ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৩ জুলাই ২০১৬

কর্নেল তাহের ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

(গতকালের পর) তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে একটু বলি, সিরাজুল আলম খানের আদর্শিক নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের প্রগতিশীল তারুণ্য যারা মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগামী অংশ ছিল, তারা শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে অসম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণতা দানের বলিষ্ঠ ঘোষণা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তখন। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার রূপটি চিহ্নিত করতে তারা তখন ব্যাপকভাবে চিরায়ত প্রগতিশীল সাহিত্য অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেছেন। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমানের সঙ্গে। ১৯৭২-এ ড. আখলাক ‘সাপ্তাহিক হলিডে’ পত্রিকায় বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বরূপ বিশ্লেষণ করে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এ লেখার মাধ্যমে ভবিষ্যত জাসদ নেতৃত্বের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে। ড. আখলাকুরের গবেষণা সঞ্জাত ‘বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ শীর্ষক প্রবন্ধটির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন তারা। এ প্রবন্ধে দেখানো হয়, কিভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল খাত কৃষিতে ইতোমধ্যেই পুঁজিবাদ প্রধান প্রবণতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং তা সমগ্র অর্থনীতির নিয়ামক হিসেবে পরিণত হয়েছে। এই তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে জাসদের নবীন নেতৃত্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আওয়াজ তোলেন। সমাজ সম্পর্কে মুখ্যত পুঁজিবাদী বিকাশের কথা বললেও এখানে বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ সম্পর্কেও জাসদ নেতৃত্বের উপলব্ধি ছিল। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অপূর্ণতার বিষয়েও তারা সচেতন ছিলেন। তাই সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অপূর্ণ জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে পূর্ণতা দেয়ার কথা তারা বললেন। বিদেশী আধিপত্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খবরদারি ও সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে জাসদ নেতৃত্ব জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অপূর্ণতার দিক হিসেবে চিহ্নিত করতেন। রাজনৈতিক রণকৌশল হিসেবে তারা গণতান্ত্রিক জাতীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সে সংগ্রামে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ঘটিয়ে তার অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশের কথা বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাত্রা নির্ভর করবে নিপীড়িত শ্রেণী কতটুকু সংঘটিত হলো তার মাত্রার ওপর। গ্রাম এবং শহরের শ্রমিক শ্রেণী ও গরিবেরা বিপ্লবের শক্তি হিসেবে কতটুকু সংঘটিত হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে জাসদ নেতৃবৃন্দ গণঅভ্যুত্থানকে ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে মাও সেতুংয়ের প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের চৈনিক মডেল নয়, বরং বলশেভিক ধাঁচের গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে যথার্থ বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরে সমাজে পরিবর্তনের আকাঙ্খা তখন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত হাজার হাজার তরুণ যারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিল, নতুন রাজনৈতিক ওই সব আহ্বান তাদের দ্রুত আকৃষ্ট করে। সেনাবাহিনীতেও সাধারণ সৈনিকরা জাসদের উত্থানকে আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিল। এসব বাস্তবতায় কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বাংলাদেশের একঝাঁক নবীন বিপ্লবীর রাজনৈতিক সংযোগটি দৃঢ় হতে থাকে। আমার মনে আছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন বাম বিপ্লবীদের সঙ্গে তুলনা করে তাহেরের মনে হয়েছে বাংলাদেশের বাস্তবতায় জাসদের এই নবীন শক্তির পক্ষেই কেবল সম্ভব হবে সবচেয়ে সফলভাবে সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের প্রতিভাবান তরুণ সংগঠকদের মধ্যেই তিনি দেখতে পেয়েছিলেন সেই সম্ভাবনা যাদের নেতৃত্বে এ দেশের নিপীড়িত মানুষ সমাজ বদলের লড়াইয়ে সংঘটিত হবে। তাই বলা যায়, জাসদের বিপ্লবী নেতৃত্বের আহ্বানের মধ্যে তাহের দেখেছিলেন তার আবাল্য-লালিত স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা। তিনি মনে করেছিলেন, ছাত্রলীগের যে রেডিক্যাল অংশটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে, তাদের পক্ষেই সম্ভব সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আরও একটি বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জাসদের রণনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গেও তাহের একমত হয়েছিলেন। তাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নবউত্থিত বিপ্লবী শক্তি জাসদে তাহেরের যোগ দেয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল। অত্যন্ত সচেতনভাবেই গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাহের তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জাসদ প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর পর এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, জাসদে যোগদান প্রশ্নে তাহেরের বিবেচনা যথার্থ ছিল কি-না। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জাসদ ঘোষিত রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী রচিত আন্দোলনসমূহ সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করে তার যথার্থতা বিচার করতে হবে। জাসদ সূচিত বড় বড় আন্দোলন, বিশেষ করে ১৯৭৫-এর ৭ নবেম্বরে জাসদের সহযোগিতায় তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী অভ্যুত্থান বিষয়ে গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। ওই অভ্যুত্থান সফল হয়নি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লব সফল হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রগতিবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুযোগটি পেয়ে যায়। তবে শুধু প্রগতিশীল শক্তির এই পরাজয়ের মধ্যে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ না করে আমাদের ভাবতে হবে সামনের দিনগুলোর কথা। নবেম্বর অভ্যুত্থানে পরাজয় এবং তাহেরসহ অগণিত বিপ্লবীদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে জাসদের বিপ্লবী রাজনীতির ইতি হয়ে গেছে, তা ভাববার কোন কারণ নেই। যুগে যুগে, দেশে দেশে সমাজ প্রগতির ধারায় আমরা দেখেছি সমাজের নবতর শক্তি কিভাবে পরবর্তী অবস্থার উপযোগী করে পরিবর্তনের ধারায় নিজেদের তৈরি করেন ভবিষ্যত নির্মাণে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই পাঠ নিতে হবে জাসদের আপোসহীন ধারাটির সংগ্রামী ইতিহাস থেকে। বিশেষ করে ৭ নবেম্বর অভ্যুত্থান এবং এর সঙ্গে সামরিক শাসনবিরোধী গৌরবময় সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে। ফাঁসির মঞ্চে তাহেরের জীবনদান এবং তাঁর উদ্দীপ্ত উচ্চারণ- ‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোন সম্পদ নেই। চলবে...
×