ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র ৪৭ ট্যাক্সিক্যাব চলছে রাজধানীতে, প্রয়োজনেও মেলে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৩ জুলাই ২০১৬

মাত্র ৪৭ ট্যাক্সিক্যাব চলছে রাজধানীতে, প্রয়োজনেও মেলে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাস্তায় পুরনো ট্যাক্সি নেই। মেয়াদ শেষ হওয়ায় মধ্যবিত্তের প্রাইভেটকার হিসেবে পরিচিত পুরনো ট্যাক্সিগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। কথা ছিল ২০১৩ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামে নামানো হবে ৫ হাজার নতুন ট্যাক্সিক্যাব। সে প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি। ঝুলে আছে সরকারের ট্যাক্সি নামানোর সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত রাজধানীতে ট্যাক্সি চলছে ৫০টি, প্রায় দুই কোটি মানুষের এ শহরে যা খুবই অপ্রতুল বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ট্যাক্সি পান না। তাদের কাছে ট্যাক্সি যেন সোনার হরিণ। তাছাড়া উচ্চমাত্রার ভাড়া নির্ধারণ করায় অনেকে পেলেও উঠতে সাহস পান না। এদিকে নানান জটিলতায় নতুন আর কোন ট্যাক্সি রাস্তায় নামাচ্ছে না তমা কনস্ট্রাকশন ও ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর গণপরিবহন সঙ্কট সমাধান ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নতুন ট্যাক্সি নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। নতুন এ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২ সালের পর থেকেই। শেষ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৬শ’ ট্যাক্সি নামাতে দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপর ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল নতুন ট্যাক্সি সার্ভিস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৪শ’ ট্যাক্সি নামানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল; যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪৭ ট্যাক্সির মধ্য দিয়ে। এরপর কথা ছিল নির্ধারিত দুটি কোম্পানি পর্যায়ক্রমে ঢাকা-চট্টগ্রামে গাড়ি নামাবে। নতুন ট্যাক্সি সার্ভিসের যাত্রা শুরুর আগে থেকেই ভাড়া নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। এসি ট্যাক্সিতে উঠলেই দুই কিলোমিটারের জন্য গুনতে হবে ১০০ টাকা। প্রথম পর্যায়ে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা! প্রতি মিনিটের জন্য অপেক্ষমাণ বিল আট টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাড়ায় নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন আমদানি করা এসব ট্যাক্সিভাড়া। ১৮-২৬ লাখ টাকা মূল্যের এসব গাড়িতে মতিঝিল-আব্দুল্লাপুর ২২ কিলোমিটারের ভাড়া প্রায় এক হাজার টাকা! মিরপুর থেকে মতিঝিল ১৬ কিলোমিটার রাস্তার জন্য ভাড়া গুনতে হচ্ছে প্রায় ৭শ’ টাকা! নতুন ট্যাক্সি নামানো হচ্ছে না ॥ ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় নতুন ৪৭ ট্যাক্সিক্যাব দিয়ে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৯ ও ঢাকায় ২৭। তবে বেশিরভাগই ঢাকায় চলছে। ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেস প্রাথমিকভাবে টয়োটা ব্র্যান্ডের জাপানে নির্মিত ১৫শ’ সিসির ২৭ ট্যাক্সিক্যাব পরিচালনা করছে। অপর বেসরকারী সংস্থা তমা গ্রুপ একই ব্র্যান্ডের ১৯ ট্যাক্সিক্যাব পরিচালনা করছে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি চট্টগ্রামে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন যাত্রীদের চাহিদা ও পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৬৫০ ট্যাক্সিক্যাব নামানো হবে। তবে এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ এক হাজার ট্যাক্সি নামানোর। নতুন আরও ট্যাক্সি নামানো প্রসঙ্গে তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক জনকণ্ঠকে বলেন, অব্যাহত লোকসানের মুখে নতুন ট্যাক্সিক্যাবগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। চুক্তি থাকলেও নতুন করে ট্যাক্সিক্যাব নামানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ট্যাক্সি নামানো প্রক্রিয়াও বন্ধ। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন দেশে এয়ারপোর্টে ট্যাক্সি ঢুকতে দেয়া হয় নাÑ এমন নজির নেই। গণপরিবহন বলতে ট্যাক্সির গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকজন প্রাইভেটকার হিসেবে এ বাহনটি ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম। আমরা নতুন ট্যাক্সি নামানোর পর থেকই এয়ারপোর্টে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া বেশি দামে বিলাসবহুল গাড়ি কেনায় কম ভাড়ায় তা চালানোও সম্ভব হচ্ছে না। সঙ্গতকারণেই বিমানবন্দরের বাইরে ভাড়া কম পাওয়া যায়। ভাড়ার রেট বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ নতুন ট্যাক্সিতে উঠতে চান না। তিনি জানান, বিমানবন্দরে ট্যাক্সি প্রবেশে সুযোগ দেয়া, নগরীর কয়েকটি স্থানে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড করে দেয়ার জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব চিঠি সিটি কর্পোরেশনের কাছে ফরওয়ার্ড করে দিয়ে দায়সারা হয়েছে। সঙ্কটের সমাধান হয়নি এখনও। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদিত দুটি কোম্পানি নতুন করে ট্যাক্সি নামাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। নানা শর্তের বেড়াজালে এ মুহূর্তে পুরো প্রক্রিয়াটিই থেমে আছে। এ কারণে কম টাকায় নতুন করে ট্যাক্সি আনার চিন্তা করছে সরকার। যদিও এ বিষয়ে এখন চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, সঙ্কট সমাধানে আলোচনা চলছে। দ্রুত এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। ২০০২ সালে প্রথমে ৮ বছর এবং পরবর্তীতে ২ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর মেয়াদী কালো এবং হলুদ ট্যাক্সিক্যাব মিলিয়ে রাজধানীতে ১০ হাজার এবং রাজধানীর বাইরে ২ হাজার ট্যাক্সিক্যাবের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। উভয় ধরনের ট্যাক্সিক্যাবের মেয়াদ গত ২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়। চালকদের প্রবল আন্দোলনের মুখে পুরনো ট্যাক্সি তুলে দেয় সরকার। নতুন ট্যাক্সি নামানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রেক্ষাপটে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নতুন এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ট্যাক্সির দেখা মেলে না ॥ রাজধানীতে ট্যাক্সি চলে এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। বাস্তবতা এমনই। এর কারণ হলো পরিবহন স্বল্পতা। নগরীর নির্দিষ্ট এলাকায় শুধু কয়েকটি ট্যাক্সির আনাগোনা চোখে পড়ে। এর মধ্যে বিমানবন্দর, গুলশান, বনানী, ধানম-ি এলাকাতেই বেশি। ভাগ্য ভাল হলে কমলাপুরে দেখা পাওয়া যায় হলুদ ট্যাক্সির। তমা গ্রুপের ট্যাক্সিচালক বাঁধন জানান, গাড়ি নামানোর পর থেকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। একে তো সমস্যা হলো গাড়ির সংখ্যা কম, অন্যদিকে অনেকেই বেশি ভাড়ায় উঠতে চান না। তবে কোন কোন সময় যাত্রীদের চাহিদা থাকলেও গাড়ির যোগান দেয়া সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান গাড়ি পরিচালনা করে সন্তুষ্ট নয় বলে জানান তিনি। মতিঝিল থেকে বিমানবন্দরে যেতে ট্যাক্সির অপেক্ষায় ছিলেন কানাডা প্রবাসী রাশেদ মিয়া। তিনি জানান, দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পরও একটি ট্যাক্সির দেখা মেলেনি। তিনি জানান, মাঝে মধ্যে অটোরিক্সার দেখা পেলেও ট্যাক্সি পাওয়া যায়নি। মধ্যবিত্তের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্যাক্সিক্যাব নামানোর দাবি জানান তিনি। নিরাপদ নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আশীষ কুমার দে জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে রাজধানীতে গণপরিবহন সঙ্কট সমাধান হচ্ছে না। নগরীতে উন্নত বাস সার্ভিস নেই। নেই ট্যাক্সি সার্ভিসও। তাহলে মানুষ কিভাবে যাতায়াত করবেন। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য অসংখ্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা থাকে। তিনি যাত্রীদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে কমমূল্যে নতুন ট্যাক্সি নামানোর দাবি জানান। তিনি বলেন, বেশি টাকায় গাড়ি আমদানি করা হলে ভাড়াও বেশি গুনতে হয়, যা সাধারণ যাত্রীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বন্ধ হওয়া ১২ হাজার ট্যাক্সির বিপরীতে নতুন ট্যাক্সি নামানোর দাবি জানান এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। নতুন ট্যাক্সির ভাড়া নির্ধারণ হয় ২০১০ সালে ॥ রাজধানীর পরিবহন সঙ্কট সমাধানে নতুন ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ হয় ২০১০ সালে। তখন এসি ট্যাক্সিতে প্রতি দুই কিলোমিটারের জন্য ৬০ টাকা পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১৫ টাকা ও দুই মিনিটের জন্য ওয়েটিং বিল ধরা হয় ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। নন-এসি ট্যাক্সির ক্ষেত্রে প্রথম দুই কিলোমিটার ৫০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১২ টাকা ও ওয়েটিং বিল ধরা হয় ৩ টাকা। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারী জটিলতা ও কোন প্রতিষ্ঠানকে নতুন ট্যাক্সিক্যাব আমদানির জন্য চূড়ান্ত করা হবেÑ এসব ইস্যুতে সময়ক্ষেপণ হয়। প্রায় চার বছর পর নতুন ট্যাক্সি আমদানি করা হলেও ২০১০ সালের গেজেটের কথা সবাই ভুলে গেছেন। তাছাড়া নতুন ট্যাক্সির ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরনো গেজেটও অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ অনেকের। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে থাকবে এসব ট্যাক্সি ॥ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্যই ট্যাক্সিক্যাব পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সবার আগে জনস্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ ট্যাক্সিক্যাব মালিক চালক ঐক্য পরিষদের মহাসচিব ওবায়দুল হক নতুন ট্যাক্সিক্যাবের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার বিরোধিতা করে বলেন, ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা হয়নি। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে এসব ট্যাক্সিক্যাব। যাদের বাড়ি গাড়ি আছে, বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক তারাই এসব ট্যাক্সিতে উঠতে পারবেন। বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, আগের ট্যাক্সিগুলো ছিল ৮০০ সিসি, নতুন ট্যাক্সি এক হাজার ৫০০ সিসি। এ কারণে নতুন গাড়ি টেকসই বেশি হবে। এসব গাড়ি সিসি ক্যামেরায় কন্ট্রোল রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ কারণে ছিনতাই হওয়ার আশঙ্কা নেই। গাড়িতে কোনকিছু রেখে গেলে যাত্রীরা অভিযোগ করলে ফেরত পাবেন।
×