ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নির্যাতন মামলা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তার হাতিয়ার!

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২৩ জুলাই ২০১৬

নারী নির্যাতন মামলা প্রতিপক্ষকে  শায়েস্তার হাতিয়ার!

আরাফাত মুন্না ॥ এইচএসসি পাসের পর রুজিনার (ছদ্মনাম) মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেমিকের সঙ্গে। পুলিশের সহায়তায় রুজিনা বাবার বাসায় ফিরলেও কোনভাবেই শ্বশুরবাড়ি পাঠানো যায়নি তাকে। মাস তিনেক পর পরিস্থিতি বুঝে রুজিনার স্বামী তালাকনামা পাঠালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবার রুজিনার পরিবার জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বসে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে এমন অসংখ্য মামলাই রয়েছে। নারী এবং শিশুদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণীত হলেও বর্তমানে এটি প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। খোদ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং বিভিন্ন মামলায় আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণ থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আদালতে গত ছয়মাসের পর্যবেক্ষণ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী বলছেন, এ আইনে এখন নির্যাতনের চেয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা বেশি করা হচ্ছে। আর সেটা করা হচ্ছে বিচ্ছেদ পাওয়ার কৌশল হিসেবেও। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের জন্য ঢাকার পাঁচটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন মামলার পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনটি প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে স্বামীকে বশে রাখা, বিনা কারণে তালাকের পর দেনমোহর আদায়, পরকীয়াজনিত কারণ, রাগী শ্বশুর-শাশুড়িকে শায়েস্তা, প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে উদ্ধার, এমনকি জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলাতেও এ আইনে মামলা করে প্রতিপক্ষকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। কারণ, এ মামলায় আসামি জামিন পান না। অন্যদিকে আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে মিথ্যা মামলা করে পার পেয়ে যাচ্ছেন বাদী। আর ভুক্তভোগী হন তথাকথিত ‘আসামিরা’। আইনজীবীরা বলছেন, প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ, তারপর মুক্তিপণ আদায়, বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা থেকে প্রতারণার অভিযোগ এনে মামলা বেশি হচ্ছে। এর সঙ্গে সামান্য পরিমাণ যৌতুককে মেশানো গেলে তো কথাই নেই। নারী-শিশু নির্যাতন মামলা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ একাধিক মামলা করে। দোষ থাকলেও করে না থাকলেও করে এবং অনেকক্ষেত্রে আইনজীবীরাই এসব মামলা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, জানুয়ারি ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর আওতায় ২ হাজার ৯৫টি মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৩শ’ ৭৪টি। নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আসামি ছিলেন ৪শ’ ১০জন। সাজা ২৭ জন পেলেও ৩৮০জনই খালাস পেয়ে যান। এরমধ্যে প্রতারণা এবং ধর্ষণ মামলা বেশি। যেসব মানবাধিকার সংগঠনে এসব মামলা পরিচালনার জন্য প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা হাজির হন তারা বলছেন, নারীদের জন্য আইনী সহায়তা কেন্দ্র থাকলেও পুরুষরা সহায়তা নিতে পারছেন কম। নারীদের সহায়তা কেন্দ্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দাম্পত্য সম্পর্কে প্রতারণা মামলার পাটাতন হিসেবে যে কারণগুলো সামনে আসছে তা হলো, স্বামীকে বাগে রাখা, দেনমোহর আদায়, পরকীয়া প্রকাশ পাওয়ায় পর সংসার টিকিয়ে রাখার কৌশল, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের শায়েস্তা করা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা বেশি আকারে শুরু হয়েছে ২০১১ সালের দিক থেকে। ২০১৩ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, নারী নির্যাতন মামলার ৮০ শতাংশই মিথ্যা মামলা। অথচ এসব মিথ্যা মামলার বিচারে অনেক সময় চলে যায়। মামলা দীর্ঘ সময় ধরে চললে বিচার পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয় পড়ে। মানবাধিকার নেত্রীরা বলছেন, পরস্পরের সম্পর্কে অসহিষ্ণুতার কারণে মামলা এখনও সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে এবং ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান বলেন, বাদী-বিবাদী প্রায় সময়ই মামলায় কোনটা বলবেন বা বলবেন না অপ্রাসঙ্গিক নানা তথ্য দিয়ে মামলাকে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। ঘটনা যা সেটা দিয়েই মামলা দায়ের করা উচিত। আর এই পরামর্শ আইনজীবীকেই দিতে হবে। তিনি বলেন, একজন মেয়ে কখন মামলা করতে আসেন, যখন তার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তাই যে কোনভাবেই হোক না কেন আমরা আইনী সহায়তা প্রদান করতে চেষ্টা করি, যাতে ভুক্তভোগী নারীকে কিছুটা সহায়তা করা যায়। কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটও আছে, যেখানে নারীর পরিবারই আগে পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা আপোসযোগ্য নয়। কিন্তু হামেশাই আমরা আপোস হচ্ছে দেখছি, কখনও কখনও নিজেরাও জড়িয়ে পড়ি। যে কোন কারণেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ হতে পারে। সব ক্ষেত্রেই মামলা করতে হবে, এটা ঠিক না। আইনজীবী শাহিদুর রহমান বলেন, মামলার বাইরে সামাজিক ও পারিবারিক সহায়তায় কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের এখানে বেশিরভাগ বিচ্ছেদের পর কাবিনের টাকা না দেয়ার জন্য মেয়ের ও তার পরিবারের নামে চুরির মামলা দেয়ার যে রেয়াজ তৈরি হয়েছে সেটা দুঃখজনক। আর প্রতারণা মামলায় কেবল হেনস্থা করার উদ্দেশে যা হচ্ছে, সেটাও অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত।
×