ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে ফিরে আসতে চায়!

ছিটের নতুন ভারতীয়দের স্বপ্নভঙ্গ

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৪ জুলাই ২০১৬

ছিটের নতুন ভারতীয়দের স্বপ্নভঙ্গ

এ রহমান মুকুল, হলদিবাড়ি (ভারত) থেকে ফিরে ॥ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে চলে যাওয়া বাসিন্দাদের অনেকে ফিরে আসতে চান বাংলাদেশে। ফ্ল্যাট বাড়ি আর নগদ এক লাখ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিটের বাসিন্দাদের ভারতে নিয়ে গেলেও কয়েক মাসেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে অনেকেই এখন বাংলাদেশে ফিরতে চাইছেন। নিজ জন্মস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ায় আফসোস আর হতাশার মধ্যে একপ্রকার মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এরই মধ্যে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ছিটের তিন বাসিন্দা চোরা পথে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার ৩টি স্থানে অস্থায়ী ক্যাম্পে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসকারী নতুন ভারতীয়দের এখন পর্যন্ত স্থায়ীভাবে কোন পুনর্বাসনসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি ভারত সরকার। পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিরা বেকার ও অলস জীবন যাপন করছেন। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে ভারতে চলে যাওয়া ক্যাম্পে বসবাসকারী বাসিন্দাদের কাছ থেকে তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা ও নানা অভিযোগ শোনা গেছে। জানা যায়, গত বছরের নবেম্বরে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দীর্ঘ ৬৯ বছর দু’দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিটমহলের নাগরিকত্বহীন বাসিন্দারা নিজ দেশে পরিচয়ের সঙ্গে নাগরিকত্ব পান। ভারতীয় সরকার কর্তৃক স্থাপনকৃত সব ক্যাম্পেরই খুব করুণ অবস্থা। ছোট টিনের ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে নতুন ভারতীয় নাগরিকদের। কথা হয় হলদিবাড়ি ক্যাম্পে অবস্থানকারী শরৎ রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে ফ্ল্যাট বাড়ি, টাকা ও নানা প্রলোভনে এখানে এসে কি ভুলটাই না করেছি। সেখানে (বাংলাদেশে) ছিটমহলে যা জমি ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছি। এখানে (ভারতে) কোন কাজ এখন পর্যন্ত পাইনি। জমানো টাকা ভাঙ্গিয়ে চলতে হচ্ছে। এখানে যা খেতে দেয়া হয় তা খাওয়ার অযোগ্য। কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন শরৎ। তিনি বলেন, আমার এক ভাই ও দুই আত্মীয় এত অবর্ণনীয় কষ্টে টিকতে না পেরে ইতোমধ্যে চোরাপথে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। আমারও মন টিকছে না। হয়ত আমিও বাংলাদেশে ফিরে যাব। ওই ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা গণেশ রায় বলেন, এখানে আসার প্রায় ৮ মাস চলে গেলেও স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা হলো না। কর্মসংস্থানেরও সুযোগ নেই। ছিটের বাসিন্দা হলেও বাংলাদেশেই ভাল ছিলাম। এই ক্যাম্পের অধিকাংশ বাসিন্দাই দুষছেন পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহল নাজিরগঞ্জের জয় প্রকাশকে। জয়প্রকাশও পরিবার নিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। এই জয়প্রকাশ ফ্ল্যাটবাড়ি, এক লাখ টাকা, ভাল চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পঞ্চগড়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত কয়েকটি ছিটের বাসিন্দাকে সঙ্গে নিয়ে যান। তার পরিবার হলদিবাড়ি ক্যাম্পে থাকলেও জনরোষের ভয়ে জয়প্রকাশ শিলিগুড়িতে অবস্থান করছে। শুধু হলদিবাড়ি ক্যাম্পই নয়, অন্য ক্যাম্পের বাসিন্দাদের একই অভিযোগ। বছর ঘুরতে চললেও ভারত সরকারের কোন প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে, অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইছে। এদিকে, নতুন ভারতীয়দের বাংলাদেশে ফিরে আসার খবরে নড়েচড়ে বসেছে ভারত সরকার। কেন এমন পরিস্থিতি হলো তা জানতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে হঠাৎ করেই কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হলো এবং কেনইবা ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ছিটের বাসিন্দারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান তা কেন্দ্র সরকারের জানা প্রয়োজন। ভারতীয় ছিটমহল নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত ভারতীয় ক্যাম্পে অবস্থানকারী বাসিন্দাদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ক্যাম্পে যাঁরা রয়েছেন তাদের আর্থিক সমীক্ষা জরুরী ছিল। এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। তবে ক্যাম্পে অবস্থানকারী বাসিন্দাদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
×