ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৪ জুলাই ২০১৬

দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ নতুন করে আরও ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের একটি কর্তৃপক্ষ বা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এনএসডিএ) গঠন ও তা চলতি অর্থবছর থেকে কার্যকর করার কথা ভাবছে সরকার। এর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন করে আরও বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এতে করে উচ্চ উৎপাদনশীল দক্ষ জনশক্তির সহায়তায় বাংলাদেশ উচ্চতর প্রবৃদ্ধির সোপানে আরোহন করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে এনএসডিএ একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্রুত স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫ কোটি ৮৭ লাখ শ্রমশক্তি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্যে ব্যবস্থাপক, টেকনিশিয়ান, সহায়ক কর্মী, সেবা ও বিপণন কর্মী, কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে দক্ষকর্মী, কারুশিল্পে নিয়োজিত কর্মী, প্লান্ট ও মেশিন অপারেটর ও যন্ত্রাংশ সংযোজনকারী অন্যান্য প্রাথমিক পেশায় রয়েছেন। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত রয়েছেন ৭০ লাখের মতো বাংলাদেশী। এসব শ্রমিকের আয় বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন জরুরী হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের শ্রমশক্তির স্বল্প দক্ষতা উচ্চতর হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বল্প দক্ষতার কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি শ্রমশক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পোশাক শিল্পের ন্যায় দ্রুত প্রসারলাভকারী খাতসমূহ দক্ষশ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনায় দক্ষ পেশাজীবী কর্মীর সঙ্কটে ভুগছে। দক্ষতার অভাবে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি শ্রমবাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে, যে ৭০ লাখ লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত আছেন তার মধ্যে ৩১ শতাংশ দক্ষ, ১৪ শতাংশ অর্ধদক্ষ, ২ শতাংশ পেশাজীবী এবং ৫২ শতাংশ স্বল্পদক্ষ। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়ার প্রেক্ষাপটে দক্ষ জনবল প্রেরণ করা হলে প্রবাসী আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বিগত কয়েক বছরে দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থায় অগ্রগতি অর্জিত হলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনে এখনও বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। দক্ষতা উন্নয়ন একটি মূলধনঘন ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, নিয়মিত পরিচর্যা ও আধুনিকায়ন। তিনি বলেন, এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদী দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্র্র্তৃপক্ষ গঠন ও তা কার্যকর করে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা হবে। কার্যকর করা হচ্ছে জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল। জানা গেছে, রূপকল্প-২১ এবং এসডিজি বাস্তবায়নসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নে মানবসম্পদের দক্ষতা, জ্ঞান ও উদ্ভাবনী শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে গত অর্থবছরের বাজেটেই মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ পরিচালনার জন্য জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল (এনএইচআরডিএফ) গঠন করে তাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দেরও প্রস্তাব করা হয়। নিরাপদ ও উন্নত কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনই এ তহবিলের লক্ষ্য। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগের স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ তহবিল গঠন করা হয়েছে। তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রাক-নিয়োগ ও কর্মকালীন প্রশিক্ষণ এবং নারী, সুবিধাবঞ্চিত ও বেকার জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হবে এ তহবিল। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ প্রদানকারীদের অর্থায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে এ তহবিল কাজ করবে। এতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শক্তিশালী হবে, বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে, শিক্ষা ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সঙ্গে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। সরকারের এই উদ্যোগের ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক দক্ষ হওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে করে তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে। তিনি বলেন, দ্রুত এটি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। এতে দেশের উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়বে। জানা গেছে, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কার্যকর কিছু কর্মসূচী রয়েছে। জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে মালয়েশিয়া জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে মানবসম্পদ উন্নয়ন নামে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করেছে ১৯৫৭ সালে। দক্ষতা উন্নয়ন, শ্রমবাজার উন্নয়ন ও বিশ্লেষণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে এ মন্ত্রণালয়। সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে যুবসমাজের দক্ষতা উন্নয়নে ১৯৯৩ সালে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এইচআরডিএফ) গঠন করেছে মালয়েশিয়া। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে দক্ষ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ১৯৮৫ সালে ভারতও গঠন করেছে একই ধরনের মন্ত্রণালয়। ২০০৯ সালে দেশটি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন তহবিলও গঠন করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন তাদের জনসংখ্যার বোনাসকাল কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে এক সময় বেশি জনশক্তিই দেশটির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তখন বাধ্য হয়ে এক সন্তান নীতি গ্রহণ করে তারা। তবে ২০০০ ও ২০০৮ সালে মন্দায় পড়ার পর দেশটি মানবসম্পদ উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করে দেশের জনশক্তিকে দক্ষ করে তোলায় মনোযোগ দিয়েছে। এক সন্তান নীতি থেকেও বের হয়ে এসেছে চীন।
×