ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জল আছে যেখানে মাছ চাষ সেখানে

নদীর মধ্যে যেন ‘মিনি পুকুর’- বিশেষ দেশীয় পদ্ধতি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ জুলাই ২০১৬

নদীর মধ্যে যেন ‘মিনি পুকুর’- বিশেষ দেশীয় পদ্ধতি

সমুদ্র হক ॥ ‘জল আছে যেখানে, মাছ চাষ সেখানে’- প্রতিপাদ্যে মাছচাষীরা ব্যাপক উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। বাঙ্গালী নদীতে বিশেষ দেশীয় প্রযুক্তিতে মাছ চাষ শুরু করেছে অনেকেই। এ প্রযুক্তিটির এখনও নামকরণ হয়নি। জাল, বাঁশ, ড্রাম আর ইট দিয়ে নদীর মধ্যে খাঁচা বানিয়ে চাষ করা হয় মাছ। দেখে মনে হবে নদীর ভেতর মশারি টাঙানোর মতো জাল দিয়ে ঘিরে দেয়া একেকটি মিনি পুকুর, যা পর্যবেক্ষণের জন্য নদীর ভেতরে ড্রাম ভাসিয়ে ঘর বাননো হয়েছে। এ ধরনের প্রযুক্তি প্রথম শুরু হয় মাছের এলাকা চাঁদপুরে, যা দেখে বর্তমানে অনেক এলাকর মাছচাষী নদীতে মাছ চাষ করছে। বগুড়ার শেরপুর ও ধুনটের মধ্যবর্তী এলাকায় বাঙ্গালী নদী বর্ষায় ফুলেফেঁপে উঠেছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মাছ চাষ। নদী, খাল-বিল ও বড় জলাশয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে মাছ চাষ হয়। এতে মাছের আহরণ নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মাছ চাষের নজরদারি তেমন থাকে না। প্রকৃতি থেকে এবং সরকারী উদ্যোগে যে চাষ হয়, তাই যোগ হয় মাছের উৎপাদনের তালিকায়। এ অবস্থার আরও উন্নয়ন ঘটিয়ে চাঁদপুরের মাছচাষীরা নদীতে খাঁচা বানিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। বর্ষা মৌসুমে যখন নদীতে পানি থাকে এই ৩-৪ মাস এবং পরবর্তী সময়ে নদীতে পানি থাকা সাপেক্ষে বিশেষ পদ্ধতিতে মাছ চাষ হচ্ছে। বগুড়ার শেরপুরের রণবীর বালা গ্রামের দুই ভাই মিলন রহমান ও সোহেল রহমান চাঁদপুর থেকে জাল, ড্রাম, বাঁশ ও ইট পদ্ধতির মাছ চাষ দেখে নিজেরা পরীক্ষামূলকভাবে ছোট আকারে নদীতে চাষ শুরু করেন। সাধারণভাবে মাছ চাষের চেয়ে এ প্রযুক্তির চাষে সফল হন। তার পর শেরপুর ও ধুনটের মধ্যবর্তী এলাকায় বথুয়াবাড়িতে যেখানে বাঙ্গালীর স্র্রোত বেশি, সেখানে জাল-বাঁশ-ড্রাম প্রযুক্তি স্থাপন করেন। নদীর বেড লেভেলে বাঁশ ও ইট দিয়ে চৌকোনা একেকটি খাঁচা নদীর ভেতরে স্থাপন করা হয়। তার ওপর ড্রাম ভাসিয়ে খাঁচা ধরে রাখা হয়। দূর থেকে দেখে মনে হবে বিশাল আকারের মশারি নদীর ভেতরে টাঙানো হয়েছে। এ ধরনের প্রতিটি খাঁচার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ২০ ফুট বাই ১৫ ফুট (৩শ’ বর্গফুট)। গভীরতা বেড লেভেল পর্যন্ত। বেড লেভেলে না পৌঁছলে বিশেষ ব্যবস্থায় এ খাঁচা স্থাপিত হয়। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে সারিবদ্ধভাবে ৭-৮টি করে ৩৫টি খাঁচা বসানো হয়েছে। খাঁচার কাছাকাছি পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রাম ভাসিয়ে তার ওপর ছোট ঝুপড়িঘরও বানানো হয়েছে। মাছচাষী সোহেল রহমান বললেন, একটি খাঁচা বানাতে দুটি ড্রাম ও ছয়টি বাঁশ এবং কয়েকটি ইট দরকার হয়। খাঁচা জোড়া লাগানো হলে ড্রাম একটি কম লাগে। এর সঙ্গেই আঁটানো থাকে জাল। এ খাঁচার মধ্যে মাছের পোনা ছেড়ে দিয়ে নিয়মমতো মাছের খাবার দিতে হয়। বর্তমানে তেলাপিয়া, সরপুঁটি, কৈ, পাবদা মাছ চাষ হচ্ছে। বড় মাছ চাষের জন্য জালের পরিধি বাড়াতে হয়। প্রতিটি খাঁচা বানাতে খরচ হয় প্রায় সাত হাজার টাকা। বড় খাঁচা বানাতে খরচ পড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। নদীর ভেতরে এ প্রযুক্তির চাষে খাঁচা বেশি বড় করা যায় না। ছোট আকারে বানিয়ে খাঁচার সংখ্যা বাড়ালে ভালভাবে চাষ করা যায়। এভাবে মুক্ত জলাশয়ে মাছ বড় হওয়ার পর তা বেচাকেনা শুরু হয়। মিলন রহমান বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শখের বশে এ প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করেন। সফলতার পর দুই ভাই মিলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করছেন। বললেন, সরকারের মৎস্য বিভাগ এ প্রযুক্তির মাছ চাষে তাদের উৎসাহ ও সহযোগিতা দিচ্ছে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য এলাকার কৃষক এ প্রযুক্তিতে মাছ চাষে উৎসাহী হচ্ছে। মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, পুকুর-জলাশয় থেকে মাছ মেলে ৫৫ শতাংশ। নদী, খাল-বিল ও উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মেলে ২৮ শতাংশ। নদীর পানি কমে যাওয়ায় চর জেগে ওঠায় নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ যখন কমে যাচ্ছে, তখন দেশীয় নতুন এ প্রযুক্তি মাছ চাষে আশার সঞ্চার করেছে। কৃষকরা এভাবে মাছ চাষে এগিয়ে আসায় মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। বছর ছয়েক আগে বছরে মাছ খাওয়ার হার ছিল প্রতি জনে ১৪ কেজি করে। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ কেজি। এ হার স্বল্পোন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি, যা উন্নয়নশীল দেশের মাছ গ্রহণের সমান। মাছের উৎপাদনের সঙ্গে পুষ্টি চাহিদা মিটছে। বর্তমানে মাছ থেকে পুষ্টি মিলছে ৬০ শতাংশ। প্রতিদিন প্রতিজনের মাছের চাহিদা ৬০ গ্রাম। বছরে প্রায় ২২ কেজি। একই সূত্র জানায়, দেশে প্রতি বছর মাছের চাহিদা ৩৭ দশমিক ৬৫ লাখ টন। সেখানে বছরে মিলছে ৩৮ দশমিক ৮৪ লাখ টন। উদ্বৃত্ত মাছ রফতানি হচ্ছে। জাতিসংঘ ফুড এ্যান্ড এ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (এফএও) এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে সমুদ্র উপকূল থেকে মাছ আহরণ হয় ১৭ শতাংশ। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর মৎস্য বিভাগের একটি গবেষণা জাহাজ মৎস্য আহরণে কাজ শুরু করেছে। আশা করা হয়, সামুদ্রিক মাছের চাহিদাও আগামীতে মিলে রফতানি পর্যায়ে পৌঁছবে। এদিকে দেশ থেকে মিঠাপানির অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। নানা প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে মৎস্য বিভাগ হারিয়ে যাওয়া মাছগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
×