ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আর শোক মিছিল নয়

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৪ জুলাই ২০১৬

আর শোক মিছিল নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংস্কৃতি চর্চাই পারে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করতে। পরিবার-সমাজে সংস্কৃতি চর্চার ওপর সব থেকে বেশি জোর দিচ্ছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। ‘হলি আর্টিজান’ স্থায়ী ক্ষত তৈরি করেছে বাঙালীর মনে। জঙ্গীবাদের কালো থাবায় বিক্ষত হৃদয় নিয়ে প্রতিবাদে প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে মাঠে নামলেন দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা। শনিবার ছুটির বিকেলে বৃষ্টি উপেক্ষা করে শহীদ মিনার থেকে গুলশান পর্যন্ত গান কবিতার মিছিলে সাফ জনিয়ে দেয়া হলো ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানে পাওয়া এই বাংলা কোন জঙ্গী হত্যার লীলাভূমিতে পরিণত হবে না। প্রতিপ্রাণে সংস্কৃতির চেতনা জাগিয়ে তুলে বাঙালী ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যাওয়ার আহ্বান এসেছে অভিনব এই প্রতিবাদ থেকে। যে ঐতিহ্য শান্তি-সম্প্রীতির সঙ্গে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের বাংলাদেশ সেই চেতনাতে জাগ্রত করবে। বিকেল ৩টায় সংস্কৃতিকর্মীরা জঙ্গী হামলার প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হন শহীদ মিনারে। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তচিন্তার মানুষ যোগ দেন জঙ্গীবাদ রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে। মানবতা ও স্বদেশ ভাবনায় রুখে দাঁড়াও জঙ্গীবাদ এই সেøাগানে প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে গান কবিতার মিছিল ছোটে শহীদ মিনার থেকে গুলশান অভিমুখে। পদযাত্রা শেষে গুলশান ও শোলাকিয়ায় নিহতদের স্মরণে পুলিশ প্লাজা কনকর্ড শপিংমলের সামনে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। শনিবার সাত কিলোমিটারের পথ। সহস্রাধিক সংস্কৃতিকর্মী হেঁটে পাড়ি দেন জঙ্গী হামলার প্রতিবাদে। তাদের সঙ্গে হাতিয়ার ছিল গান আর কবিতা। যাতে উঠে আসছিল স্বদেশ প্রেমের কথা, মানবিক সমাজ গঠনের কথা। যা জাগ্রত করেছে সাধারণ মানুষকেও। এই জাগরণ হয়ে উঠবে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বলেই মনে করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধিতে সরকার উদ্যোগ নেবে বলেও আশা করা হচ্ছে। মিছিলের শুরুতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রতিবাদী স্বাগত বক্তব্যে দেশের সঙ্কট এবং সম্ভাবনায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের বাংলাদেশকে কখনও জঙ্গী হত্যার লীলাভূমিতে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। শুরুতে মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যার মাধ্যমে এর বিস্তৃতি ঘটায়। এখন শিক্ষক, সাহিত্যিক, মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউ এদের হাত থেকে আর নিরাপদ নয়। হাজার বছর ধরে আমরা অনেক আনন্দ বেদনাকে ভাগ করে নিয়েছি। আজও এই পরিস্থিতিতে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আজ আমাদের বাঙালী ঐতিহ্যর কাছে ফিরে যেতে হবে। বাঙালী ঐতিহ্য শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলে। এই ঐতিহ্য প্রমাণ করে সকল ধর্মবর্ণের মানুষের এই বাংলাদেশ। তিনি বলেন, রাষ্ট্র জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আমরা সংস্কৃতি চর্চার প্রসারের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলব। তিনি বলেন, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। মিছিলের শেষ প্রান্তের সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে গোলাম কুদ্দুছ হলি আর্টিজানের হামলায় নিহত বিদেশীদের প্রতি সম্মান জানান এবং তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। গান কবিতার মিছিলে সকলের কণ্ঠে ছিল জাগরণের গান, দেশের গান। আহ্বান ছিল জেগে ওঠার। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। গান কবিতার মিছিলের শুরুতে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি আবৃত্তি করেন আহকাম উল্লাহ। জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ এ সময় বলেন, রাজপথে আজ আমরা পায়ে পা মেলাবো, কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাবো। প্রতিবাদ জানাবো এই ঘৃণ্য হত্যাকা-ের। পাকিস্তানী নিপীড়নে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা গান কবিতা নিয়ে পাশে ছিলাম। আজও আমরা তাই নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাই। গুলশানের ক্ষত না শুকাতে ফ্রান্সের নিস যখন কাঁদছে তখনই আবার আক্রান্ত জার্মানীর মিউনিখ। মিউনিখের ক্ষতর পাশেই শনিবার যোগ হলো কাবুল। সেখানেও প্রাণ গেল ৬১ জনের। সঙ্গে ২০৭ জন আহত। দায় স্বীকার করল আইএস। বিশ্বব্যাপী এই সন্ত্রাসবাদে বাংলাদেশী শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণ ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। দেশে জঙ্গীবাদী তৎপরতায় সংস্কৃতিকর্মীদের এই প্রতিবাদী মিছিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ অংশ নেন। জোটের সংস্কৃতিকর্মীরা ছাড়া এসেছিলেন মহিলা পরিষদের নারী নেত্রীরা। তেমনি অনেকেই প্রাণের টানে ছুটে এসেছিলেন। শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ মোড়, বাংলামটর, কাওরানবাজার, এফডিসির মোড়, হাতিরঝিল হয়ে গুলশানে এক নম্বরের পুলিশ প্লাজা কনকর্ড শপিংমলের সামনে গিয়ে শেষ হয় গান কবিতার মিছিল। মিছিলের শেষ প্রান্তের সমাবেশে কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর জঙ্গীবাদবিরোধী তার নিজের লেখা একটা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। হলি আর্টিজানে নিহত অন্তঃসত্ত্বা নারীর অনাগত সন্তানকে নিবেদন করে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। বাউলশিল্পীদের কণ্ঠে ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান’ গানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশ। ‘যখন তোমার ভাঙ্গবে ঘুম’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর নৃত্যশিল্পীরা। এ সময় মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে গুলশান এবং শোলাকিয়ায় নিহতদের স্মরণ করা হয়। এর আগে সাত কিলোমিটার পথজুড়ে মাইকে বাজতে থাকা ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’, ‘ভেবো না গো মা, তোমার ছেলেরা’, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না’সহ স্বদেশপ্রেমের বিভিন্ন গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে থাকেন মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক গান কবিতার মিছিলে যোগ দিতে এসে জানালেন, সরকারকে জাতীয়ভাবে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল সাংস্কৃতি চর্চাই পারে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করতে। আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজকে সারাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চা হোক। শিক্ষার্থীরা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে উঠলে জঙ্গীবাদ রোধ হবে। নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, আমরা শোকের মিছিল করতে চাই না। আমরা আনন্দের জয়ধ্বনি গাইতে চাই। আজকে যারা জঙ্গী হচ্ছে তারা বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা করে না। আমরা চাই সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চা করা হোক। সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার সঙ্গে যুক্তরা ইংরেজী মাধ্যম ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এরা বাঙালী সংস্কৃতির আদলে বড় হয়নি। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি চর্চা বেগমান করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সংস্কৃতির পুনঃজাগরণ তৈরি করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের স্থান নেই। ত্রিশ লক্ষ শহীদের বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ঠাঁই নাই। এ সময় তিনি সম্প্রতি জঙ্গী হামলায় যারা জীবন দিয়েছেন তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে মানবিক সমাজ গঠনের সময় এসেছে এখন। নাট্যব্যক্তিত্ব ম হামিদ বলেন, দেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। যার দুটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস-সংস্কৃতির ছোঁয়া নেই। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। সব ধারাকে একসঙ্গে করতে হবে। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মোঃ সামাদ, ঝুনা চৌধুরী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখি দাস পুরু কায়স্থ প্রমুখ।
×