ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৫ জুলাই ২০১৬

বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হুট করেই বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটিকে বিয়ে করে ফেলল। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের অবস্থা এখন এমন যে, পুরো গ্রহের নানা জায়গায় বিভিন্নজন গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। তাই যোগাযোগটা কমে গেছে। তবে মনের সম্পর্কটুকু এখনও সেই কলেজের করিডর নয়ত ক্যাম্পাসের ক্যাফেটারিয়াতেই আটকে আছে। বন্ধুটি মিডিয়া জগতের নয়। কিন্তু বিয়ের পর মুহূর্তেই হয়ে গেল মিডিয়ার গরম খবর। ওর বিয়ের খবরটিও আমরা পেলাম পত্রিকার মাধ্যমে। তখনও ফেসবুকের এত প্রচলন ছিল না। লং ডিস্টেন্স ফোনের বিল তুলে কেউ কেউ বলল, কেমনে কী! দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, নিজেরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করার আগেই তাদের বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। আমরা প্রথমে ভাবলাম, সাময়িক ক্রাইসিস। কিন্তু সুদূরে বসেই জানতে পারলাম, বিয়েটা আর টিকল না এবং একটা সময়ে নিজের চোখেও সেটা দেখতে পেলাম। মানুষ বিয়ে করলে সেই বিয়ে ভাংতে পারে। মনের মিল না হলে কী আর করা! সেই বিয়ে ভেঙ্গে গিয়ে আমার বন্ধুটি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। আর মেয়েটিও দ্বিতীয় বিয়ে শেষ করে সবেমাত্র তৃতীয় বিয়ে করেছে। আমি সেই গল্প লেখার জন্য এখানে বসিনি। কিন্তু যতবার মেয়েটি বিয়ে করে, ততবার কেরাম বোর্ডের তৃতীয় ঘুঁটির মতো একটি ধাক্কা এসে আমার গায়ে লাগে। আমাকে প্রচুর মানুষের কাছে একটি প্রশ্ন শুনতে হয়, যার জন্য মেয়েটি মোটেও দায়ী নয়। (তাই আমি কারও নামই এখানে লিখছি না।) সবাই যে প্রশ্নটি আমাকে করে তা হলো, ওহ, সে তো প্রথমে আপনার বন্ধুকে বিয়ে করেছিল। আমি মুচকি হেসে বলি, জি। পরের প্রশ্ন হলো, আপনার বন্ধু তো মেয়েটাকে ঠকিয়েছে। আমি কিছু বলি না। আমি জানি পরের লাইনে তিনি কী বলবেন। আমি অপেক্ষায় থাকি। তিনি যথারীতি বলেন, আপনার বন্ধুর তো ওই দেশে একটা বউ ছিল। এটা তো তিনি মেয়েটিকে বলেননি। বিয়ে তো ভাংবেই। জার্মানিতে যখন একজন উন্মাদ গুলি করে ১০ জন নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলছে এবং বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে যখন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে, তার ভেতর আমাকে শুনতে হচ্ছে আমার বন্ধুর আগে একটি বউ ছিল, যা সে তার সেলিব্রেটি বউকে বলেনি। মাঝে মাঝে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের বলি, ‘হোয়াট এ ওয়ার্ল্ড আই এম লিভিং ইন!’ বিয়ে একটা খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। আর আমার স্বভাব হলো এমন যে, নিজ থেকে কেউ না বললে তাকে আর ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি না। বিয়েটা ভাঙ্গার পর বন্ধুটির সঙ্গে আমার অজস্র্রবার দেখা হয়েছে। আমি তাকে কখনও জিজ্ঞেস করিনি, কেন বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে গেল? একদিন সে আমার হাতটা ধরে শুধু বলেছিল, ‘ওই দেশে যদি আরেকটা বিয়ে করতাম সেটা কি আর কেউ জানত না? তোর তো নেটওয়ার্ক অনেক বড়, একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না!’ আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারি না। প্রাপ্তবয়স্ক একটি ছেলের এমন কষ্ট হতে পারে, আমার তা আগে জানা ছিল না। কয়েক বছর আগে সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। ওখানে বন্ধুদের উপস্থিতি ছিল বেশ। এখন বেশ সুখীই মনে হয় তাদের। কিন্তু তার সেলিব্রেটি স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে ভাঙ্গার বিষয়টি মানুষের মুখে মুখে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এমন একজন মানুষ পাইনি যিনি আমাকে একটু সংবেদনশীল হয়ে বলেছেন, তাদের তো অন্য কোন সমস্যাও থাকতে পারে, যা আমরা জানি না। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, ওর বিদেশে একটা বউ ছিল। বিশ্বাসের এই কালো পাথর আপনি সরাবেন কিভাবে? ॥ দুই ॥ বাংলাদেশে যখন কোন হত্যাকা- ঘটে তখনই বিভিন্ন আড্ডায় সাগর-রুনীকে নিয়ে কথা হয়। কিছু বিষয় মিডিয়াতে আসে, কিছু আসে না। তবে রেফারেন্স হিসেবে চলেই আসে। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এর বিচার চেয়ে আসছে। সবাই জানতে চায়, ঠিক কী হয়েছিল? কিন্তু আমি নিশ্চিত কারও কাছেই সঠিক উত্তরটি নেই। অনেক আগে একদিন একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ব্যাপারটা কী বলেন তো? কিভাবে সাগর-রুনী মারা গেলেন? তিনি মুচকি হেসে বললেন, আমি যতটা শুনেছি বাসায় চোর ঢুকেছিল। তারাই খুন করে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে এটা মানুষকে জানানো হচ্ছে না কেন? তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, এটা মানুষ বিশ্বাস করবে না। সাগর-রুনীর পর আরও অসংখ্যবার রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, যা দেশের মানুষের হৃদয়কে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে গেছে। মানুষ উত্তর খুঁজেছে, যা আজও মেলেনি। তনু হত্যার সময়, চট্টগ্রামে পুলিশ অফিসারের স্ত্রী মিতু হত্যার সময়, হেফাজতের সময় হতাশ হয়েছে। ব্লগার হত্যা থেকে শুরু করে পরবর্তী যত হত্যাকা- এসে মানুষের হৃদয়কে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে তার কোনটারই হয়ত সঠিক উত্তর মানুষ পায়নি কিংবা পাওয়াটা জরুরী মনে করেনি কেউ। এগুলো তো আর মাটি থেকে উধাও হয়ে যায় না; মানুষের ব্রেইনে থেকে যায়। তাই কোন কিছু ঘটলেই আড্ডার আসরে এগুলো উঠে আসে। আরেক আড্ডায় সরকারের কাছের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, আগে তো দেখতাম অন্তত মিডিয়ার কর্মীদের বিষয়গুলোর জটিলতা খুলত; কিন্তু সাগর-রুনীর জটিলতাটা খুলছে না কেন? তিনি বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ওখানে কোন জটিলতা নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে আপনারা এটা প্রকাশ করছেন না কেন? তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, বাংলাদেশের মানুষ ওই রিপোর্ট বিশ্বাস করবে না। আমি আগে যেহেতু এমন একটা বিষয় শুনেছি, তাই তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, মানুষ কী বিশ্বাস করবে? তিনি কঠিন হয়ে বললেন, মানুষ বিশ্বাস করে এর সঙ্গে অমুক (...) গ্রুপের মালিক জড়িত। এর বাইরে আপনি যা-ই রিপোর্ট করবেন, পাবলিক খাবে না। এক্সেপ্ট করবে না। আমি আবারও বললাম, পাবলিক এমন একটা বিশ্বাস তৈরি করল কিভাবে? তিনি আরও কঠিন হয়ে বললেন, ‘আমাগো ... মিডিয়া।’ ব্যাপারটা কি তাহলে এই দাঁড়ালো যে, আমাদের মিডিয়াগুলো বিষয়টাকে আগেই এমন ভিন্ন একটা চিত্র এঁকে দিয়েছে যে, সেই চিত্রকে আর পাল্টানো যাচ্ছে না কিংবা সেটা পাল্টানোর মতো শক্তি ক্ষয় করতে চাইছে না কেউ! তাই সত্যটা সেই মাটির নিচেই চাপা পড়ে আছে। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য বিষয় মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। বাংলাদেশের অসংখ্য জাতীয় ইস্যুতে তথ্যের নানা ধরনের ভার্সন আছে যার হয়ত কোন ভিত্তি নেই। আমরা সেটা জানি না। তবে এটা নিশ্চিত, মানুষের ভেতরে এক ধরনের চিত্র আঁকা হয়ে গেলে সেটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা কেউ করছে না। আমরা সত্যটার ওপর দাঁড়াচ্ছি না। এই জাতি কি সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়? ॥ তিন ॥ এই লেখা যখন লিখছি তখন জার্মানির মিউনিখ শহরে এক তরুণের গুলিতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যেখানে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু ও ১৪ বছরের কম বয়সী; আর আফগানিস্তানে আত্মঘাতী বোমায় ৬০ জনের প্রাণহানি হয়েছ এবং এটাতে আইএস তাদের দায় স্বীকার করেছে। প্রায় প্রতিটা সপ্তাহেই পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকা-- কখনও রাষ্ট্র, কখনও কোন ব্যক্তি বা সংগঠন। জার্মানির এই ঘটনায় যদিও প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল যে, একাধিক বন্দুকধারী এই আক্রমণ চালিয়েছে; কিন্তু বন্দুকধারী ছিল ১ জন। সে ইরান এবং জার্মানির দ্বৈত নাগরিক, মাত্র ১৮ বছর বয়স। হত্যাকা- চালানোর পর সে নিজের বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করে। জার্মানিতে কিছুদিন আগে হয়ে গেছে আরেকটি আক্রমণ। তাই কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, খাল কেটে কুমির এনেছিল জার্মানি। ভিন দেশের মানুষকে ওখানে থাকতে দিয়ে ভুল করেছিল তারা। অবস্থা এখন এমন যে, পৃথিবীর যে কোন স্থানেই এটা ঘটতে পারে। কিন্তু দেখার বিষয়, কে কিভাবে বিষয়টিকে সামাল দিচ্ছে এবং মানুষের কাছে তথ্য সরবরাহ করছে। জার্মানির হামলার ঘটনায় দেশটির প্রধান মিডিয়াগুলোসহ সারারাত বিবিসি এবং সিএনএন লাইভ সম্প্রচার করেছে। এটা নিয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ কিংবা প্রশ্ন ছিল না, কেন তারা লাইভ করছে। কোন বিষয় লাইভ করার মতো হলে, সেটা করবে না কেন? তাতে মানুষের মনে কোন সন্দেহের দানা বাঁধে না। পাশাপাশি ওখানে পুলিশ নিয়মিত ব্রিফিং করে হতাহতের ঘটনা জানিয়েছে। একই সঙ্গে সে দেশের পুলিশ টুইটারসহ অনলাইনের মাধ্যমে বেশ সক্রিয় ছিল। তবে পুলিশ সেখানে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছে যেন পুলিশের অবস্থানের ছবি তুলে প্রচার না করা হয়, যাতে করে হামলাকারীরা পুলিশের অবস্থান বুঝতে পারে। সমাজে পুলিশের পাশাপাশি জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। জের এড়াতে মিউনিখ পুলিশ শুক্রবার সন্ধ্যায় গোলাগুলি শুরুর পরপরই টুইটারে তথ্য প্রকাশ করতে শুরু করে। এ বিষয়ে তাদের প্রথম টুইট ছিল জার্মান ভাষায়, যেখানে জানানো হয়, মিউনিখের অলিম্পিয়া শপিং সেন্টারে পুলিশের বড় ধরনের অভিযান শুরু হয়েছে। গোলাগুলিতে হতাহতের সংখ্যা কিংবা সহিংস ঘটনা নিয়ে কোন ধরনের লুকোছাপাও করেনি তারা। পুলিশ টুইটারে গোলাগুলির তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে সব সময় যে নিশ্চিত হয়ে সব তথ্য প্রকাশ করেছিল তা নয়, বরং অনিশ্চিত সূত্রের কথা উল্লেখ করেও তারা কিছু তথ্য প্রকাশ করে, যেগুলো পরবর্তী সময় ‘সঠিক নয়’ বলে পুলিশই কারণ ব্যাখ্যাসহ স্বীকার করে নিয়েছে। প্রথম টুইট থেকে কিছু গণমাধ্যম ধারণা করেছিল, গোলাগুলির পরিধি সম্ভবত বাড়ছে; কিন্তু পরবর্তী সময় দেখা গেছে, বন্দুকধারী রেস্তরাঁ এবং শপিং সেন্টারের কাছের একটি জায়গা ছাড়া আর কোথাও গুলি চালায়নি। আর দ্বিতীয় টুইটে একাধিক সন্দেহভাজন হামলাকারীর ইঙ্গিত থাকলেও পুলিশ পরবর্তী সময় নিশ্চিত করেছে, বন্দুকধারী একজন ছিল, বাকি যে দুজন, যারা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল, তারা আসলে হামলাকারী ছিল না। [সূত্র : ডয়েচে ভেলে] জার্মান পুলিশের বক্তব্যে জানা গেছে, মিউনিখ হামলার জন্য দায়ী তরুণের সঙ্গে আন্ডার্স বেহরিং (পাঁচ বছর আগে নরওয়েতে ৭৭ জনকে গুলি করে হত্যাকারী)-এর সংযোগ রয়েছে। নরওয়ের ওই হত্যাকা-ের পাঁচ বছর পূর্তির দিনকে এই যুবক মিউনিখ শহরটিকে দিনক্ষণ হিসেবে বেছে নিয়েছে। যতটুকু জানা যায়, বর্তমানে কারাগারে আটক বেহরিং উগ্র ডানপন্থী রাজনীতির সমর্থক। তিনি ইসলাম এবং মার্ক্সিজমের বিরোধী। নিজেকে সে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ও ফ্যাসিবাদী বলে পরিচয় দেয়। জার্মান পুলিশ আরও জানিয়েছে, মিউনিখে হামলকারী জার্মান-ইরানী তরুণ সম্ভবত ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ ছিল এবং বিষণœতার চিকিৎসা নিচ্ছিল। তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে হামলার সঙ্গে তথাকথিত জঙ্গী গোষ্ঠীর কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পুলিশ এটাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলার মতো কোন কারণও খুঁজে পাচ্ছে না। জার্মানির এই ঘটনায় পুরো দেশ আবারও শোকে নিমজ্জিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু পুলিশের এই তথ্যপ্রবাহে কোথাও কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেছেন কিংবা অবিশ্বাসের তীর ছুড়ে দিয়েছেন, তা কি কেউ বলতে পারবেন? জার্মান পুলিশকে তাদের দেশের মানুষ কেন এতটা বিশ্বাস করে! ॥ চার ॥ জনগণ রাষ্ট্র তৈরি করে। তার জন্য একটি ভূখ-ের প্রয়োজন হয়। সেই ভূখ-ের নিরাপত্তার জন্য বেড়া (যাকে আমরা বর্ডার বলি) দিয়ে রাখা হয়। আর সেই ভূখ-ের পরিচালনা এবং উন্নতির জন্য কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দেয়া হয়, যেন ওই ভূখ-ের জনগণের সার্বিক উপকার হয়। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত হয় এবং দিনের শেষে জনগণ তাদের জীবনকে সুখী দেখতে চায়, আনন্দ করতে চায়, জীবনকে উপভোগ করতে চায়। এই চাওয়াগুলোর ফর্ম ভিন্ন। আর রাষ্ট্র কিভাবে চলবে তারও ফর্মুলা একেকটি দেশ একেকভাবে ঠিক করে নিয়েছে। কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ ইসলামী শাসন ইত্যাদি। জনগণ একটি পরিচালনা পরিষদ করে দেয়, যাকে আমরা রাষ্ট্রনায়ক এবং এর পরিষদ বলি। কোথাও রাষ্ট্রপতি, কোথাও প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের মালিকানা কিন্তু জনগণেরই। এই ফর্মুলা থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে, তাদেরই ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। সেই রাষ্ট্রগুলো ভালভাবে চলেনি। কেউ কেউ ঝুট-ঝামেলা নিয়েই চলছে আর কি! এগুলো মূলত দুর্বল রাষ্ট্র। আর একটি রাষ্ট্র যখন দুর্বল হয় কিংবা পরনির্ভরশীল হয়, তখন সেই রাষ্ট্রে এসে ভর করে অন্য রাষ্ট্র। মানুষ মাত্রই লোভী। কারও ক্ষমতার লোভ, কারও টাকার লোভ। সেই লোভে আলেকজান্ডারের মতো মানুষ ভারতবর্ষ পর্যন্ত চলে এসেছিল। ব্রিটিশরা এই গ্রহের এতটাই মাটি দখল করে নিয়েছিল যখন বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত যায় না। সময়ের বিবর্তনে বিশাল বিশাল সেই সাম্রাজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের অনেকেরই অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে এবং সর্বশেষ গ্রেট ব্রিটেনের ‘গ্রেট’ বিষয়টি নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এর সব কিছুর মূলে হলো জনগণ। আর এই জনগণকে যদি পাশ কাটানো হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের পরিণতি ভাল হয়েছে এমন উদাহরণ এই গ্রহে নেই। তার মূল কারণ হলো, জনগণ যেহেতু রাষ্ট্র ফর্ম করে, তাই যে কোন বিপদে কিংবা সঙ্কটের সময় তারা সবাই এক হয়ে সেই সঙ্কট মোকাবেলা করে থাকে। কিন্তু জনগণ যদি কোন গভীর সঙ্কটের সময় রাষ্ট্রের সঙ্গে না থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্র বিপদের মুখে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ রাষ্ট্র তার মূল ডেফিনেশন থেকেই সরে গেছে। জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জনগণকে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত রাখার প্রধান উপাদান হলো সঠিক তথ্যপ্রবাহ। জনগণ যেহেতু রাষ্ট্রের মালিক, তাই তার সঠিক তথ্য জানাটা জরুরী। এটা রাষ্ট্রের জন্যই জরুরী। আর জনগণকে যদি ভুল তথ্য দেয়া হয় কিংবা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়, সেই রাষ্ট্রের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। আর রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারালে বিপদের সময় তারা পাশে আসবে না। কারণ, তারা তখন নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ মনে করতে পারে না। তাই এই গ্রহের ভাল ভাল রাষ্ট্রগুলো নিজেদের জনগণকে সব সময় সঠিক তথ্যটি দিয়ে রাখে। তাদের রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে। আর সেই সুতা যদি ঢিলে হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রের পতন হতে পারে এবং এই যে দেখছেন ব্রিটেন একটা সাদামাটা ভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল, এর মূল কারণটাই কিন্তু জনগণের তথ্যপ্রবাহ। একটি বড় অংশ মনে করেছে, তারা আলাদা হয়ে গেলে ভাল থাকবে এবং ভোটে তারা জয়ী হয়েছে। এখন ওই ভূখ-ে কাউকে থাকতে হলে বৃহত্তর মানুষের ইচ্ছাতেই থাকতে হবে। কিন্তু ওই দেশের প্রশাসন যদি তাদের জনগণকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারত তাহলে হয়ত জনগণের ভোট অন্যদিকেও হতে পারত। এখানে জনগণের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বৈকি! জনগণের কতটা শক্তি তা বোঝা গেছে এই ভোটের সময়। অনেকেই রাষ্ট্রের মূল কনসেপ্ট থেকে সরে গিয়ে এমন সব কর্মকা- করতে থাকেন যখন জনগণ ধীরে ধীর দূরে সরে যায়। তখনও মহাবিপদ। বিশেষ করে বর্তমান জটিল বিশ্বে ভূখ- এবং রিসোর্স দখলের যে প্রতিযোগিতা শুরু“ হয়েছে, সেটাকে ঠেকানোর জন্য জনগণের শক্তিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আর জনগণকে যুক্ত করার মূল উপায় হলো, জনগণের সঙ্গে সৎ থাকা, তাদের সঠিক তথ্যটি পরিবেশন করা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যে কঠিন সময় পার করছে, তার জন্য চাই সর্বস্তরে জনগণের সম্পৃক্ততা। আর সেটা নিশ্চিত করতে হলে জনগণকে সম্মান করতে হবে, তাদের ইমোশনকে মূল্য দিতে হবে এবং তাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য দিয়ে আপডেট রাখতে হবে। যদি আমরা তথ্যের ধুয়া নিয়ে খেলতে শুরু করি, সেই ধুয়ার নিচে আগুনের উত্তাপকে নেভানোর অস্ত্র এই গ্রহে তৈরি হয়নি। হবেও না কোনদিন। ॥ পাঁচ ॥ ফেসবুকের পাতা ঘুরতে ঘুরতে নিচের দুটো কথোপকথনে আমার চোখ আটকে যায়। পাঠকদের জন্য সেটা শেয়ার করছি। কথোপকথনÑ ১ : আপনি কী সিঙ্গেল? : জি ! : সত্যি করে বলেন? : সত্যিই বললাম! : সত্যিই সিঙ্গেল? : হ্যাঁ! : রোজার মাস গেল কিন্তু কিছুদিন আগে? সত্যি করে বলেন? : হ্যাঁ ... বললাম তো! : বিশ্বাস হলো না; আমার কাছে লুকায়েন না, বলেন? : আরে আজব! বললাম তো সিঙ্গেল। : বিশ্বাস করতে পারলাম না। : না বিশ্বাস করলে আর কি করা! কথোপকথনÑ ২ : আচ্ছা, আপনি কি সিঙ্গেল? : না। : আরে গ্রেট! আপনাদের জন্য শুভ কামনা। : হে হে ! চাপা মারছি। : এখন আর ওসব বলে লাভ নেই। আমি জানি, আপনি সত্য বলেন। : আসলেই চাপা মারছি। আমি সিঙ্গেল! : এখন আর পার পাবেন না। আমি জানি, আপনি সত্যই বলেছেন প্রথমে। পুনশ্চ : বাংলাদেশের মানুষ সত্যও বিশ্বাস করে না, মিথ্যাও বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের মানুষ সেটাই বিশ্বাস করে, যা সে শুনতে চায়। এর মূল কারণ হলো, সে নিজেকেই বিশ্বাস করে না। অন্যকে বিশ্বাস করার আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে হয়। ২৩ জুলাই ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×