ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধার-কর্জ করে কোন রকমে দিন পার করছে, মেলেনি সরকারী ত্রাণ ওষুধপথ্য

কুড়িগ্রামে বানভাসিরা এক বেলা খাচ্ছে তো অন্য বেলা উপোস

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৪ জুলাই ২০১৬

কুড়িগ্রামে বানভাসিরা এক বেলা খাচ্ছে তো অন্য বেলা উপোস

রাজুমোস্তাফিজ, ব্রহ্মপুত্র পার থেকে ॥ ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম মশালের চর। পূর্বের সূর্য তখন মাথার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। এ গ্রামের সাহেরা খাতুন তার দুই মেয়ে আলপনা (১২) আর আমিনা (১০) সকাল থেকে কিছু খায়নি। অতিকষ্টে ভাত রান্না করলেও তরকারির অভাবে খেতে পারেনি। এক সময় বাধ্য হয়ে একটু মরিচের সন্ধানে দুই মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। তাদের ঘরে এক বুক পানি। প্রতিবেশী বৈজুদ্দির বাড়ি গিয়েছিল মরিচ কর্জ করতে কিন্তু পায়নি। সাহেরা খাতুন জানান, তিনবারের বন্যায় তারা কাহিল হয়ে পড়েছে। গ্রামে এক সমিতির কাছ থেকে চড়া সুদে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কোন রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বন্যার দিনে তাও শেষ হওয়ার পথে। তার স্বামী আবদুল ওহাব পাশর্^বর্তী মোল্লারহাটে গেছে কারও কাছ থেকে ধার আনতে। বন্যা যদি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে মরণদশা হবে। শুধু সাহেরা খাতুনের পরিবারের নয়, এ অবস্থা গৃহবধূ রাশেদা খাতুন (৩৩), নবীরণসহ (২৫) অনেকেরই। বন্যার পানিতে আশপাশের সবজি ক্ষেত, দোকানপাট সম্পূর্ণ পানির নিচে। শনিবার দুপুরে ঘরের এক হাঁটু পানির মধ্যে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাচানের ওপর এক প্রকার উপোস দিন কাটাচ্ছে ওরা। তারা দিনরাত মিলে এক অথবা দু’বেলা খাবার খাচ্ছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বেকার দিন কাটাচ্ছে বন্যাকবলিত দেড় শ’ গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ধার-দেনা অথবা চড়া সুদে টাকা নিয়ে কোন রকমে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তারা। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর এখনও কোন সরকারী ত্রাণ জোটেনি। বন্যাকবলিত ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর, তিস্তাসহ ১৬ নদ-নদীর অববাহিকার ৪শ’ চর-দ্বীপচরের পানিবন্দী অধিকাংশ মানুষ পুরোপুরি দিনমজুরির ওপর নির্ভরশীল। তাদের ঘরে মজুদ খাবার শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জেলার ৯ উপজেলার ৬৫ ইউনিয়নের নদ-নদী তীরবর্তী ৪শ’ চর-দ্বীপচর গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। চারিদিকে পানি আর পানি। কাঁচা-পাকা সড়কগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় গ্রামগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্রের প্রবল স্রোত বয়ে যাচ্ছে সাহেবের আলগা আর বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ১৮ ওয়ার্ডের সবকটি গ্রমের ওপর দিয়ে। এ দুটি ইউনিয়নে প্রায় ৩২ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ছয় হাজার পরিবার কর্মহীন হয়ে খাদ্যকষ্টে পড়েছে। এদের অধিকাংশই দৈনিক আয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। দুঃসহ এক সঙ্কট পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে তারা। একবেলা আধাপেটা খাবার জুটছে তো দু-তিন বেলা উপোস। দারুণ রকম অপুষ্টির শিকার হয়ে পড়েছে শিশু, কিশোর ও মহিলারা। ব্রহ্মপুত্র পারের বন্যাকবলিত গ্রামগুলো হলোÑ বালাডোবা, খুদিরকুঠি, পোড়ারচর, মশালেরচর, চরমোহম্মদ, চরফকির মোহম্মদ, বতুয়াতুলি, আক্কল মামুদ, চিতুলিয়া, দৈ খাওয়া, চেরাগের আলগা, জাহাজের আলগা, চরদুর্গাপুর, সাহেবের আলগা, গেন্দার আলগা, কাজিয়ারচর, সুখর বাতিরচর। এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অভাবী মানুষের দুর্ভোগ চরম সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে, না দেখলে বোঝা যাবে না। অনেকের বাড়ি ব্রহ্মপুত্রের প্রবল স্রোতে ভেঙ্গে যাচ্ছে। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আলমের বাজার, সরকারপাড়া, ম-লপাড়া, মিয়াজীপাড়া, কবিরাজপাড়ায় গত দুই সপ্তাহে ৩শ’ ৯৭ বাড়ির ভিটেমাটি তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে। এসব পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন মানুষের বাড়ির উঠানে আশ্রয় নিয়েছে। এ ইউনিয়নের বড় গৃহস্থ আলমের বাজার এলাকার রহমান (৪৭), সরকারপাড়ার আমজাদ (৪৩) ও মিয়াজীপাড়ার কোবাদ ডিলার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব। তারা মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ম-লপাড়ার কৃষক সুকমোল (৬০), শাহেদ আলী (৫৫) দু’সপ্তাহ আগে আমনের চারা জমিতে লাগিয়েছিল, ধান লকলকিয়ে বড় হচ্ছিল। অথচ এসব ধানক্ষেত এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। নতুন কোন চারা নেই তাদের। পানি নেমে যাওয়ার পর কিভাবে আবার ধান লাগাবে এ চিন্তায় পড়েছে তারা। বন্যাকবলিত বিভিন্ন ইউনিয়নের সর্বত্র ক্ষুধা আর ক্ষুধা। পানিবন্দী মানুষগুলো খাবার চায়। পরিবহন সমস্যাও প্রকট। অধিকাংশ মানুষের নৌকা নেই। কেউ কেউ কলার ভেলায় মালপত্র নেয়ার কাজ করছে চড়া ভাড়া দিয়ে। কেউ কেউ অন্যের বাড়ির উঠানে অথবা খোলা মাঠে আশ্রয় নিয়েছে। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন মাস্টার জানান, ইউনিয়নের ৯ ওয়ার্ড পানিতে সাত দিন থেকে তলিয়ে আছে। মাত্র চার টন জিআরের চাল বরাদ্দ পেয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। এখনও বিতরণ করা হয়নি। আতঙ্কে আছি এত অল্প চাল কিভাবে বিতরণ করব। প্রতিদিন তার কাছে দুই থেকে তিন শ’ মানুষ শুধু খাবারের জন্য আসছে। জেলা প্রশাসক খান নুরুল আমিন জানান, বন্যা ও ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও ৯২ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে শুকনা খাবার কেনার জন্য। নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব ৭৩ পরিবারের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার টাকা। এক হাজার ৮শ’ ৭৫ জনের বিপরীতে জিআর ক্যাশ দেয়া হয়েছে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর ৯ হাজার ২শ’ জনের বিপরীতে জিআর চাল দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকে পাবে ১০ কেজি করে চাল। ঢাকায় জরুরী ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৫শ’ টন চাল ও ১০ লাখ টাকা।
×