ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ

পানিবন্দী ৪ লাখ ॥ ৬ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৪ জুলাই ২০১৬

পানিবন্দী ৪ লাখ ॥ ৬ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শনিবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। নতুন নতুন এলাকা হয়েছে প্লাবিত। দেশের ৬টি জেলার প্রায় ৬৫টি ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে। বন্যার্ত এলাকাগুলোতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের সঙ্কট বেড়েই চলেছে। শুধু কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলাতেই বন্যার্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওই সব এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সাময়িক বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্ষতি হয়েছে পাট, পটল ও রোপা আমনের বীজতলার। পদ্মায় প্রচ- স্রোত আর উত্তাল ঢেউয়ের কারণে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে ফেরি চলাচল সীমিত করা হয়েছে। ১৬টি ফেরির মধ্যে ৪টি ফেরি বন্ধ রয়েছে। ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। শনিবারও রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় মাঝারি থেকে ভারিবর্ষণ হয়। আর বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যসমূহে ভারিবর্ষণ ও বন্যা অব্যাহত রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে বেশ সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শনিবারের ভারিবর্ষণে দুর্ভোগে পড়ে রাজধানীবাসী। নগরীর অনেক এলাকায় সৃষ্টি হয় সাময়িক জলাবদ্ধতা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন শনিবার সন্ধ্যায় জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদীসংলগ্ন কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও বগুড়া জেলাসমূহের নিম্নাঞ্চলের কিছু অংশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীসমূহের পানি হ্রাস অব্যাহত থাকতে পারে। পর্যবেক্ষণাধীন ৯০টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে শুক্রবার ৫৭টির বৃদ্ধি এবং ২৯টি স্টেশনের পানি হ্রাস পায়। আর বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ৮টি নদীর পানি। আগামী ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদী বাঘাবাড়িতে ও পদ্মা নদী গোয়ালন্দে তাদের নিজ নিজ বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। শনিবার ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫২ সেমি, যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২১ সেমি ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ১৬ সেমি, এলাসিনে ধলেশ্বরীর পানি ৫০ সেমি, পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে ২০ সেমি, সুরমার পানি সুনামগঞ্জে ৬৫ সেমি এবং জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে কংস নদীর পানি বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫০ ও ধরলার পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়েছে দুধকুমার, তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিও। ফলে কুড়িগ্রামে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়ী উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। গত ৬ দিন ধরে এসব মানুষ পানিবন্দী থাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। রাস্তাঘাট তলিয়ে থাকায় ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে প্রায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বন্যাদুর্গত এলাকার অনেক পরিবার গবাদিপশু নিয়ে উঁচু বাঁধ ও পাকা সড়কে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। এসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত নানান রোগ। কুড়িগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আকতার হোসেন আজাদ জানান, বন্যার্তদের জন্য ৫ লাখ টাকার শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে। এছাড়া আরও ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ৯৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন করে আরও ২শ’ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে। স্টাফ রিপোর্টার মুন্সীগঞ্জ থেকে জানান, পদ্মায় প্রচ- স্রোত আর উত্তাল ঢেউয়ের কারণে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে ফেরি চলাচল সীমিত করা হয়েছে। ১৬টি ফেরির মধ্যে ৪টি ফেরি বন্ধ রয়েছে। ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ম্যানেজার (বাণিজ্য) মোঃ গিয়াস উদ্দিন পাটোয়ারী জানান, পদ্মায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে প্রচুর স্রোত। তাছাড়া শনিবার কিছুটা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকায় নদীতে দেখা দেয় বড় বড় আকারের ঢেউ। এ রকম ঢেউ আর স্রোতের প্রতিকূলে মান্ধাতা আমলের ফেরির ইঞ্জিনগুলো প্রতিযোগিতায় কুলাতে পারছিল না। ফেরি ছাড়লেই স্রোতের টানে ফেরিগুলো নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে অন্যদিকে চলে যায়। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরিগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট ফেরি কর্ণফুলীকেও বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকাল তিনটি রো রো ফেরি, ৪টি কে টাইপ ফেরি, ৪টি প্ল্যাট ফেরি ও ফরিদপুর নামের একটি ফেরিসহ মোট ১২টি ফেরি চলাচল করেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা গাইবান্ধা থেকে জানান, অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, করতোয়, ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি শনিবারও অব্যাহত ছিল। শুধু ব্রহ্মপুত্র নদীতেই গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭ সেমি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী ২২টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবারের ২ লাখ ৪০ হাজার বন্যাকবলিত মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ক্রমাগত বৃষ্টি আর বন্যার পানিতে দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতাও বেড়েছে। এছাড়া বন্যায় পাট, পটল, রোপা আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া অফিস থেকে জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনটে যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ও বৃষ্টিতে প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। বেড়েছে স্রোতের তীব্রতা। সারিয়াকান্দিতে বাঁধের ভেতরে ও চর গ্রামের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে নৌকায় করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। উঁচু স্থানে গড়ে ওঠা স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে। বন্যার্তদের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, তিস্তা নদীর বন্যা ও ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় শনিবার টেপাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চরখড়িবাড়ী গ্রামের আরও ৯৬টি পবিারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে। তারা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া উজানের ঢলে জেলার ডিমলা উপজেলার এক হাজারের বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। তিস্তার ডালিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য একটি তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা তথ্য কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করছেন ডিমলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিল্টন চন্দ্র রায়। এ পর্যন্ত তিস্তার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বসতভিটা হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে ৪৫০টি পরিবার। শনিবার দুপুরে জেলা ছাত্রলীগের পক্ষে তিস্তার বাঁধে আশ্রিত পরিবারের চার হাজার সদস্যদের মাঝে তৈরি খাবার বিতরণ করা হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজল কুমার ভৌমিক জানান, তৈরি খাবারের মধ্যে রয়েছে খিচুরি ও পানির বোতল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি আসাদুজ্জামান সরকার রতন, সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা, ডিমলা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সায়েম, সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন স্বাধীন, ইসলামিয়া কলেজ শাখার সভাপতি আব্দুর রশিদ লেবু, সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ইরফান আহম্মেদ মিঠু। নিজস্ব সংবাদদাতা লালমনিরহাট থেকে জানান, ধরলা নদীর তীব্র ভাঙ্গনে অর্ধশতাধিক পরিবার গৃহহারা হয়েছে। ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ঘাটিয়াল আবুল কাশেমের ১৮ বিঘা কৃষিজমি ও বসতভিটা চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সাবেক ইউপি মেম্বার মোঃ মজিবর রহমান (৬৫) জানান, কর্ণপুরে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় তিন শ’ বিঘা ফসলের জমি, সুপারির বাগান, বাঁশঝাড়, কলার বাগান, সবজি বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।
×