ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জেগে ওঠা চরের পরিমাণ ২ হাজার বর্গ কিলোমিটার

হারিয়ে গেছে নদী ॥ নাম ধরে রেখেছে সেতু

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৩ জুলাই ২০১৬

হারিয়ে গেছে নদী ॥ নাম ধরে  রেখেছে  সেতু

সড়ক পথে চলতে গেলে চোখে পড়ে অনেক ছোট সেতু। সেতুর নিচে পানি প্রবাহ নেই। শুকনো ঠা ঠা। বর্ষাকালেও পানি ভরে না। কংক্রিটের সেতুর প্রবেশ পথে রেলিংয়ের ওপর লেখা থাকে কোন নদীর নাম। নদীর অস্তিত্ব নেই। নদীর নাম ধরে রেখেছে সেতুটি। এমনই কত নদী শুকিয়ে মাটি ভূমি হয়েছে আর কত নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই নদী দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানের। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদী অসংখ্য শাখা প্রশাখা নিয়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। উজানে যে নদী গঙ্গা এ দেশে তা পদ্মা। উজানের ব্রহ্মপুত্র এ দেশে যমুনা নাম নিয়ে অনেক শাখা বিস্তার করেছে। এই নদনদী থেকে অসংখ্য শাখা নদী ও উপনদীর সৃষ্টি হয়েছে। এই নদীগুলো ৯ দশমিক ৬০ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রবাহিত। যার মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে আছে বাংলাদেশ। যেসব নদীর জল প্রবাহের ৮০ শতাংশ আসে বর্ষা মৌসুমের চার মাসে (জুন-সেপ্টেম্বর)। প্রতি বছর এরা বহন করে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন পলি। ছোট নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই পলি। ভৌগোলিকদের মতে প্রত্যেক নদীর পলি বহনের নির্দিষ্ট ক্ষমতা থাকে। ক্ষমতার বেশি পলি বহন করতে হলে অথবা বন্যার সময় বাড়তি জলপ্রবাহ ধারণ করতে না পারলে নদীকে গতি পরিবর্তন করতে হয়। এ দেশে প্রায় ১৪ হাজার ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ আঁকাবাঁকা অথবা চুলের বেনীর মতো পেঁচানো বলে বাড়তি পলি অথবা জলপ্রবাহ অনেক বেশি হারে ভাঙনের কারণ হয়। এছাড়া যেসব নদীর পাড় খুব স্থিতিশীল নয়, সেখানেও দেখা দেয় ভাঙন। একদিকে পাড় ভেঙ্গে দেয়। আরেকদিকে প্রবাহ বাধা পেলেই গতি পরিবর্তন করে। নদী শুকিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এভাবেই অনেক নদী হারিয়ে গেছে। ভাঙনের মতো চর জাগার বিষয়টিও নদীর চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক নদী ভরাট হয়ে মরাগাঙে পরিণত হচ্ছে। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অবরুদ্ধ হচ্ছে। খালে পরিণত হচ্ছে নদী। শুকনো মৌসুমে সেচের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নাব্য হ্রাস পেয়ে নৌচলাচল বিঘিœত করছে। পানি প্রবাহ কমেছে বড় নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ধরলা, তিস্তায়। যার প্রভাবে অনেক ছোট নদী অস্তিত্ব হারিয়েছে। খলসডোঙ্গা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, তেঁতুলিয়া, ইচ্ছামতি, নারদ, হুরাসাগর, গুমানী, কাঁকন, কাকেশ্বরী, চিকনি, চিকনাই, করতোয়া, রূপনাই, ফুলেশ্বরী, বাঙালী, নদীশুখা, মাথাভাঙ্গা, গোমতি, গুঙ্গানী, ট্যাপাখাওয়া, উছলি ইত্যাদি নদী কোথাও মরা গাঙ কোথাও শুকনো। অনেক নদী শুকিয়ে আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। দখলও হয়েছে নদীভূমি। যেমন বগুড়া শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী শুকিয়ে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। শহরের ভিতরেই নদীকে দেখে মনে হয় কোন কাঁচা ড্রেন। এই নদীর দুই তীরের অনেকটাই দখল হয়েছে। এই নদী কত বড় ছিল তা ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ড ও ১৯৬২ সালের এস আর রেকর্ডে উল্লেখ আছে। নদী রক্ষায় এই রেকর্ডও দেখা হয় না। খরস্রোতা এই নদীর নাব্য হ্রাস হয় গত শতকের ৮৭-৮৮ সালে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালির কাছে বহমান করতোয়ার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে সেই পানি বাঙালী নদীতে ঘুরিয়ে দেয়ায় জন্য চকরহিমপুরে রেগুলেটার নির্মাণ করা হয়। এর প্রবাহে করতোয়া দিনে দিনে হয়ে ওঠে খাল। পানি না থাকায় গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়া পর্যন্ত নদীর নানাস্থানে শুকিয়ে যাওয়ায় শুরু হয় দখল প্রক্রিয়া। করতোয়াকে বাঁচাতে ২০০২ সালে নদী উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় একশ’ ২৫ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে প্রাক্কলন করা হয় ৮৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্প আর বাস্তবায়িত হয়নি। শুকনো মৌসুমে অনেক নদী খুঁজে পাওয়া যায় না। পদ্মা মেঘনা তিস্তার পানি প্রবাহ নি¤œগামী। শাখা নদীতে পানি প্রবাহ কমছে। নাব্য হারিয়ে মজে যাচ্ছে। বর্ষায় উজানের ঢলে পানি প্রবাহ বাড়ে। হেমন্তের শুরুতেই কোথাও পানি থাকে না। বড়াল নদী বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠে। পানির মাত্রা ৪৫ থেকে ৮০ ফুট। শুকনোয় ৩০ থেকে ১০ ফুট। অনেক স্থানে তাও থাকে না। মহানন্দা বর্ষায় ৭২ দশমিক ১২ ফুট। শুকনো মৌসুমে ২৫ ফুট। করতোয়া শাহজাদপুরে বর্ষায় ৬০ ফুট শুকনোয় ৫ দশমিক ৪ ফুট। চাটমোহরে গোমনী নদী বর্ষায় পানি প্রবাহ সেকেন্ডে ১৮ হাজার ২৫০ কিউসেক শুকনোয় মাত্র ২শ’ কিউসেক। বাঘাবাড়ি ঘাটে বর্ষায় হুরাসাগর পানির উচ্চতা ৬৫ দশমিক ৮৮ ফুট শুকনোয় ১৩ দশমিক ৭ ফুট। চিকনী বর্ষায় ২৫ ফুট শুকনোয় ৪ দশমিক ৫ ফুট। নারদ বর্ষায় ২২ ফুট শুকনোয় পানি থাকে না। এদিকে নদী শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চর ভূমি। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত ১৫০টির বেশি চর জেগেছে। কুড়িগ্রাম থেকে পাবনার ঢালার চর পর্যন্ত তিনশ’র বেশি। ঢালার চর থেকে রাজশাহী দেড়শ’রও বেশি। এইসব চর বড় নদীতে পানি প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। এক সূত্র জানায়, নদী থেকে জেগে ওঠা চরের পরিমাণ এক হাজার ৯শ’ বর্গ কিলোমিটার। যা মোট ভূমির প্রায় পৌনে দুই শতাংশ। যমুনায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার। গঙ্গা ও পদ্মায় ৬শ’ বর্গ কিলোমিটার। মেঘনা উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় তিনশ’ বর্গ কিলোমিটার। একটা সময় হাটবাজার জনপদ ছিল নদী তীরে। ব্যবসাবাণিজ্য বেশি হয়েছে নদীপথে। সংস্কারের অভাবে অনেক নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×