ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উপাচার্য-সরকার মতবিনিময়

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির তাগিদ

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ২৪ জুলাই ২০১৬

 জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গীবাদী কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা (ভিসি)। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তারা বলেছেন, দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক ধরনের সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে জঙ্গীবাদের প্রতি আকৃষ্ট না হয় সেজন্য খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানো, ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়া, ছাত্র রাজনীতিতে চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় না দেয়া ও শিক্ষক নিয়োগে সতর্ক হওয়া জরুরী বলে বলা হয়। পাশাপাশি প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী সেল গঠন, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম মনিটরিং, আইকন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তরুণদের ব্যাপকভাবে তুলে ধরার বিষয়েও একমত হয়েছেন উপাচার্যরা। তারা বলেন, দেশের স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দলাদলি ভুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশে জঙ্গীবাদবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলতে আগামী ১ আগস্ট দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন কর্মসূচীও পালন করা হবে। শনিবার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তারা এসব পরামর্শ দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি আয়োজিত এ সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য, শিক্ষক, শিক্ষক নেতা, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ, ইউজিসির সদস্যবৃন্দ এবং শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, সিনিয়র সচিবসহ উর্ধতন কর্মকর্তরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আপনারা দেখুন মেধাবী ছাত্ররা কোথায় যায়, কেন যায়? আমাদের জানান। তাহলে আমরা সহজে কাজ করতে পারব। দু’একটি বাদে বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জঙ্গীরা এখনও ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। তাই আপনাদের আরও সচেতন হতে হবে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক অন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, বিপথগামীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়, অতি নগণ্য। এদের বিরুদ্ধে আমরা বিজয়ী হবই। জঙ্গীবাদ শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সমস্যা বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিল, শিকড় খুঁজলে দেখা যাবে সাম্প্রতিক হামলাগুলোতেও তাদের যোগসাজশ রয়েছে। সভাপতির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অভিযোগ করে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষকদের জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করেছি। কিন্তু তারা আমলে নেননি। জঙ্গীবাদে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় দুই বছর আগে আমাদের চাপেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এখন গুলশান হামলায় চাকরিচ্যুত সেই শিক্ষকের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাই শিক্ষকদের এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে জঙ্গীবাদ রোধে করণীয় ঠিক করা হবে বলেও তিনি জানান। সভার শুরুতে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, মাদ্রসা পড়ুয়া গরিব ঘরের সন্তানের জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত হয়- গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলা প্রচলিত এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তাই সতর্ক হতে হবে। সভায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, জঙ্গীবাদবিরোধী যে কোন কার্যক্রমে সরকার ও আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে বুয়েট প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জঙ্গীবাদ রুখতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিন বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের চাষ হয়েছে এবং তা ফুলে-ফলে ভরপুর হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে সাংস্কৃতিক শূন্যতা। চাঁদাবাজদের কাছে দেয়া হয়েছে ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্ব। আমাদের ছাত্রদের বিরুদ্ধে শিক্ষক হত্যার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু যাদের প্ররোচনায় তারা এ কাজ করল তাদের ব্যাপারে কখনও কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। জঙ্গীবাদবিরোদী কর্মকা-ের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করে ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ইঙ্গিত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শর্ষের ভেতর ভূত আছে কিনা তাও দেখা দরকার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেন, স্কুল-কলেজে আমাদের শিক্ষার্থীদের কারা পড়াচ্ছেন সেটা দেখতে হবে। ১৮ বছরের আগেই একজন শিক্ষার্থীর মন জঙ্গীবাদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এটা ভয়ঙ্কর। চাঁদাবাজ ছাত্রনেতাদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার সাহস পান না বলেও মন্তব্য করেন এই উপাচার্য। নিজেদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী স্বাধীনতা বিরোধীদের ব্যাপারে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান খান বলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে স্বাধীনতার পক্ষের শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এটা দুঃখজনক। আর স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকেরা এই সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটছে। জামায়াত-শিবিরের লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার জন্য উপাচার্যদের এবং তাদের নিয়োগ দানের জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশ না করার আহ্বান জানান বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এম মাকসুদ কামাল।
×