ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বকুলতলায় বর্ষাবন্দনা

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি আমার নি কেউ আসে রে...

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৩ জুলাই ২০১৬

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি আমার নি  কেউ আসে রে...

মোরসালিন মিজান ॥ ষড় ঋতুর দেশ। দু’মাস পর পর বদলে যায় প্রকৃতি। সেই ধারাবাহিকতায় এখন বর্ষা। আর বর্ষা মানেই স্বতন্ত্র আবেগ। বাঙালী এই আবেগে ভাসে। ভেসে বেড়ায়। এবারও আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকে প্রকৃতিতে বর্ষার সুর বাজছে। আর এখন শ্রাবণ। পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে বর্ষা। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী ঠিক তখনই আয়োজন করলো উৎসবের। বর্ণাঢ্য আয়োজনে প্রিয় ঋতুর বন্দনা হলো দিনভর। সঙ্গীত নৃত্য কবিতায় মুখর চারুকলার বকুলতলা স্মরণ করিয়ে দিল কোন বাধা, অন্ধকারের কোন শক্তি বাঙালীত্বের চর্চা রুখতে পারবে না। বরং কুসুম কোমল মনের ভাব আর বর্ষা যেন মিলে মিশে একার হয়ে গিয়েছিল। বর্ষা উৎসবের শুরু হয় সকাল ৭টার কিছু পরে। তারও আগে থেকে চলছিল প্রস্তুতি। আড়মোর ভেঙে জেগে ওঠছিল সবুজ। বর্ষণসিক্ত নরম মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল ঝরা বকুল। বাতাসেও ফুলের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ অনুসরণ করলেই উৎসব মঞ্চ! এবার মঞ্চ অতো খোলামেলা ছিল না। তবে সাজানো হয়েছিল বর্ষার রঙেই। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভঙিমায় আয়োজক গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বললেন, শুভ সকাল। জানালেন, প্রতিবছর বর্ষার প্রথম দিন বর্ষা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এবার আয়োজনটি করা হলো শ্রাবণ মেঘের দিনে। বাঙালীর প্রকৃতিপ্রেম উৎসব প্রেমের জয় ঘোষণা করেন তরুণ সংগঠক। বলেন, আমরা বৃষ্টি চাই। বৃষ্টির ছন্দে হারাই। গুলশান ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আকাশে যে কালো মেঘ হঠাৎ দেখা যাচ্ছে, আমরা তা চাই না। আমরা বাঙালীর হাজার বছরের মূল্যবোধ নিয়ে থাকতে চাই। সত্য সুন্দরের চর্চা নিয়ে থাকতে চাই। মূল অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে। প্রথমে ছিল মেঘমল্লার রাগ। পরিবেশন করেন এইচ এম রতন। ১৫ মিনিটের মতো বাজে তার কণ্ঠ। সঙ্গে ছিল তানপুরা। তুলসী সাহার তবলা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গে নিখুঁতভাবে যাচ্ছিল না। তবু ১৫ মিনিটের কণ্ঠসঙ্গীত উপভোগ করেন শ্রোতা। দলীয় সঙ্গীতে বর্ষা বন্দনা করে ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সঙ্গীত একাডেমি। তাদের কণ্ঠে ছিল আষাঢ় মাসের গান। বর্ষা বাঙালী মনে অদ্ভুত এক চাঞ্চল্য এনে দেয়। সেই চাঞ্চল্যকেই যেন ধারণ করে নৃত্যজন। সংগঠনের একদল শিল্পী আসে নাচ নিয়ে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটির সঙ্গে চমৎকার কোরিওগ্রাফী দারুণ উপভোগ করেন দর্শক। গান হলো। নাচও। এবার কবিতা নিয়ে আসেন নায়লা তারাননুম চৌধুরী কাকলী। উৎসবটি গুলশানে বর্ববর জঙ্গী হামলায় নিহতদের উৎসর্গ করা হয়। নিগার চৌধুরীর সাম্প্রতিক লেখা কবিতা থেকে সে কথাই বলার চেষ্টা করেন বাচিক শিল্পী। অনুতপ্ত কণ্ঠ শুনিয়ে যায়Ñ অতিথি আপ্যায়নের ঐতিহ্যের বরণ ডালায়/ভালবাসার সরোবরে, বিষাক্ত সরিসৃপের ছোবল/যুথী কামিনী রজনীগন্ধার শুভ্রবসনে/জবা কৃষ্ণচূড়া পলাশের রঙের ঝলক।/আমার দু’হাত ভরা, গুচ্ছ গুচ্ছ/কদম ফুলের শরীর গড়িয়ে গড়িয়ে,/তির তির করে ঝরছে উষ্ণ রক্ত...। দ্বিতীয় পরিবেশনায় শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। শিল্পী জয় গোস্বামীর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা’ থেকে শোনানÑ আমি যখন ছোট ছিলাম/খেলতে যেতাম মেঘের দলে/একদিন এক মেঘবালিকা/ প্রশ্ন করলো কৌতূহলে...। কবিতা শেষ হলে আবারও গানে ফেরা। এবার বিমান চন্দ্র মিস্ত্রি। এই তরুণ শিল্পীর অদ্ভুত সুন্দর কণ্ঠ। গায়কীও অসাধারণ। গাইলেন উকিল মুন্সি থেকে। সেই কালজয়ী সুর আকুতি ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে/ পূবালী বাতাসে-/বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি/আমার নি কেউ আসে রে...।’ গান শেষ হতে না হতেই নূপুরের আওয়াজ আসতে থাকে। এবার নৃত্যমের দলীয় পরিবেশনা। একটি আধুনিক গানের সঙ্গে সুন্দর নাচেন একদল শিল্পী। তার পর বিজন চন্দ্র মিস্ত্রীর একক সঙ্গীত। এ শিল্পীও চমৎকার গাওয়ার জন্য প্রশংসিত। উৎসবগুলোতে মোটামুটি নিয়মিত তিনি। এদিন গাইলেন ‘বরষা ঐ এলো বরষা’ গানটি’। যথারীতি মুগ্ধ হয়ে শুনলেন শ্রোতা। রূপা কর্মকারের কণ্ঠে ছিল ‘রুমঝুম রুমঝুম কে বাজায়’ গানটি। মিষ্টি গলা। বেশ শোনায়। সুরসপ্তকের পরিবেশনার সময় দেখা দেয় বিপত্তি। গানের মাঝখানে বৈদ্যুতিক গোলযোগ! তাতে কী? শিল্পীরা আত্মবিশ্বাস নিয়েই গেয়ে যান নজরুলের প্রিয় গানÑ অম্বরে মেঘ-মৃদঙ্গ বাজে জলদ-তালে/লাগিল মাতন ঝড়ের নাচন ডালে ডালে...। এভাবে একের পর এক গান নাচে জমে ওঠে বর্ষা উৎসব। প্রথম পর্বের সমাপ্তি হয় বর্ষা কথন দিয়ে। বর্ষা কথনে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্য দেশ। প্রতিটি ঋতু নিয়ে কবিতা গান আছে। শিল্পীরা এসব গান কবিতায় বর্ষা বন্দনা করছেন। এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? এর পরই আলোচনার প্রসঙ্গ হয়ে আসে গুলশান ট্র্যাজেডি। উপাচার্য বলেন, এমন সুন্দর শিল্প সংস্কৃতির দেশে ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে যে বর্বর জঙ্গী আক্রমণ তা মেনে নেয়া যায় না। এই জল হাওয়ায় বড় হওয়া কোন ছেলে এভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে না। অথচ আমরা তাই দেখলাম। তবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এসব হায়েনাদের প্রতিহত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। পরে গুলশানে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সবুজ ধরণীর প্রত্যাশায় শিশু-কিশোরদের মাঝে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম পর্ব। বিকেলেও ছিল একই রকমের আয়োজন। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে চলে নাচ গান কবিতা। রাত পর্যন্ত বর্ষা বন্দনা করা হয়। বাঙালী সংস্কৃতির জয়গান করা হয়। মানবিক সমাজের গড়ার লক্ষ্যে এই যাত্রা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন সংস্কৃতি কর্মীরা।
×