ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘মন্ত্রীরা পালিয়ে গেছেন’ আর বার্নিকাটের মন্তব্য নিয়ে সংসদে তোপের মুখে সুরঞ্জিত

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২২ জুলাই ২০১৬

‘মন্ত্রীরা পালিয়ে গেছেন’ আর বার্নিকাটের মন্তব্য নিয়ে সংসদে তোপের মুখে সুরঞ্জিত

সংসদ রিপোর্টার ॥ মন্ত্রীদের অনুপস্থিতি ও বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের কিছু মন্তব্য নিয়ে খোদ সরকারী দলের সিনিয়র নেতারা নিজেদের মধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাহাসে জড়িয়ে পড়েন। দু’পক্ষের এই বাহাস থামাতে কিছুটা হলেও গলদঘর্ম হতে হয় ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কঠোর সমালোচনা করলে নিজ দলেরই অপেক্ষাকৃত জুনিয়র সদস্যদের তোপের মুখে পড়তে হয় তাঁদের। ‘সামনের সারির মন্ত্রী পালিয়ে গেছেন’Ñ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এমন মন্তব্যর কারণেও তাঁকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। বিষয়টি নিয়ে সরকারী দলেরই ৬ সংসদ সদস্যের পাল্টা-পাল্টি বক্তব্যে কিছু সময়ের জন্য হলেও সংসদ অধিবেশন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। রাত সোয়া আটটার দিকে অনির্ধারিত এই বিতর্কের সূত্রপাত করেন সরকারী দলের প্রবীণ সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দখল করার জন্য নয়, সাহায্য করার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। মনে হলো তারা ইচ্ছা করলে দখল করতে পারে এবং দখল বহালও রাখতে পারে। এ ধরনের হুমকি আমেরিকান প্রতিনিধি দিচ্ছেন তাদের নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং আমরা এই পার্লামেন্ট থেকে বলতে চাই, এ ধরনের হুমকি কোন ডিপ্লোমেট কোন দেশ সম্পর্কে দেয়া শোভনীয় নয়, এটি শিষ্টাচারবহির্ভূত। এ ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোরদার আপত্তি দেবেন বলে আশা করি। অধিবেশনে মন্ত্রীদের অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, মাননীয় স্পীকার। এই অবস্থায় যদি হাউস চলে, তাহলে এই হাউস (অধিবেশন) চলার চেয়ে না চলাই ভাল। পার্লামেন্ট চালানোর জন্য সামনের সারিতে অন্তত একজন মন্ত্রী হলেও রাইখেন। মেনন সাহেব (বিমানমন্ত্রী) তাকাচ্ছেন, আসলে উনি আছেন, কিন্তু উনি তো ভেজাল মন্ত্রী (অন্য দল থেকে মন্ত্রী পরিষদে এসেছেন)। এটা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। শেখ ফজলুল করিম সেলিম সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, বাংলাদেশ ছোট রাষ্ট্র হতে পারে। কিন্তু আমাদেরও আত্মমর্যাদা ও সম্মান আছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত একজন সহকারী সচিব পদমর্যাদার। তিনি বাংলাদেশ নিয়ে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কারো দয়ায় স্বাধীন হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমেরিকার ভূমিকা কী ছিল পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার পক্ষে। গণহত্যায় শরিক হয়ে তারা সেদিন গণতন্ত্রের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। সেদিন আমেরিকা অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছিল। তারা আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার দেশে তালেবান বা আল-কায়েদা নেই? কিছুদিন আগে নাইট ক্লাবে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। টুইন টাওয়ারে হামলা হয়েছে। এখন যদি বলি আমরা গিয়ে আপনাদের নিয়ন্ত্রণ করি। এটা পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা লিবিয়া নয়। এটা বাংলাদেশ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সুরঞ্জিত ও শেখ সেলিমের বক্তব্যের পরপরই ফ্লোর নেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন ‘আমাদের একজন সদস্য বললেন-মন্ত্রীরা পালিয়ে গেছেন। আমার মনে হয় তারা পালিয়ে যাননি। তারা পালিয়ে যেতে পারেন না। তার (সুরঞ্জিতের) এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করুন। কারণ উনিও (সুরঞ্জিত) একসময় মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রীরা আশপাশেই রয়েছেন। আমার মনে হয় উনি (সুরঞ্জিত) মনের অজান্তে এই মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিষয়েও যা বলা হয়েছে তা ঠিক নয়। বরং আমাদের দেশেরই কিছু লোক বিভিন্ন মন্তব্য করেছিলেন, বার্নিকাট সেগুলোরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। বাংলাদেশে কোনো তৎপরতা চালানোর কথা রাষ্ট্রদূত বলেননি।’ নানকের বক্তব্যের বিষয়ে ডেপুটি স্পীকার বলেন, সামনের কাতারে না দেখলেও আশপাশের কাতারে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা আছেন। তবে মাননীয় সদস্য (সুরঞ্জিত) ‘ভেজাইল্যা’ যে শব্দটি বলেছেন সেটিসহ অন্য আরও কোন অসংসদীয় শব্দ থাকলে তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। এরপর সংসদের চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত বার্নিকাটের বক্তব্য পাঠ করে বলেন, রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য সম্পর্কে আমাদের কোন কোন সদস্য যা বলেছেন তা সত্য নয়। বার্নিকাট বরং বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পারে না। এ ধরনের নীতিও তাঁর দেশের নেই। তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করতে চায়। কাজেই তার বক্তব্য নিয়ে অনেকে যা বলেছেন তা মনগড়া। পরে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান ফ্লোর নিয়ে সুরঞ্জিতের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, শেখ হাসিনা যাদের মন্ত্রী করেছেন তারা পরীক্ষিত, তারা কেউ পালিয়ে যাওয়ার মতো নেতা নন। এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মন্ত্রীদের অমর্যাদা করা হয়েছে। বার্নিকাটের বক্তব্যের বিষয়ে চীফ হুইপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কাজেই মন্ত্রীদের নিয়ে দেয়া বক্তব্য হয় তিনি (সুরঞ্জিত) নিজে প্রত্যাহার করুন, না হয় আপনি এক্সপাঞ্জ করুন। তখন ডেপুটি স্পীকার বলেন ‘এ বিষয়ে আর বেশি আলোচনার দরকার নেই।’ ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে ভাষায় কথা বলেছেন তা উচিত হয়নি। বাংলাদেশের চেয়ে ১০-২০ গুণ সন্ত্রাসী কর্মকা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগেই সেখানে সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় ৫০ জন মারা গেছেন। আমাদের কথাবার্তায় দেশে ও বহির্বিশ্বে কী মেসেজ যাচ্ছে, তা ভেবেই আমাদের কথা বলা উচিত। বিতর্ক শেষে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ তাঁর বেসরকারী সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপনকালে বলেন, এতক্ষণ সংসদে জ্বালাময়ী বক্তব্যে শুনলাম। সরকারী দলের সদস্যরাই একে অপরের বিরুদ্ধে যা বললেন, আমরা আর কী বলব।
×