন পর্যন্ত দু’শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ধারণা। সরকার পক্ষে কঠোরপন্থা অবলম্বন করার কারণে এখন প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন পরিবার থেকে নিখোঁজদের খবরাখবর। যে সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোটেল আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গীরা যে ঘৃণ্য ও জঘন্যতম বর্বরতম ঘটনা ঘটিয়েছে, তাতে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে যুবক-যুবতীদের নিয়ে অভিভাবকরা শঙ্কিত। জঙ্গীপনার এ বীজ রোপণ একদিনে হয়নি। এটি দীর্ঘ সময়ের অপতৎপরতার ফসল। বিভিন্ন পর্যায়ের মাদ্রাসার আঙ্গিনা ছাড়িয়ে এ জঙ্গীপনার হিংস্র্র উদ্দীপনা কি করে উচ্চবিত্ত পরিবার ও ইংরেজী মিডিয়ামে লেখাপড়ার প্রতিষ্ঠানগুলোয় পৌঁছে গেল তা নিয়ে এখন প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে। এতে উঠে আসছে ছাত্র থেকে শুরু করে শিক্ষকরাও জঙ্গীপনার স্র্রোতে ভাসছে। সরকারপক্ষ এর যত গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছে ততই বেরিয়ে আসছে নিত্যনতুন খবর। এ খবর পুরো জাতিকে শিহরিত করছে। গুলশান ট্র্যাজেডির পর দেশবাসী বড় ধরনের একটি মেসেজ পেয়েছে। ইতোপূর্বে জঙ্গীপনার বিষয়টি যারা স্বাভাবিকভাবে মনে করে এটিকে এড়িয়ে যেতেন এখন সে পরিস্থিতি নেই। এর পাশাপাশি সরকারপক্ষে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সকল সংস্থা ও গোয়েন্দারা এখন উঠে পড়ে লেগেছে জঙ্গীপনার শিকড় উৎপাটনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জঙ্গীপনার মূলোৎপাটনের এখনই সময়। তবে এ উৎপাটন এককভাবে এককপন্থায় না করে বহুবিধ পন্থায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। পাহাড়ের গহীন অরণ্যে বা বিভিন্ন চরাঞ্চলে এসব জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলে। কিন্তু টার্গেট করা হয় শহরাঞ্চলের মানুষ ও বিভিন্ন স্থাপন। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়িও জঙ্গীদের আস্তানায় পরিণত হয়ে আছেÑ যার কয়েকটি ইতোমধ্যে উদ্ঘাটিত হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতার পাশাপাশি এখন জঙ্গীপনার সন্ত্রাসও যুক্ত হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলা যথা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে জঙ্গীপনার অপতৎপরতা। ইসলামের নামে জঙ্গী তৎপরতার খবর সাম্প্রতিক হলেও কিন্তু অনেক আগে থেকে এ পাঁচ জেলায় রয়েছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের অপকর্ম। যার মধ্যে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা কম নয়। চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে মৌলবাদী জামায়াত-শিবির, ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) উৎপাত রয়েছে বহু আগে থেকে। এরা সহিংস নানা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অস্ত্র, বোমা, বিস্ফোরক নানা দ্রব্য এদের সন্ত্রাসের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সৈকত নগরী কক্সবাজারে রয়েছে দেশীয়সহ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস ও সহিংস তৎপরতা। স্থলপথে সীমান্ত এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গারা মাদক, ইয়াবা থেকে শুরু করে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। এরা নানাভাবে বাংলাদেশী সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মিশে আছে। এর কারণ, এদের শারীরিক গঠন, চেহারা ও কথাবার্তা ওই অঞ্চলের ভাষাভাষীদের সঙ্গে মিল রয়েছে। ফলে সহজে এদের চিহ্নিত করার অবকাশ থাকে না। দেশী-বিদেশী অনুদানে এদের গডফাদাররা যেনতেনভাবে মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ধর্মপ্রাণ নিরীহ যুবকদের কাছে টেনে একপর্যায়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এদের দিয়ে নানা অপকর্ম করিয়ে তারা পার পেয়ে যায়। আর এ কাজে দেশী-বিদেশী অর্থ আসে গডফাদারদের হাতে। কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে যে নজিরবিহীন সহিংস ঘটনা ঘটে গেছে তার নেপথ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে এদের অনেকে বিতাড়িত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। অনেকে এসেছে অভাবের তাড়না থেকে। এরাই গোটা কক্সবাজার অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে রীতিমতো অস্থিতিশীল করে তুলছে। জঙ্গীপনায় জড়িতদের চক্রগুলো এসব রোহিঙ্গাকে অবাধে ব্যবহার করছে। এদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়। অন্যদিকে, পাহাড়ের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ইসলামী ব্যানারের জঙ্গীগোষ্ঠীর বিস্তৃতি ঘটেছে। পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় এরা প্রতিষ্ঠা করেছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদের গোপন আস্তানা। পাহাড়ে প্রায়শ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন নামে অভিযান চলে থাকে। এতে সাফল্যও আসে। কিন্তু একেবারে নির্মূল করা যাচ্ছে না। কারণ মিয়ানমারের পাশাপাশি ভারতীয় সীমান্ত গলিয়ে এ সন্ত্রাসীরা সেনা অভিযানকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলোর পক্ষ থেকে বহু আগে থেকেই এসব সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর সরকারী উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে সেনা নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সময়ে অভিযান চলে থাকে। এসব অভিযানে যেসব অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়ে থাকে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসব অস্ত্র মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের কাছ থেকে নানা পথে অনেকœ হাত ঘুরে দেশের অভ্যন্তরে চলে আসে। পরে যা চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসীসহ জঙ্গীপনায় জড়িতদের কাছে চলে যায়। বর্তমানে জঙ্গীপনার নতুন আপদ নিয়ে সরকারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব সংস্থা যে উদ্বিগ্ন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে গুলশান ট্র্যাজেডির পর সরকার জঙ্গীপনার বিরুদ্ধে যেভাবে নড়েচড়ে বসেছে তাতে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। এখন এদের তৎপরতার খবর যেভাবে বেরিয়ে আসছে তা অতীতে গোপন ছিল। এ গোপনীয়তা ফাঁস হওয়ার পর এখন জঙ্গী নির্মূলে রীতিমতো রব উঠেছে। যা থেকে সরকারের সাফল্য অর্জনের এখনই সময় বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত।
×