এমনিতে টুপুরের কোন সমস্যা ছিল না লোকটাকে নিয়ে। পাশের বাড়িতে থাকে, লাঠি নিয়ে টুকটুক করে ঘুরে বেড়ায় আর মাঝে-মাঝে হো হো করে হাসে।
- কিন্তু লোকটা যে কাগজ খায়! হাত নাড়িয়ে বলে টুপুর। চাপা একটা হাসি হাসে বাবা।
- কিছু বলছ না যে? বলে মা। বাবাকে।
- কি বলব? ছোট মানুষ। বাবা হাতের ঝাপটায় মাকেসহ টুপুরের কথাটা উড়িয়ে দেয় যেন।
- তাই বলে ঐ বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে...
- তো কি হয়েছে তাতে? এমনিতেই ও বুঝতে পারবে। মানুষ কি আর কাগজ খায় নাকি? মা চলে যায় রান্নাঘরে। বাবা বসে থাকে হাতে খবরের কাগজটা নিয়ে।
সত্যিই তো! মানুষ কি আর কাগজ খায়? বাবার কথাটা বিড়বিড় করে একবার আওড়ালো টুপুর। তাহলে ওর বাড়ির কাজের খাতাটা কোথায় চলে গেল? সেই যে সেদিন ও পড়ছিল বসে জানলার ধারে। এমন সময় হঠাৎ একটা চকচকে টাকমাথার মানুষ এসে ডাকল ওকে
- শুনছ?
- হুমম।
- মুড়ি হবে?
- হবে। বলে রান্নাঘরে গিয়েছিল টুপুর। মুড়ির কৌটো আনতে। তারপরেই হঠাৎ খাতাটা নেই হয়ে গেল! নেই তো নেই! খাটে নেই, টেবিলে নেই, মেঝেতেও নেই!
- তুই বুঝলি কি করে খাতাটা ঐ লোকটাই নিয়েছে? শিবলী জানতে চেয়েছিল।
- নিয়েছে না, খেয়েছে।
- হুমম! কিন্তু সেটা বুঝলি কি করে?
- ওর পেটটা যে ফুলে ছিল! আমি বেশ দেখেছি।
- তুই চিনিস ওকে?
- হুমম! আমার বাড়ির পাশের বাড়িতে থাকে। কিন্তু কথা হয়নি। সেদিনই ডাকল আমাকে। মুড়ি খেতে চাইল।
- না দিলেই পারতিস। গম্ভীর মুখে বলে শিবলী।
- পারিনিই তো। ও নিয়েছে নাকি মুড়ি। ও তো এসেছিল কাগজ খেতে। খেয়ে নিয়েই চলে গেছে। মা এমনিতেই সকাল থেকে আমাকে খুব বকছিল বাড়ির কাজ করিনি বলে। এরপর...
- খালাম্মা বিশ্বাস করেনি তাই না? বলেছে তুই বাড়ির কাজ না করার জন্যে খাতা হারিয়েছিস। তাই না?
- বলেছেই তো। আরো বলেছে আমি নাকি ফাঁকিবাজ!
- আমার মাও বলে।
- তুই তো ফাঁকিবাজই! বলে এত কষ্টের ভেতরেও হাসে টুপুর।
- ফাঁকিবাজ আমি? তোর সঙ্গে আড়ি। বলে কাটি দিয়ে চলে যায় শিবলী টুপুরের সঙ্গে।
তবে সেটা খালি তখনকার জন্যেই। বিকেলে টুপুরদের বাসায় চলে আসে শিবলী।
- চল!
- কোথায়?
- বুড়োমানুষটার বাড়িতে। দু’জনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িটায় পৌঁছোয় ওরা। ছোট্ট একটা বাড়ি। প্লাস্টিক দিয়ে বানানো। ছোট্ট একটা দরজাও রয়েছে। সামনে একটা তার ঝোলানো। তারে লুঙ্গি টাঙিয়ে রাখা। আনেক ভাবনা-চিন্তা শেষে ডাকল ওরা দু’জন।
- এই যে! এই যে! দাদু! আরো হয়তো ডাকতো। কিন্তু মাঝপথে গলার কথাগুলোকে গিলে নিল ওরা। ঘরটা কাঁপছে।
- বলো! ঘরের প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে কি করে যেন একটা জানলা খুলে গেল। ছোট্ট একটা জানলা।
- বাইরে এসো! কথা বলব। বলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল টুপুর।
- আমি কথা বলি না।
- এই তো বলছ! বলল শিবলী। আর সেটা শুনে বোকার মতন খানিকটা হাসল লোকটা। তবে ওটুকুই। বের আর হলো না সে তার বাড়ি থেকে। বাড়ির ভেতরে বসে কেবল বিড়বিড় করতে থাকল।
- কি বলছ তুমি? চেঁচালো টুপুর। আমার খাতাটা খেয়ে নিলে কেন?
- বারে! ওটার জন্যেই তো মা বকছিল তোমাকে। তোমার কত উপকার করলাম। আর তুমি বকছ আমাকে? বলল লোকটা।
- কিন্তু মাতো আবার নতুন একটা খাতা নিয়ে এসেছে। দুপুরবেলায়!
- তাই! কি সর্বনাশ! কোথা থেকে নিয়ে আসে অমন বিচ্ছিরি খাতাগুলো বল তো!
- ওমা! তাও জানো না? স্টেশনারির দোকান থেকে। ঐ যে গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে দোকানটা। ওটা থেকে।
- আচ্ছা! বলে কি সব ভাবতে ভাবতে বাড়ির জানালাটা লাগিয়ে দিল লোকটা। আর খুললো না। আরও খানিকটা সময় তাই দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলো ওরা নিজেদের বাসায়। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে যে!
এরপর আর কোনদিন টুপুরের সঙ্গে দেখা হয়নি লোকটার। ওর কোন খাতাও খায়নি সে। কিন্তু হঠাত্ তাও একদিন কথাটা বলল বাবা।
- জানো! পাশের ঝুপড়ির ঐ বুড়োমতন লোকটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ও নাকি কাগজ চুরি করছিল গলির ঐ স্টেশনারি দোকানটা থেকে।
- চোর ছিল তাহলে? বলল মা।
- হুমম! তাই তো দেখছি। বাবা-মা কথা বলে যেতে থাকল।
শুধু টুপুরই চুপটি করে একটু হেসে নিল। ও তো জানে লোকটা কগজ চুরি করে না। খায়!
অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: