ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ২৪ জুলাই ২০১৬

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই’- নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রজন্মকে আলোড়িত করবে। বলিভিয়ায় চেগুয়েভারাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। চে কিংবা তাহেরের মৃত্যুহীন লাশই আমাদের তরুণদের স্বপ্ন দেখায়, পথ বাতলে দেয় আগামী সমতার পৃথিবীর। সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে জাসদের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি কোনভাবেই। বরং পৃথিবীজুড়ে অন্যায়, অবিচার, আধিপত্যের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের যে ঢেউ ও দোলাচল আমরা লক্ষ্য করছি, যা থেকে বাংলাদেশও বাইরে নয়– সেই প্রেক্ষাপটে জাসদের বিপ্লব ও সংগ্রামের সমৃদ্ধ ইতিহাস বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে হবে। তারা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবে, স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর একদল একনিষ্ঠ বিপ্লবী কি প্রবলভাবেই না মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে সংগ্রামী ইতিহাস রচনা করেছেন। অকাতরে জীবন দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও সমাজ বদলে জাসদের বিপ্লবী প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু যে সমৃদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস তারা রচনা করেছেন, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের বাস্তবতায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার লড়াইয়ে শামিল করা জাসদের পোড় খাওয়া সংগ্রামী এবং আপোসহীন নেতা ও সংগঠকদের এক ঐতিহাসিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দায়িত্ব পালনে তাঁরা কতটুকু সমর্থ হবেন, মুখ্যত তার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের কাছে ভবিষ্যতের বিপ্লবী আন্দোলন ও সংগ্রামের সম্ভাবনা। বর্তমান এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় রকমের শূন্যতা বিরাজ করছে। রাজনীতি মুখ্যত ডান বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়েত এবং জাতীয় পার্টি এই বলয়ের রাজনৈতিক দল। এসব দলের মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকাংশে ধারণ করে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি : গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে মুখ্যত এই দল। তবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রধানত প্রত্যাবর্তন করলেও দুটি মূলনীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র থেকে আওয়ামী লীগ চেতনাগতভাবে ও কার্যত সরে এসেছে। ডান বলয়ের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সমাজের ধনবান শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেও সমাজের মূল উৎপাদক শ্রেণী ও বিত্তহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নানা সংস্কারমূলক কর্মসূচী নিয়ে থাকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিদেশী ঋণনির্ভর না হয়ে স্বয়ংভর জাতীয় অর্থনীতি বিকাশে শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের সুফল বাংলাদেশ ও তার বিশাল জনগোষ্ঠী পাচ্ছে। তারপরও সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডান বলয়ের বাকি তিনটি দল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। সংবিধানের চার মূলনীতির কোনটিই তারা বিশ্বাস করে না। দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি এদের কোন আনুগত্য নেই। এই তিনটি দলের নষ্ট অতীত এবং সামরিক স্বৈরশাসন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের প্রবল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের চেতনার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের কারণে তারা আজ ক্ষয়িষ্ণু ও বিলীয়মান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর এবং জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে জামায়াত এখন দৌড়ের ওপর আছে। জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য অটুট রাখতে বেগম খালেদা জিয়া-তারেক জিয়ার নীতিগত অবস্থান ও জঙ্গী ঘাতকদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র বিএনপিকে অতি দ্রুত একটি অকার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। এই দুজনকে নেতৃত্বে রেখে বিএনপির পক্ষে রাজনীতির মাঠ পুনর্দখল সম্ভব হবে না। বিকল্প কোন নেতাও এই দলে দৃশ্যমান নেই। রাজনীতিতে ক্লাউন হিসেবে পরিচিত জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি দ্রুত ভাঙ্গনের মুখে। এরশাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিও বিলীন হয়ে যাবে। বাম বা মধ্য বাম বলয়ে রাজনৈতিক শক্তি শতধাবিভক্ত ও এই মুহূর্তে খুবই দুর্বল। সমাজের উৎপাদক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দল হিসেবে তারা আবির্ভূত হতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় বাম মোর্চা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও গত দু’বছরে এই মোর্চার সম্ভাবনাময় দুটি দল, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি এখনও জনমনে তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি। আরও পরিতাপের কথা গত ১১ মার্চ, ২০১৬ তারিখে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাসদের বিশাল জাতীয় কাউন্সিলের বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জাসদের নবউত্থানের যে আশা জাগিয়ে ছিল, পরদিন কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ লগ্নে সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে মতভিন্নতার অজুহাতে কয়েক নেতার দল ত্যাগ সাময়িকভাবে হলেও তাতে নিরাশারই জন্ম দিয়েছে। এই মোর্চার বাইরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ক্রমাগত তাদের ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে আরও ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়েছে। জনমনে তাদের প্রতি আস্থা এখন আর তেমন অবশিষ্ট নেই। সব মিলিয়ে রাজনীতির পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে কার্যত কোন বিরোধী দল নেই। আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগের জন্য এখন খুবই সুসময়। দূর ও নিকট অতীতে জামায়াত-বিএনপি ও ইসলাম নামধারী জঙ্গীদের জ্বালাও-পোড়াও-হত্যা ও সম্পদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে শেখ হাসিনার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের এমন একক সবল অবস্থান দেশের উন্নয়নের জন্য কাম্য বলে বিবেচিতও হতে পারে। বাস্তবেও তার ইতিবাচক ফল স্পষ্ট দৃশ্যমান। বিএনপি-জামায়াত ও এরশাদের দীর্ঘ অপশাসনে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ সবই ভাল ও ইতিবাচক। প্রশ্ন হচ্ছে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থবহভাবে ধারণ করে ও সংবিধানের চার মূলনীতি বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত থাকে এমন বিকল্প রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে বর্তমানের দৃশ্যমান সুসময় কতদিন বিরাজ করবে? তেমন রাজনৈতিক শক্তি কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত না হলে কি পরিণতি হতে পারে দেশের? তেমন অবস্থায় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ করবে কোন শক্তি? গুলশানের কূটনীতিকপাড়ায় হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় এবং ঈদের দিনে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম জামায়াতে ইসলামের নামে জঙ্গী আক্রমণ এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিরপরাধ মানুষ হত্যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র কত গভীর ও ভয়াবহ। এই সঙ্কটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থা আছে এমন সব শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ রচনা খুবই জরুরী। ১৪ দল সেই আহ্বানটি রাখছে। এখন এবং সামনের দিনগুলোতে দেশব্যাপী ১৪ দলীয় প্রতিরোধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হবে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি। সাম্প্রতিক ভাঙ্গনের ফলে সাংগঠনিক না হলেও ভাবমূর্তিগত বিপর্যয়ে পড়েছে জাসদ। তার পরও আমার বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন মধ্য বাম রাজনৈতিক দলের মধ্যে একমাত্র জাসদের পক্ষেই সম্ভব কার্যকর বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার। কারণ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে এই শক্তির অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে জাসদের অনমনীয় সাহস, দৃঢ়তা ও নেতাকর্মীদের অকাতরে জীবনদানের দৃষ্টান্ত, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা, প্রতিবিপ্লবের মুখে পরাজয়ের অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সময়ে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতাদের পথভ্রষ্টতার ফলে নানা বিভক্তির পরও জাসদের মূল ধারাটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ, আওয়ামী লীগ ও বাম রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক স্বৈরশাসন ও বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গীদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনে নিয়োজিত থাকা– এসব বিরল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জাসদ। অতীতে এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং এখনও বেঁচে আছেন এমন অসংখ্য রাজনীতি-সচেতন মানুষ সারাদেশে ছড়িয়ে আছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন বেগবান সংগ্রামে, বিশেষ করে ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন ও শাহবাগে জাতীয় পুনর্জাগরণে শামিল হওয়া তরুণ প্রজন্ম যারা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে তেমন একটি দলের জন্য, তাদের প্রত্যাশা পূরণে অন্যতম রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাহের ও অযুত সাথিরা যে লক্ষ্য ও ভরসা নিয়ে জাসদে যোগ দিয়েছিলেন এবং অকাতরে জীবনপাত করেছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে তেমন এক জাসদ আবির্ভূত হোক বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত সঙ্কট মোকাবেলা করে সত্যিকারের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে। ৪০তম ‘তাহের দিবসে’ জাসদের বিপ্লবী নেতা কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের প্রতি এভাবেই আমরা সম্মান দেখাতে পারি। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
×